Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

নেতাকর্মী ও আত্মীয়দের দৌরাত্ম্য

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নেতাকর্মী ও আত্মীয়দের দৌরাত্ম্য

ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক ভালো ভালো ঘটনা দেখার যেমন সৌভাগ্য হয়েছে, তেমনই মন্দ ও দুঃখজনক ঘটনা প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতাও আছে। ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষের জীবন। মানুষ হিসাবে ভালো ও মন্দকে মেনে নিয়েই আমাদের জীবনযাপন করতে হয়। সমাজে অস্থিরতা আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে, যা দেখে চিন্তিত না হয়ে পারা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সমাজে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। একশ্রেণির ক্ষমতাধর মানুষের আচরণ সমাজকে অস্থির করে তুলছে। ক্ষমতা এমনই এক সম্মোহনী শক্তি, যা অনেককেই অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতা যখন একচ্ছত্র হয় এবং কোনো একক গোষ্ঠী যদি কুক্ষিগত করে রাখে, তাহলে তো কথাই নেই। তখন এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কাই থাকে বেশি। এমনই অপপ্রয়োগের একটি শিষ্টাচারবর্জিত ঘটনা ঘটেছে গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে। দেশের প্রবীণ প্রকৌশলী ম ইনামুল হক ক্ষমতাসীন দলের এক কর্মীর হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও হামলার শিকার হয়েছেন। নিজ দলের পক্ষে প্রচারপত্র বিতরণ করতে গেলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জানা যায়, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় সহ্য করতে না পেরে ক্ষমতাসীন দলের ওই কর্মীটি প্রকাশ্যে সবার সামনে প্রবীণ ইনামুল হকের গালে কষে এক থাপ্পড় মারেন। ইনামুল হক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়া হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সমাজের পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব নিয়ে বেশি কথা বলাও নিরাপদ নয়। সরকারের সমালোচনার জন্য এ ধরনের হামলার ঘটনা দেশে এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। দেখা গেছে, যারা মানুষের মতপ্রকাশে বাধা দেয়, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনের আওতার বাইরে থেকে যান; অর্থাৎ তারা একধরনের দায়মুক্তির সুযোগ ভোগ করেন। আর যারা মতপ্রকাশ করেন, তারা এ ধরনের হামলার শিকার হন। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে তারা উলটা মামলার শিকারও হয়ে থাকেন।

আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি, ম ইনামুল হককে যিনি শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করেছেন, তিনি আর কেউ নন; মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়নের কৃষক লীগের সভাপতি বানি আমিন। বানি আমিন ইনামুল হককে লাঞ্ছিত করার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে যোগ দিতে এসে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ম ইনামুল হককে সরকারবিরোধী লিফলেট বিলি করতে দেখে বানি আমিন ক্ষুব্ধ হন। ইনামুল হককে লিফলেট বিলি বন্ধ করে সেখান থেকে সরে যেতে বলার পরও তিনি স্থান ত্যাগ না করে লিফলেট বিলি করতে থাকলে বানি আমিন ইনামুল হককে শায়েস্তা করার জন্য তার গায়ে হাত তোলেন। এমন একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর পরও বানি আমিনের বিরুদ্ধে তার দল শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনিনি। অন্তত আমি যখন এ লেখা লিখছি, তখন পর্যন্ত তো নয়ই। বানি আমিন বহাল তবিয়তেই তার দলীয় পদে অবস্থান করছেন।

ম ইনামুল হককে প্রকাশ্যে বেইজ্জতি করার একই দিন রাত ১০টায় ঢাকার গুলশানে ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্যের পুত্র আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। গুলশান-২-এর কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগ কার্যালয়ের ফটকের সামনে ভোলা-৩ আসনের সংসদ-সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরীর পুত্র ইন্তেশার চৌধুরীর গাড়ি ট্রাফিক পুলিশের একটি গাড়িকে ধাক্কা দেয়। ফলে পুলিশ গাড়িটি আটক করে। তাতে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সাংসদপুত্র ইন্তেশার চৌধুরী গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সাংসদপুত্র পুলিশ সদস্যদের মারধর শুরু করেন। পুলিশ সদস্যরাও উলটা তার ওপর চড়াও হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পুলিশ সদস্যরা মারধর করার দায়ে ইন্তেশারকে আটক করেন এবং গুলশান থানায় নিয়ে যান। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ইন্তেশারের পরিচয় জানার আগে তার বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু পরিচয় জানার পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। তবে রাতভর সাংসদপুত্রকে থানায় বসিয়ে রেখে রোববার সকালে ছেড়ে দেন। অবাক করার বিষয় হলো, ঘটনা জানার পর সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে পুলিশের গুলশান বিভাগের সদস্যরা জানান, ‘এটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ঘটনাস্থলেই মীমাংসা হয়ে গেছে। কথিত ঘটনায় যদি অভিযুক্ত সাংসদপুত্র না হয়ে দেশের সাধারণ কোনো নাগরিক হতেন; পাঠক একবার কল্পনা করে দেখুন-তাহলে ওই ব্যক্তির কী দশা হতো! ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষরা বুঝি এভাবেই পার পেয়ে যান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনীতিবিদ এবং তাদের ঘনিষ্ঠ অনেককেই এমন সুবিধা আদায় করতে দেখা যায়।

এখানে প্রাসঙ্গিক আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সরকারি দলের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যরে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। সরকারি দল সম্ভবত এ একটি অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের নানা ধরনের অপকর্ম বন্ধ করতে পারছে না। ইতঃপূর্বেও দেখা গেছে, ফৌজদারি অপরাধ করেও উঁচু মহলের বদান্যতায় অনেকেই পার পেয়ে গেছেন। তাতে তারা শুধু আশকারাই পেয়েছে এবং নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা এখানে উল্লেখ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। বেলাব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খাদ্য সরবরাহসহ তিন ক্যাটাগরিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অন্য ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একাধিক দরপত্র জমা দেয়। দরপত্র ছাত্রলীগের পক্ষের ঠিকাদারের অনুকূলে না যাওয়ার কথা শুনে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন অপু ও সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার তৌফিকের নেতৃত্বে তাদের অর্ধশতাধিক সহযোগী হামলা চালায় এবং হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা, দরজা-জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। হামলার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাদান বন্ধ করে দেন। হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে তারা হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন করেন। এমন একটি গর্হিত কাজ করার পরও থানায় কোনো মামলা হয়নি। ছাত্রলীগের অপরাধী সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা হলো, সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে ঘটনার মীমাংসা। ১৮ নভেম্বর সকালে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি বেলাব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত হয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে সালিশ মীমাংসা করে দিয়েছেন। এ ঘটনায় অপরাধী যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বদলে অন্য কেউ হতো? তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তা বলাই বাহুল্য।

ওপরের ঘটনার আরও এক মাস আগের আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্মম নির্যাতনে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হয়েছিলেন। তার স্মরণে ছাত্র অধিকার পরিষদ ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক স্মরণসভার আয়োজন করে। সে স্মরণসভায় ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা চালিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের ১৫ নেতাকর্মীকে আহত করে। হামলার শিকার হয়ে আহত নেতাকর্মীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে পুলিশের সম্মুখেই ছাত্রলীগ আবার তাদের মারধর ও হেনস্তা করে। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা আহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে উলটা ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৪ নেতাকর্মীকে গাড়িতে তুলে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। পরদিন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ দুটি মামলা দিলে পুলিশ তাদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করে। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ২০ অক্টোবর আদালত এক শুনানিতে ছাত্র অধিকার পরিষদের হতভাগ্য সভাপতি আকতার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসেনের একদিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন। ছাত্র অধিকার পরিষদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা, গ্রেফতার, মামলা ও রিমান্ড-এসব কিছু নিয়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে-দেশে আইন কি সবার জন্য সমান? এটি এখন স্পষ্ট যে, মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কত অসহায়। নাগরিকদের যারা নিরাপত্তা দেবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে যারা সাহায্য করবে; তাদের এ পক্ষপাতমূলক ভূমিকা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে? এ একটি ঘটনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্য সবাই রাজনৈতিকভাবে কতটা প্রভাবিত!

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি এবং জবাবদিহির অভাবে একশ্রেণির মানুষ এমন অনেক সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। মন্ত্রীর আত্মীয় বলে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করা যায়। হত্যাচেষ্টার মামলার অভিযুক্ত হয়েও রোগী সেজে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশ ছাড়া যায়। সংসদ-সদস্যের সন্তান হলে মাতাল হয়ে গুলি করে হত্যাও করা যায়। আইনের শাসনের অভাব সমাজকে বুঝি এভাবেই কলুষিত করে। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকেন; তারা মনে করেন, আইন-আদালত বুঝি তাদের জন্য নয়। প্রশাসনও তাদের সহযোগী হয়। এমন পরিস্থিতি শুধু বর্তমানেই নয়। অতীতেও ক্ষমতাসীনরা অনৈতিক সুবিধা ভোগ করে গেছেন। এমন চর্চা সব রাজনৈতিক সরকারের আমলেই ছিল। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারা ক্ষমতার দাপট দেখান। প্রশ্ন হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? রাজনীতি যখন রাজনীতিকদের হাতে থাকে না, অর্থবিত্তের মালিকরা যখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, দেশ তখন আর নৈতিকতার ওপর ভর করে চলে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও যখন এ অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করে চলে, তখন অসহায়বোধ করি বৈকি।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম