বিবিসির প্রভাবশালী নারীর তালিকায় কুড়িগ্রামের লুৎফা
আহসান হাবীব নীলু
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি ২০২৪ সালের বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জাগানো এবং প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার রিকতা আখতার বানু লুৎফা। তিনি পেশায় নার্স এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সারা দেশে প্রশংসিত হয়েছেন। জলবায়ুকর্মী, সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া, রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি এবং বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি এ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ১০০ নারীকে তালিকায় বেছে নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের রিকতা আখতার বানু। বিবিসির এ তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এমন সব নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে, যারা তাদের কঠিন পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।
রিকতা আখতার বানু সম্পর্কে বিবিসি বলেছে, তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করেন। সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিশাপ হিসাবে দেখা হয়। রিকতা আখতার বানুর মেয়ে অটিস্টিক। মেয়েটি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। রিকতা তার এ মেয়েকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তিনি তার জমি বিক্রি করে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
রিকতা আখতার বানু (৫২) পেশায় সিনিয়র স্টাফ নার্স। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের কোলঘেঁষা রমনা সরকারপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঠাঁই হয়নি তার বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ের। তাকে স্কুল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বিদায় করে দিলে জেদ চেপে বসে রিকতার। নিজেই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের কর্মস্থল থেকে ফিরে রিকতা প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিদিন সময় দেন। তার গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ২৯৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
রিকতা আখতার বলেন, ‘সঙ্গী-সাথিদের স্কুলে যেতে দেখে মেয়ে কান্নাকাটি করত। নিজেই নিজের হাত-পা কামড়াত। একসময় মেয়ের সারা শরীর ক্ষতে ভরে গেল। সেই ব্যথায় মেয়ে রাতে ঘুমাতে পারত না। চিল্লাচিল্লি করে আমাদের ঘুম হারাম করে দিত। মেয়ের এমন কষ্ট দেখে একবার নিজেই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। পরে মনে হলো, আমি নার্স। আমি আমার ও সমাজের সব প্রতিবন্ধী শিশুর সেবায় জীবন উৎসর্গ করব। এরপর এ স্কুল চালু করি।’
২০০৯ সালে রমনা সরকারপাড়া গ্রামে দোচালা টিনের একটি ঘরে ৬৩ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে চালু হয় স্কুলটি। স্কুলের জন্য তার স্বামী আবু তারিক আলম ২৬ শতক জমি দান করেন। কিন্তু শিক্ষক পাচ্ছিলেন না। প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ পড়াতে চাইতেন না। পরে তার ব্যাকুলতা দেখে দেবর পড়াতে রাজি হন। আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় শুরু করেন। এখন সেই স্কুলে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৯৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
কুড়িগ্রাম সদর থেকে চিলমারী নদীবন্দরে যেতে রমনা রেলস্টেশনের বিপরীতে কাঁচা সড়কের পাশে টিন দিয়ে ঘেরা স্থাপনায় একটি লোহার ফটক। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’। ভেতরে ঢুকে ডান দিকে আধাপাকা ভবন পাওয়া গেল। সেটিতে পাশাপাশি নয়টি শ্রেণিকক্ষ। বিপরীত পাশে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ ও শিক্ষক মিলনায়তন। শিশুদের বিশেষভাবে শেখানোর জন্য ও ব্যায়াম করার জন্য টিনের একটি ঘর রয়েছে। তবে সেখানে তেমন কোনো সামগ্রী নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকের মাঠে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার রান্না হচ্ছে। রিকতা নিজেই রান্নার তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যালয়ের একপাশে অভিভাবকদের বসার স্থান। অভিভাবকদের অনেকেই বিদ্যালয়ে এসেছেন সম্প্রতি আলোচিত বিশ্বের প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারী রিকতা আখতারকে নতুন করে দেখতে।
এ সময় কথা হয় প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোস্তফার মা মোর্সেদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের দুই মেয়ে ও এক ছেলে প্রতিবন্ধী। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চেয়েছিলাম। স্যারেরা ভর্তি নেননি। পরে রিকতা আপার এ স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। সকালে ভ্যান গাড়ি গিয়ে বাসা থেকে শিশুকে নিয়ে আসে। আবার বিদ্যালয় ছুটির পর বাসায় পৌঁছে দেয়।’
বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় যখন রিকতা আখতার বানুর নাম নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলছে তখন রিকতা বানু স্বপ্ন দেখছেন তার বিদ্যালয়টি কবে আবাসিক হবে। এসব প্রতিবন্ধী শিশুরা দূর-দূরান্ত থেকে আসে, কবে তিনি এসব শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার দিতে পারবেন।
রিকতা বলেন, ‘এখনো আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের বৈষম্যের চোখে দেখা হয়। সমাজ থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য যেদিন শেষ হবে, এসব শিশুরা যেদিন স্বাভাবিকভাবে সমাজের সবার সঙ্গে হাসিমুখে চলাফেরার সুযোগ পাবে, সেদিন একজন প্রতিবন্ধী মা হিসাবে আমার যুদ্ধের শেষ হবে।’