Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

প্রতিভা

নিভৃতচারী চিত্রশিল্পী লুৎফা মাহমুদা

Icon

সেলিম কামাল

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নটা দানা বেঁধেছিল ছোটবেলা থেকেই। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পেনসিলে আর কাগজে যে সখ্য গড়ে উঠেছিল, তার ছোট্ট মানসপটে ভেসে ওঠা ছবিকেই ফুটিয়ে তুলতেন কাঁচা হাতে। সেই হাত বড় হয়ে দক্ষ একজন চিত্রশিল্পীর মতো হবে, বুঝতে পারেননি লুৎফা মাহমুদা নিজেও। তার বাবা মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, একদিন এ মেয়ে ছবি এঁকে ঠিকই সাধারণ মানুষের মন রাঙাবে। রাঙাচ্ছেনও তিনি। জলরঙে ফুটিয়ে তুলছেন প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্কের অপূর্ব মেলবন্ধন।

বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে এইচএসসি পাশ করার পরই চলে যান শান্তিনিকেতনে। সেখানে গ্রাফিক আর্টসে পড়াশোনা করে পেইন্টিংসের ওপর কাজ করা শুরু করেন। পেশাগতভাবে পেইন্টিংসকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। বেশ কিছু বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করে বাড়িয়ে তোলেন আত্মবিশ্বাস। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পেইন্টিংস নিয়ে ঘুরেছেন নানা দেশে। পরিচিত হয়েছেন সেসব দেশের চিত্রকর্ম আর সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে। সব দেখেশুনে তিনি এখন সফল, পেশাদার নিভৃতচারী একজন চিত্রশিল্পী।

শান্তিনিকেতন থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বাংলাদেশে ফেরার পর থেকে পেশার শুরু এবং এর বিস্তৃতি অনেকটা গল্পের মতো। শুরুতেই তিনি পেইন্টিংসের কাজ পেলেন দেশের নামি একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে। দেশে দিতে থাকলেন একের পর এক চিত্রপ্রদর্শনী। এসব প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তিনি মূলত বাংলাদেশে শিল্পী হিসাবে লুৎফার পরিচিতি বাড়তে থাকে। এরপরই চিত্রকর্ম নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে তার সফল পদচারণা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে পাঠানো হলো উজবেকিস্তানে। সেখানে একক চিত্রপ্রদর্শনীর পাশাপাশি সেখানকার একাডেমি অব আর্টস তাসখিন্দের মাস্টার্স পর্বের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছেন তিনি। সেখানে এশিয়ান আর্ট হিসাবে লুৎফার চিত্রকর্ম সংরক্ষণ করা হয়। এরপর একে একে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, থাইল্যান্ডে তার প্রদর্শনী দর্শকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। সর্বশেষ থাইল্যান্ডের চাংমাইয়ের প্রদর্শনীটি ছিল ব্যতিক্রম। লুৎফা বলেন, ‘এখানে আমি শহুরে ইট-পাথুরে কঠোর জীবনের ওপর পেইন্টিংস নিয়ে কাজ করেছি।’

সর্বশেষ দেশে তার প্রদর্শনীটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে। সেখানে ১৫ জন বিদেশি এবং ১৫ জন বাংলাদেশি শিল্পীর কাজ নিয়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনীতে। লুৎফা বলেন, ‘আমি মনে করি, একজন আর্টিস্ট যখন পড়াশোনা শেষের পর কাজ শুরু করে-তখন তার আর্টপ্রজেক্ট যেমন করা উচিত, ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত অনুশীলনও চালিয়ে যেতে হবে। শুধু বাসায় বসে আর্ট প্র্যাকটিস করলে তার সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটা খালি পড়ে থাকে। এমনকি আর্টপ্রজেক্ট যখন তিনি করেন, শিল্প সমাজে তার অবদান রাখতে পারে। সিনিয়রদের সঙ্গে তিনি তার কনসেপ্টগুলো ভাগাভাগি করতে পারেন। এতে তার সামাজিক যোগাযোগটাও বাড়ে। তিনি শিখতেও পারেন। এ কারণেই আমি বিশ্বাস করি, একজন আর্টিস্টের উচিত আর্টপ্রজেক্ট এবং বাসায় আর্ট প্র্যাকটিসটা পাশাপাশি চালিয়ে যেতে হবে।’

একজন শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটা কোথায়? এ প্রসঙ্গ এলেই লুৎফা বলেন, ‘সাধারণত মানুষ মনে করেন আর্ট একটা এন্টারটেইনমেন্ট টাইপের ব্যাপার। অথচ এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়। কারণ, বরাবরই আর্ট একটা ঐতিহ্য। গুহাচিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে যায়, সে সময়ের মানুষের জীবন কেমন ছিল। এ রকম অনেক চিত্রকর্ম আছে, যেগুলো সময়ের ঐতিহ্য কিংবা স্মারক হিসাবে টিকে থাকবে যুগযুগ ধরে। তার মানে, এমন চিত্রগুলো সভ্য সমাজের জন্য একটা বড় সম্পদও। যে কোনো দেশে গেলে আমরা আগে আর্ট কালচারটাকেই দেখি। কারণ, শিল্প বা চিত্রকর্ম স্ব-স্ব দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে।’

পেশাগতভাবে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পেয়ে যাচ্ছেন লুৎফা মাহমুদা। সংশ্লিষ্ট প্রজেক্টগুলো থেকে ভালো আয় করছেন, তার পেইন্টিংসগুলো ভালো ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে, বিদেশে পেইন্টিংস বিক্রি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও দেশকে এনে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পেশাগত দিক থেকে যথেষ্ট স্যাটিসফাইড, হ্যাপি।’

একজন নারী চিত্রশিল্পী হিসাবে কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন? এমন প্রশ্নের বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দিয়েছেন লুৎফা। তিনি বলেন, ‘সে ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা আমার জীবনে আসেনি। আমি নারী কিংবা পুরুষ, শিল্পীকে এভাবে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যোগ্যতা দিয়েই মানুষকে বড় হতে হয়। যার-যার অবস্থান শক্ত করতে হয়। তবে হ্যাঁ, আপনার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, এ পেশায় পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কারণ, নারীরা সাংসারিক দিক সামলাতে গিয়ে প্র্যাকটিসটাকে সেভাবে চালিয়ে যেতে পারেন না। একটা সময় হারিয়ে যান। দেখা গেছে, কেউ কেউ বাচ্চা-কাচ্চা বড় হওয়ার পর আবার ক্যারিয়ারটাকে শুরু করতে চান। কিন্তু একটা লম্বা সময় গ্যাপের পর আবার নতুন করে শুরু করাটাও বিশাল চ্যালেঞ্জ।

পেইন্টিংস নিয়ে লুৎফা মাহমুদার বিশেষ স্বপ্নের জায়গাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং। তিনি বলেন, ‘আমি বরাবরই চেয়েছি, পেইন্টিংস নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বাঁকবদল করা। পেইন্টিংসটাকে যারা শুধু সুদৃশ্যমান কোনো চিত্র ভেবে থাকেন, তারা ভুল করেন, তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বদলাতে হবে। পেইন্টিংসটা একটা ঐতিহ্যও-সেটা বোঝানোর জন্য আর্ট-অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কথা বলা জরুরি। আমি চাই, আর্টিস্টদের কথা বলার মতো সে রকম একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হোক। আমার স্বপ্নের জায়গাটাও এখানেই। কখনো যদি আমার এমন সুযোগ আসে, আমি জুনিয়র-সিনিয়র আর্টিস্টদের নিয়ে সে রকম একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য মুখিয়ে থাকব।’

দূরবর্তী কোনো স্বপ্ন নেই লুৎফা মাহমুদার। ভবিষ্যৎ পরিবর্তনশীল। এ কারণে, বর্তমান নিয়েই বাঁচতে পছন্দ করেন তিনি। ‘তবে’, তিনি বললেন, ‘আমি বরাবরই একজন ভালো শিল্পী হতে চেয়েছি। সেই স্বপ্নকে লালন করেই এখনো শিখছি, কাজ করছি। এখন পর্যন্ত জীবনে যা কিছু পেয়েছি, যথেষ্ট নয়-পাওয়ার এখনো অনেক বাকি। কখনো কখনো মনে হয়, পেয়েছি তো অনেকই। কিন্তু অ্যাচিভমেন্ট হচ্ছে একমুঠো বালির মতো। মুঠো থেকে যেমন আঙুলের ফাঁক গলে বালি পড়তে থাকে, অ্যাচিভমেন্টগুলোও তেমনি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে কিংবা হারিয়ে যেতে থাকে। এ কারণে সব সময় নতুন নতুন অ্যাচিভমেন্টের দিকে হাত বাড়াতে হবে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম