স্মরণ
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও অধ্যাপক জব্বার
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারবার জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। বর্তমানে চলছে শিক্ষাক্রমের পঞ্চম আবর্তনের কাজ। প্রথমবার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয় ১৯৭৬-৭৮ সালে। পরে দেশের পূর্ণ শিক্ষাক্রম আরও দুবার (১৯৯১-৯৫ ও ২০১১-১২) পরিমার্জন করা হয়েছে।
মাঝখানে ২০০২-২০০৫ সালে একটি অসম্পূর্ণ (শুধু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন কার্যকর হয়েছিল, মধ্য-মাধ্যমিক উপস্তরের অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছিল, বাস্তবায়িত হয়নি)।
প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন (প্রথমবার) ও পরিমার্জনে (পরের পূর্ণ দুবার) সম্পৃক্ত থেকে নেতৃত্ব দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জব্বার এ দেশের শিক্ষাক্রমের গুরু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রায় ৮৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন শেষে ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি অধ্যাপক জব্বার পরলোকগমন করেন। আজ বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের এই গুরুর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী।
অধ্যাপক এমএ জব্বার ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে পরিচালক ও সদস্য সচিব করে যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়, তার সার্বক্ষণিক কর্ণধার হিসাবে ১৯৭৬ সালের ৪ মার্চ থেকে ১৯৭৮ সালের শেষ পর্যন্ত সাত খণ্ডে প্রকাশিত দেশের প্রথম শিক্ষাক্রম দলিল প্রস্তুতির মূল দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক জব্বার। তিনি ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত National Curriculum Development Centre (NCDC)-এর পরিচালকের গুরুদায়িত্বও পালন করেন। ১৯৮৪ সালে এনসিডিসি বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (জাশিপাবো) গঠিত হলে অধ্যাপক জব্বার এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম সদস্যের (শিক্ষাক্রম) দায়িত্ব পালন করে (১৯৮৪-৮৭) ১৯৮৮ সালে নায়েমের একজন পরিচালক হিসাবে সরকারি ‘চাকরি’ শেষ করেন।
সরকারি কর্মজীবন শেষে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রমের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হন। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের দ্বিতীয় আবর্তনে তথা প্রথম পরিমার্জনে (১৯৯১-১৯৯৫) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম রিপোর্ট প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসাবে তিনি তিনটি উপস্তরের জন্য তিনটি পৃথক রিপোর্ট সম্পাদনা করেন। শিক্ষাক্রমের অসম্পূর্ণ তৃতীয় আবর্তনে কুখ্যাত ‘একমুখী’ শিক্ষাক্রমে (যা বাস্তবায়িত হতে পারেনি) তাকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ওই সময়ে তিনি ইউনেস্কো ও বিশ্বব্যাংকের শিক্ষা-পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। ইউনেস্কোর ফেলো হিসাবে থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় কিছু সময়ের জন্য শিক্ষাক্রমের কাজ করেন। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’-এর আলোকে চতুর্থ আবর্তনের শিক্ষাক্রম (২০১১-১২) পরিমার্জন প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রমের কারিগরি (বিষয়ভিত্তিক) কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
জব্বার স্যারের একজন গুণমুগ্ধ ‘ভাব-শিষ্য’ হিসাবে তার মৃত্যুর পর প্রতিবছরই শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখি। এবার তার নেতৃত্বে প্রস্তুত করা প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। আগেই বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রম কমিটি ওই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছিল। মোট ৫১ সদস্যের এ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন দুজন-১. মার্চ ১৯৭৬ থেকে ২৬-০৫-১৯৭৭ পর্যন্ত অধ্যাপক মুহম্মদ শামস-উল হক; ২. ২৭-০৫-১৯৭৭ থেকে শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।
স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষাক্রম দলিল ও এর বৈশিষ্ট্য
দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম দলিল প্রকাশিত হয় মোট সাত খণ্ডে। এগুলো হচ্ছে-প্রথম খণ্ড : প্রাথমিক স্তর (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি), দ্বিতীয় খণ্ড : নিম্নমাধ্যমিক উপস্তর (ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি), তৃতীয় খণ্ড: মাধ্যমিক উপস্তর (নবম-দশম শ্রেণি), চতুর্থ খণ্ড : উচ্চমাধ্যমিক উপস্তর (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি), পঞ্চম খণ্ড : বৃত্তিমূলক শিক্ষা, ষষ্ঠ খণ্ড : শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং সপ্তম খণ্ড : পরীক্ষা ও মূল্যায়ন। নাম থেকেই বোঝা যায়, প্রথম চার খণ্ডে বিভিন্ন স্তরের বিস্তৃত শিক্ষাক্রম বর্ণিত হয়েছে, শেষ তিন খণ্ডে বর্ণনা করা হয়েছে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়। অর্থাৎ সাত খণ্ডে প্রকাশিত এ দলিলে শ্রেণি ও স্তরভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
স্তর ও শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বিস্তারিত চারটি দলিলের প্রতিটির শুরুতে শিক্ষার জাতীয় উদ্দেশ্যাবলি ও নীতিমালার উল্লেখ ছিল।
(ক) প্রধান উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে ছিল-
১. শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক সহজাত ক্ষমতা ও গুণাবলির সৃজনশীল বিকাশের মাধ্যমে তার দৈহিক, মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন।
২. শিক্ষার্থীদের মনে দেশের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত ও জাতীয় মূল্যবোধের সৃষ্টি করা এবং ন্যায়বোধ, কর্তব্যজ্ঞান, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচারবোধ এবং দেশের স্বার্থের সঙ্গে একাত্মতাবোধের জাগরণ।
৩. মানুষে মানুষে মৈত্রী, সৌহার্দ ও প্রীতি, মানবাধিকার এবং পারস্পরিক সমঝোতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব সৃষ্টি করা।
৪. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে দেশের সামাজিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সুদক্ষ ও সৃজনশীল জনশক্তি প্রস্তুত করা।
৫. কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনে শ্রমের মর্যাদাবোধ সৃষ্টি এবং জাতীয় উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করা।
৬. ব্যক্তি শিক্ষার্থীকে তার মেধা ও প্রবণতা অনুসারে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট পেশার জন্য প্রস্তুত করা এবং দৈনন্দিন জীবনে জ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করা।
(খ) নীতিমালার মধ্যে ছিল প্রধানত-
১. সাধারণ শিক্ষা এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য পৃথক ধারা প্রবর্তন।
২. কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ এবং বাস্তবমুখী জীবন ও পরিবেশকেন্দ্রিক শিক্ষা।
৩. শিক্ষার লক্ষ্য ও সাধারণ উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্যের সংগতি রেখে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা।
৪. বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাক্রম এবং একটি নির্দিষ্ট স্তরের অন্তর্গত শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সংযোগ রেখে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা।
৫. বিভিন্ন পাঠ্যবিষয়ের ব্যাপ্তি ও কাঠিন্য যেন শিক্ষার্থীদের বয়স, বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর, মানসিক প্রবণতা, দৈহিক ক্রমবিকাশের স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূূর্ণ হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
৬. একই স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যসূচির মধ্যে যেন একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
৭. সোপানভিত্তিক সমন্বয় প্রক্রিয়ার সাহায্যে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির গুরুত্ব নিশ্চিত করে অনুভূমিক রীতি অনুসরণে শিক্ষাক্রমের প্রসারতা সংগঠন করা (নিচের শ্রেণি থেকে উপরের দিকে ক্রমান্বয়ে একই বিষয়ের পাঠ্যসূচি ক্রমবৃদ্ধি করা)।
এসব নীতি ছাড়াও পাঠ্যপুস্তকের ভাষা ও বানানরীতি সম্পর্কেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
স্তর, শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত শিক্ষাক্রম
প্রাথমিক স্তরের প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত শিক্ষাক্রম বর্ণনায় শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক নির্দিষ্ট ক. উদ্দেশ্যাবলি, খ. বিষয়বস্তু, গ. শিক্ষার উপকরণ, ঘ. শিক্ষকের কাজ, ঙ. শিক্ষার্থীর কাজ, চ. মূল্যায়ন কৌশল ও ছ. পাঠ্যপুস্তক লেখকের জন্য নির্দেশনা বর্ণনা করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের তিনটি উপস্তরের (নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ) বিস্তারিত শিক্ষাক্রম বর্ণনায় শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যাবলি, বিষয়বস্তু, শিক্ষার উপকরণ, মূল্যায়ন কৌশল এবং পাঠ্যপুস্তক লেখকের জন্য নির্দেশনা বিষয়গুলো একই রকম; কিন্তু শিক্ষকের কাজ ও শিক্ষার্থীর কাজ পৃথকভাবে না রেখে ‘শিক্ষা-পদ্ধতি’ (Teaching-Learning Method) শিরোনামে বর্ণনা করা হয়েছে।
এ শিক্ষাক্রমে বিষয় ও পাঠের উদ্দেশ্যগুলো পরবর্তী আবর্তনের শিক্ষাক্রমের মতো আচরণিক (Behavioral) আকারে লেখা ছিল না। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পাঠ শেষ করে শিক্ষার্থী কী কী করতে পারবে (যেমন-লিখতে পারবে, বলতে পারবে, বিশ্লেষণ করতে পারবে, মূল্যায়ন করতে পারবে), সে আকারে লেখা হয়নি; লেখা হয়েছে সাধারণভাবে কী জানবে, শিখবে, বুঝবে আকারে। যেমন-শব্দের শুদ্ধ বানান জানবে, গরিব-দুঃখীদের প্রতি সদয় আচরণ করতে শিখবে, আলোর উৎস ও ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও ধারণা লাভ করবে।
দ্বিতীয় আবর্তন (১৯৯১-৯৫) থেকে শিক্ষাক্রমে ব্যবহৃত ‘শিখনফল’ (Learning Outcome) শব্দটিও প্রথম আবর্তনের এই শিক্ষাক্রমে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ এ শিক্ষাক্রম ফলাফলভিত্তিক (Outcome-based) আকারে প্রণীত হয়নি। শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলি লেখা হলেও উদ্দেশ্যগুলো আচরণিক আকারে লেখা হয়নি বলে এ শিক্ষাক্রমকে উদ্দেশ্যভিত্তিক (Objective-based) না বলে বিষয়বস্তুভিত্তিক (Content-based) বলাই শ্রেয়।
লক্ষণীয়, আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে স্বাধীন দেশে প্রথম প্রণীত এ শিক্ষাক্রমেই শিক্ষার্থীর মানসিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন, সৃজনশীলতার বিকাশ, জ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সুদক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীর মেধা ও প্রবণতা অনুসারে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাকে বিশিষ্ট পেশার জন্য প্রস্তুত করা শিক্ষার উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। নীতি হিসাবে কর্মমুখী ও জীবনমুখী শিক্ষার কথাও বলা ছিল। সুতরাং এ বিষয়গুলোকে বর্তমানে পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রমে নতুন সংযোজনের দাবি ধোপে টেকে না।
প্রথম আবর্তনের এ শিক্ষাক্রম পরবর্তী সব আবর্তনের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মূলভিত্তি হওয়ায় সাত খণ্ডে প্রকাশিত এ দলিলগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা প্রয়াত শিক্ষাক্রম গুরুকে সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে পারি।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক, প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
asmolla@ymail.com