শত বাধা পেরিয়ে অগ্রগতির পথে নারী

রুকাইয়া সাওম লীনা
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৮ মার্চ পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান কতটা সুদৃঢ় হয়েছে, বাধা পেরিয়ে নারী কতটা এগিয়েছে-এ নিয়ে দু’জন নারীনেত্রী ও একজন সমাজবিজ্ঞানীর মুখোমুখি হয়েছিল সুরঞ্জনা। বিস্তারিত- রুকাইয়া সাওম লীনা
আমাদের দেশে নারীর চমৎকার অগ্রগতি হয়েছে: ডা. ফাওজিয়া মোসলেম
: প্রতি বছর আমরা আয়োজন করে নারী দিবস পালন করি। আমাদের দেশে আসলে নারীর অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে বলে মনে করেন?
* আমাদের দেশে নারীর চমৎকার অগ্রগতি হয়েছে। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে নারীর নিজের একটি আত্মপরিচয় বা সামাজিক অবস্থান তৈরি করার আগ্রহ জন্মেছে। এটাকেই বড় অর্জন বলে আমরা মনে করি। সামগ্রিকভাবে সব নারীর মধ্যেই এ জাগরণটা সৃষ্টি হয়েছে। তার একটা আত্মপরিচয় তৈরি হোক এবং সে একজন মানুষ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। এ আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি হয়েছে। আর নারী দিবসকে কেন্দ্র করে যে নারী আন্দেলন বিকশিত হয়েছে তা থেকে এ অগ্রগতি সৃষ্টি হয়েছে।
: বাংলাদেশ বা সারা বিশ্বের নারীর সমস্যা কি একই রকম মনে করেন?
* বিশ্বজুড়ে নারীর প্রধান সমস্যা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা। এ সমস্যা সারা বিশ্বের নারীর সমস্যা। শুধু বাংলাদেশের নারীর নয়। নারীর প্রতি সহিংসতাকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে করোনাপরবর্তী নারীর প্রতি সহিংসতার যে অবস্থা হয়েছিল তা এখনো চলমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা তার কমবেশি সীমাবদ্ধতা সব দেশেই আছে। রাষ্ট্রের এ দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে রাষ্ট্র আসলে যথেষ্ট কাজ করছে না। এ দুটি সংকট নারীর অগ্রগতির পথে বিশেষ বাধা বলে বিশ্বব্যাপী চিহ্নিত।
: আপনাদের দীর্ঘ আন্দোলনে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলাতে পেরেছেন বলে মনে করেন
* নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু আমাদের যে সামাজিক প্রথা, যা আমাদের সমাজের গভীরে আছে সেসবের আসেলে খুব একটা পরিবর্তন না হওয়ার ফলে পুরুষের যে সীমিত পরিবর্তন হয়েছে সেটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমাদের সামাজিক প্রথা, আইন ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা মূলত কোনো পরিবর্তন দেখতে পারছি না। একেবারেই যে পরিবর্তন হয়নি তা নয়, কিছু পরিবর্তন তো হয়েছে। সেটা খুব দৃশ্যমান হচ্ছে না। মূলত প্রথা ও আইনের জন্যই পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে না।
: নারী অগ্রযাত্রায় কোন বিষয়টিকে প্রধান বাধা বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রগতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা হচ্ছে প্রধান বাধা। এ ছাড়া আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীকে সম্পৃক্ত না করার প্রবণতা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর অংশীদারত্ব স্বীকার না করা। সমাজের যে ক্ষমতার যে অংশীদারত্ব, সম্পদ ও সম্পত্তিতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
: আপনাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন পর্যন্ত কোন অর্জনকে সেরা অর্জন মনে করেন?
* নারীর মধ্যে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে সেটা একটা অর্জন। অনেক নারীবান্ধব আইন পাশ হয়েছে এটা একটা অর্জন। যা নারীর অগ্রগতিতে সহায়ক হচ্ছে। নারীকে এগিয়ে নিতে যে বৈশ্বিক নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে এটাও নারী আন্দোলনের একটি অর্জন।
: নারীর জন্য কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন?
* নারীর জন্য গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি আগামীর বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি। নারীর জন্য একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজের খুব প্রয়োজন। নারীরা যেন স্বাধীনভাবে তাদের কাজকর্ম করতে পারে, ঘরেবাইরে, অফিস-আদালতে সর্বত্র নিরাপদে থাকতে পারে। এমন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কাম্য।
সভানেত্রী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে: ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল
: প্রতি বছর আমরা আয়োজন করে নারী দিবস পালন করি। আমাদের দেশে আসলে নারীর অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রগতি বিষয়ে আমি অনেক ইতিবাচক ধারণা পোষণ করি। যেমন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে মেয়েদের রেজাল্ট ভালো ছেলেদের তুলনায়। বড় বড় পদে বর্তমানে আমরা নারী কর্মকর্তাদের দেখি। আমাদের অথর্নীতির বড় চালিকাশক্তি হলো পোশাকশিল্প, যার প্রধান কর্মীই হলো নারী। কাজেই সর্বস্তরে নারী ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেছে। যেভাবে বেগম রোকেয়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সাধিত হয়েছে ও হচ্ছে।
আসলে প্রতিদিনই নারী দিবস। কারণ নারীই তার সংসার থেকে শুরু করে কর্মজীবনেও প্রবল প্রতাপে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে আমরা নারী দিবস পালন করি ওইদিন নারীকে আলাদাভাবে স্মরণ করার জন্য। আমিসহ আমার সহকর্মী ও আশপাশে নারীরা এই দিনে যখন বেগুনি পোশাক পরে নিজের কথা বলে বা জানায়, আমার কাছে সেটাকে অগ্রগতিই মনে হয়। অনেক পুরুষকেও বেগুনি পোশাকে দেখি, যা দেখে বোঝা যায় দিবসটি মানুষকে নারী ও তার অধিকার বিষয়ে সচেতন করছে। যদি রুট লেভেলেও নারী দিবসকে পালন করতে উৎসাহিত করতে পারতাম তবে তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করত বলে আমি মনে করি।
: নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন?
* বিগত দশ বছরের সঙ্গে যদি তুলনা করি তবে বলা যায় নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। দশ বছর আগে নারীর কাজে পুরুষ যেভাবে বাধা সৃষ্টি করত, তা এখন কমে গেছে। পুরুষ অনেক ক্ষেত্রে নারীকে উৎসাহিত করছে। যেমন স্বামী-স্ত্রী দুজন কর্মজীবী হলে, স্ত্রী বাসায় ফিরে সব কাজ একা করবে, এটা যে ঠিক নয় সে বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। এখন অনেকেই দুজন দুজনকে সাহায্য করছে যা খুবই ইতিবাচক। নারী সংসারে তার মতামতের মূল্যায়ন পাচ্ছে, তার উপার্জিত অর্থে তার অধিকার জন্মাচ্ছে। নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে এটা একটা বিশাল অর্জন। একদম ওপর লেভেল থেকে শুরু করে বস্তিতেও এর চর্চা দেখতে পাচ্ছি। নারী এখন নিজের অধিকার পেতে দরকষাকষি করতে পারে। এক সময় কারও দুমেয়ে থাকলে সংকোচ করত বলতে, এখন খুব গর্ব করে বলে যে তাদের দুমেয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি অনেক পরিবর্তন হয়েছে সামনে আরও পরিবর্তন হবে। তবে সেজন্য নারীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। নারীকে মনে রাখতে হবে সেও একজন মানুষ, তারও ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। তার নিজেকে একটু সময় দিতে হবে, নিজের জন্য একটু গান বা কবিতা শোনা। নিজের জন্য সাজগোজ করা। একটু হাঁটল, আউটিং-এ গেল। সেটা গার্লস আউটিংও হতে পারে। বন্ধুদের সঙ্গে একটু সময় কাটাল। সর্বোপরি নিজেকে একটু সময় দিল। যেটা একটা নারীর মানসিক বিকাশে খুব প্রয়োজন। নারীকে বুঝতে হবে যে, সে একজন পূর্ণ মানুষ। তাকে নিজেকে সেভাবে ট্রিট করতে হবে।
: নারীর অগ্রযাত্রায় কোন বিষয়টিকে প্রধান বাধা বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রগতির প্রধান বাধা হচ্ছে যদি সে শিক্ষার সুযোগ না পায়। আর আছে পারিবারিক বাধা। পরিবার সঙ্গে থাকলে নারী সব বাধা অতিক্রম করে সামনে এগোতে পারে। এ ছাড়া আছে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া।
: আমাদের দেশে বা সমাজে এখন পর্যন্ত কোন অর্জনকে নারীর জন্য সেরা অর্জন বলে মনে করেন?
* একজন নারী যখন সমাজ ও পরিবারে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে বা অর্জন করতে পারে তবে সেটাই নারীর বড় অর্জন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তিও পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বীকৃতি দেয়, যা আরেকটি বড় অর্জন।
: নারীর জন্য আগামীতে কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন?
* সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র হোক আমাদের আগামীর বাংলাদেশ এটাই প্রত্যাশা। যেখানে নারীরা মানুষ হিসাবে গণ্য হবে।
সমাজবিজ্ঞানী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি
কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তবে সামগ্রিক পরিবর্তন হয়নি: গীতা দাস
: প্রতি বছর আমরা আয়োজন করে নারী দিবস পালন করি। আমাদের দেশে আসলে নারীর অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রগতি শতকরা হিসাবে কতটুকু হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে অগ্রগতি তো অবশ্যই হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে। যেমন কর্মক্ষেত্রে বা রাজপথে যে আমরা নারীকে দেখতে পাই তাই অগ্রগতির সূচক।
: বাংলাদেশ বা সারা বিশ্বের নারীদের সমস্যা কি একই রকম মনে করেন?
* দেশ কাল পাত্রভেদে নারীর সমস্যার পার্থক্য রয়েছে। জার্মানির নারীর সমস্যা ও আমাদের কোনো গ্রামের নারীর সমস্যা এক নয়।
: আপনাদের দীর্ঘ আন্দোলনে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলাতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রযাত্রায় পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি না বলে তাকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বলব আমি। কারণ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি আলাদা করতে চাই না। অনেক নারীবাদী পুরুষও আছে। তাই বলা যায় নারীর অগ্রযাত্রায় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলেছে। আমি বলব দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই অনেকটা বদলেছে। তবে এখনও অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি নারীর এই অগ্রযাত্রাকে পেছনে টানছে।
: নারী অগ্রযাত্রায় কোন বিষয়টিকে প্রধান বাধা বলে মনে করেন?
* নারীর অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় বাধা মনে করি তার শরীর নিয়ে ভাবনা, নারীকে একটা শরীরসবর্স্ব প্রাণী ভাবা। নারীকে যতদিন মানুষ না ভেবে শরীরসবর্স্ব প্রাণী ভাবা হবে, ততদিন নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়।
: আপনাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন পর্যন্ত কোন অর্জনকে সেরা অর্জন মনে করেন?
* কোনো সুনির্দিষ্ট অর্জনকে সেরা অর্জন বলতে চাই না আমি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তবে সামগ্রিক পরিবর্তন হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, একটা আইন পাশ হয়েছে, আমরা এচিভমেন্ট ধরে নিয়েছি, কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন নেই। কাজেই সামগ্রিকভাবে কোনো অর্জন আসেনি। খুচরাভাবে টুকটাক অর্জন হয়েছে।
: নারীর জন্য কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন?
* আমার প্রত্যাশা হলো কোনো সুন্দরী নারী অনেক অলংকার পরে মধ্যরাতে কোনো নির্জন পথে নির্ভয়ে চলাচল করতে পারে, আমি একটা সে রকম বাংলাদেশ চাই, ধন্যবাদ।
সভানেত্রী, নারীপক্ষ