কিছুমিছু
পাসপোর্ট অফিসে গেছিলাম দুর্নীতি কারে কয় বুঝছিলাম
মোকাম্মেল হোসেন
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগে বাড়িতে গেলে সকাল-বিকাল অষ্টধার বাজারে যাওয়া হতো। এখন কদাচ যাওয়া হয়। তো একবার অষ্টধার বাজারে যাওয়ার পর মফিজল বাল্যবন্ধু মফিজলের সঙ্গে দেখা হলো। এ কথা সে কথার পর মফিজল বলল-
: দোয়া করবা।
: দোয়া তো হামেশাই করি।
: ওইসব ফুঁ-ফা দোয়া না; স্পেশাল দোয়া লাগবে।
: স্পেশাল কী জন্য!
: বিদেশ যাওনের নিয়ত করছি।
: যাও। যাইয়া চাপ কমাও।
মফিজলের সঙ্গে আরেক বাল্যবন্ধু সোলায়মান ছিল। ইশারা-ইঙ্গিতে আমার কথার অন্য অর্থ প্রকাশ করে সে হেসে উঠতেই বললাম-
: আরে ভাই! আমি দেশের ওপর থেইকা চাপ কমানোর কথা কইছি।
সোলায়মানের ইশারা-ইঙ্গিতের মর্মার্থ অনুধাবন করে মফিজলও হাসছিল। হাসি থামলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: পাসপোর্ট হইয়া গেছে?
: হইছে। তবে নরমাল হয় নাই; সিজার লাগছে।
: কস কী ব্যাটা! এতদিন জানতাম, কোনো গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনা উঠার পর যদি নরমাল ডেলিভারি না হয়, তাইলে ডাক্তাররা সিজারিয়ান অপারেশন কইরা ডেলিভারি করায়।
: যুগ পালটাইছে। বর্তমান যুগে পাসপোর্ট ডেলিভারি করাইতেও অপারেশন লাগে।
মফিজলের কথা শুনে হাসলাম। সোলায়মানও হাসল। সোলায়মানের হাসির জবাব দিতে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মফিজল বলল-
: শোন সোলেমান, তুই যদি কুয়ার ব্যাঙ হইয়া নিজের এলাকায় পইড়া থাকস, তাইলে নো প্রবলেম; সব বিলকুল ঠিক হ্যায়। কিন্তু যখই তুই বাইরে পা বাড়াবি-দেখবি, এই দেশের সবখানেই গিট্টু আর প্যাঁচ। আমি বিদেশ যাওনের নিয়ত কইরা পাসপোর্টের কেবল ‘প’ উচ্চারণ করছিলাম; আর তাতেই যে প্যাঁচে পড়ছিলাম, সেই কাহিনিরে উপজীব্য কইরা একটা টেলিফিল্ম নির্মাণ করা যাবে।
মফিজের প্যাঁচ-কাহিনি শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সে তার অভিজ্ঞতার বয়ান শুরু করল এভাবে-
ঢাকার এক আদম বেপারির সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হওনের পর সে বলল-
: পাসপোর্ট নিজে করবেন, না আমরা কইরা দিমু?
আমি বললাম-
: নিজের কাজ নিজে করাই ভালা।
আমার কথা শুনে আদম বেপারি বলল-
: তাহলে আর্জেন্ট ফি দিয়া পাসপোর্টটা করাইয়া ফেলেন।
আদম বেপারির কথামতো পাসপোর্ট অফিসের সামনে যাইয়া দাঁড়াইতেই আট-দশজন চারপাশ থেইকা ঘিইরা ধরল। কচুরিপানার মতো সব কয়টারে দুই হাত দিয়া ঠেইলা সরাইতে পারলেও একজন আমার পিছু ছাড়ল না। সে জানতে চাইল-
: ভাই কি নতুন পাসপোর্ট করাবেন?
: হ।
: আর্জেন্ট?
: হ।
: আমি একটা কথা বলি। যদি কথাটা আপনের ভালো লাগে, তাইলে কেইসটা আমারে দিবেন। আর যদি ভালো না লাগে, নীরবে ইশারা করবেন-আমি আপনেরে সালাম জানাইয়া চইলা যাব।
: বলেন, কী কথা।
: যদি খুব বেশি ইমার্জেন্সি না হয়, তাইলে খামাকা আর্জেন্ট করাইতে গিয়া অতিরিক্ত টাকা কেন খরচ করবেন?
: আর্জেন্ট ফি কত?
: সাড়ে সাত হাজার, নয় হাজার-এইটা সময়ের উপর নির্ভর করে।
: এত টেকা ক্যান?
: সরকার রেট বাড়াইয়া দিছে।
: ক্যান?
: রেট বাড়ানোর পর এ বিষয়ে বিবৃতি দেখেন নাই পত্রিকায়? বিবৃতিতে বলা হইছিল-খারাপ লোকেরা যাতে ফুসুর-ফাসুর পাসপোর্ট না করাইতে পারে, সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
: সমাজে যারা খারাপ লোক, তাদের কাছে কি টাকা কুনু সমস্যা? তাদের কাছে তো ‘মানি ইজ নো প্রবলেম।’ প্রবলেম তো আমাদের মতো যারা জমি বেইচ্যা, ঘটি-বাটি বন্ধক রাইখা বিদেশ যাওনের চেষ্টা করে, তাদের।
: কী করবেন ভাই; সরকার তো আমার-আপনের ‘বোঝ’ লইয়া চলে না; তাদের ‘বোঝ’ মতনই তারা চলে।
এরপরও কোনো সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি না দেখে দালাল বলল-
: ভাই, একটা সিদ্ধান্ত দেন।
: কী সিদ্ধান্ত দিমু?
: কেইসটা আমারে দিবেন কিনা।
: দেখি।
: বেশি দেখাদেখির মধ্যে গেলে আপনার আর শিডিউল অনুযায়ী বিদেশ যাওয়া হবে না-এইটা আমি বলে রাখলাম। আপনেরে কয়েকটা নমুনা দেখাই-আসেন আমার সঙ্গে।
এ কথা বলার পর দালাল আমারে এক প্রকার টানতে টানতে একটা দেওয়ালের সামনে খাড়া করাইয়া কইল-কী লেখা আছে, পড়েন। দেওয়ালের এক জায়গায় দেখলাম, একজন ভুক্তভোগী লেইখা রাখছে-পাসপোর্ট অফিসে আইসা বাপের ভুইলা গেছি রে ভাই; আরেক জায়গায় লেখা-ছোটকালে একবার প্রতিবেশীর খেত থেইকা বাঙ্গি চুরি কইরা খাইছিলাম। পাসপোর্ট অফিসে আইসা সারাদিন না খাইয়া, না লইয়া লাইনে দাঁড়াইয়া থাইকা সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেছি। এর নিচে দেখলাম লেখা আছে-পাসপোর্ট অফিসে আইসা যে শিক্ষা পাইলাম, কোনোমতে একবার বিদেশ যাইতে পারলে হয়; ভুলেও দেশে ফেরার নাম মুখে আনমু না। এসব লেখা দেখে মাথা চক্কর দেওয়ার উপক্রম করতেই দালাল বলল-
: আপনে সাধারণ ক্যাটাগরিতে টাকা জমা দিয়া আমারে খুশি কইরা দিবেন। কথা দিলাম-মাত্র দশ দিনে আপনের পাসপোর্ট নামাইয়া দিমু।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর দালালের কথায় সম্মত হলাম। এরপর পাসপোর্ট ভবনের পাশে একটা হোটেলে আইসা বসার পর একটা ফরম আমার সামনে রাইখা সে বলল-
: ফিলাপ কইরা দেন।
ফরম পূরণ করতে করতে বর্তমান ঠিকানার ঘরে যাইতেই দালাল বলল-
: এই ঘরে কলমের টাচ লাগনোর আগে দুইটা কথা শুইনা নেন।
: বলেন।
: আপনের বর্তমান ঠিকানা হয় নারায়ণগঞ্জ জেলা, না হয় গাজীপুর জেলা দেওন লাগব।
: ক্যান, মমিসিং কী দোষ করছে?
: বর্তমান ঠিকানা মমিসিং লেখলে পাসপোর্ট মমিসিং থেইকা করান লাগবে।
: মমিসিং থেইকাই করামু।
: ওইখানেও আমার মতন কোনো দালালের লেঙুর ধরতে হবে মিয়াভাই। আপনে অলওভার বাংলাদেশ-লেজ না ধইরা পার পাবেন না।
: মহা মসিবত। এইসব কথা আপনে আমারে আগে বলেন নাই ক্যান?
: বলাবলির কী আছে? আপনে তো আর সিস্টেমের বাইরে না। সবাই যে সিস্টেমে করায়, আপনেও সেই সিস্টেমে করান।
: কিন্তু নারায়ণগঞ্জ বা গাজীপুর তো আমার কেউ থাকে না।
: থাকার দরকার নাই। ‘হাওয়া’ ঠিকানা মাইরা দিমু।
: হাওয়া ঠিকানা মানে?
: হাওয়া ঠিকানা মানে হইল ভুয়া ঠিকানা। প্রতিদিন অসংখ্য পাসপোর্ট এই ভুয়া ঠিকানায় বাইর হইতেছে।
: পরে যদি সমস্যা হয়! এর চাইতে ঢাকায় আমার এক চাচা থাকেন। তার ঠিকানা লেইখা দেই?
: দিতে পারেন। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনে আরও অতিরিক্ত টাকা খরচ হবে।
: ক্যান! আপনেরে যে টেকা দিতেছি, ওইখান থেইকা ম্যানেজ করতে পারবেন না?
: পাগলে কয় কী! আপনের দেওয়া ঘুসের ভাগীদার অনেক। তাছাড়া পুলিশ তো আমার কাছে আসবে না; পুলিশ যাবে আপনের লেখা ঠিকানায়।
পাসপোর্টে ভুয়া ঠিকানা থাকার বিষয়টা মন থেইকা মানতে পারতেছিলাম না। তাই চাচার বাসার ঠিকানা ব্যবহার কইরা চইলা আসার আগে চাচাকে বইলা আসলাম তদন্ত সামাল দেওয়ার জন্য। কিছুদিন পর মোবাইল কইরা জানলাম, তদন্ত হইয়া গেছে। তদন্তকারীরে জামাই আদর কইরা খাওয়া-দাওয়া করাইয়া নগদ সেলামিও দেওয়া হইছে। এর ঠিক দুইদিন বাদে বাড়িতে পুলশ আইসা হাজির। পুলিশ দেইখা বললাম-
: তদন্তের কাম তো ঢাকায় কমপ্লিট হইয়া গেছে। পুলিশ ভাই বললেন-
: ঢাকায় হইছে তাতে কী? সরকারের আইন-কানুন খুব কড়া। ঢাকার মফিজ আর অষ্টধারের মফিজ এক কিনা, এইটা যাচাই কইরা দেখা আমাদের কর্তব্য।
: দেখেন।
: খালি চক্ষের দেখা দেখলে তো হবে না। অষ্টধার থেইকা কোতায়ালি থানার দূরত্ব কত?
: চৌত্রিশ কিলোমিটার।
: এই চৌত্রিশ কিলোমিটার দূর থেইকা আইছি। আগে খানার এন্তেজাম করেন। এরপর বাকি আলাপ।
মুরগি জবাই দিয়া খাওয়ানোর পর পান আইনা সামনে রাখলাম। পান মুখে দিয়া পুলিশ ভাই বললেন-
: এইবার বিদায় করেন।
: আপনেরে কি বাইন্ধা রাখছি?
: কী বলতেছেন এইসব! সারাদিনের ডিউটি মাইর দিয়া আপনের কামে ছুইটা আইছি। আপনে এইসব কি কথা কন? পোশাক পইরা ঘরের বাইরে পাও রাখলেই চার-পাঁচ হাজার টাকা আমাদের জন্য কুনু ম্যাটার না, এইটা আপনে জানেন না?
কথা না বাড়াইয়া একটা পাচশ টেকার নোট আইনা পুলিশ ভাইয়ের হাতে দিলাম। নোটখান হাতে লইয়া এতিম বকের বাচ্চার মতন করুণ চোখ মেইলা কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকার পর পুলিশ ভাই বললেন-
: এইটা তো একটা বড় সাইজের দেশি মুরগিও পাওয়া যাবে না। এতে পোষায় না ভাই। মুরগির সঙ্গে পোলাউয়ের চাল আছে, বাটার অয়েল আছে, নানা কিসিমের মশলাপাতি আছে। খুচরা নোটফোট বাদ দিয়া বড় দুইখান নোট দেন।
পুলিশ পর্ব শেষ হওয়ার পর দালালের কথা মতন দুইবার ঢাকায় যাইয়া ফেরত আসলাম। দালাল জানাইল-পুলিশের রিপোর্ট না আসায় পাসপোর্ট তৈরি হয় নাই। তারে উলটা-সিধা দুই-চার কথা বলতেই বলতেই সে উলটা আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলল-
: দোষ তো আপনের। আমার কথা না শুইনা জেনুইন কইরা আম পাকাইতে গেছেন।
দেরি হয়ে যাচ্ছিল। মফিজলের কথার এ পর্যায়ে আমি বললাম-
: তার মানে, তোমার পাসপোর্টের ডেলিভারি করাইতে শুধু অপারেশন না; অপারেশনের পর স্যালাইনও দেওয়া লাগছে?
মফিজল আমার কথায় নীরব সম্মতি প্রকাশ করে বলল-
: এইটা তো গেল পাসপোর্টের কথা। এরপর পুলিশ ক্লিয়ারেন্স কী ঘটছে, বলি...
মফিজলের কথা শুনে সোলায়মান বাধা দিয়ে বলল-
: রাইত মেলা হইছে। তর ক্লিয়ারেন্স পর্ব পরে এক সময় শুনমু। আইজ এই পর্যন্ত থাক।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokamia@hotmail.com