
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৩ এএম

ড. সাব্বির আহমেদ
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
সময় বা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবারই ঈদের আনন্দ কম-বেশি কমে যায়। এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। ঈদের আনন্দ ধরে রাখার কিছু কৌশল আছে-তা নিয়ে এ লেখা।
* হেডোনিক অ্যাডাপটেশন
প্রথম প্রথম যে কোনো কাজ করলে আমাদের ভালো বা খারাপ লাগার অনুভূতি জন্মায়। বারবার একই কাজ করতে থাকলে এ অনুভূতি কমে আসে। এর কারণ আমাদের ব্রেইন এ অনুভূতির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে বা অ্যাডজাস্ট করে নেয়। নতুন কোনো গেম খেললে শুরুতে যে উত্তেজনা জন্মায়, পরবর্তীতে আমাদের মনে হয় নতুন কোনো গেম খেলি। নতুন কোনো গাড়ি কিনলেও আমাদের একই ধরনের অনুভূতি বা উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে কমে আসে। ব্রেইন এভাবেই আমাদের মানিয়ে রাখে। একে হেডোনিক অ্যাডাপটেশন বলে। তবে এটি মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি। প্রাচীনকালে মানুষ পশু-পাখির মাংস খেয়ে বা গাছ-পালার ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকত। বর্তমান যুগে নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় প্রাচীনকালের মতো আমরা এখন একইভাবে মাংস বা ফলমূল খাই না। পরিবারের কারও মৃত্যু হলে আপনজনদের শুরুতে যে কষ্ট থাকে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে থাকে। এক সময় এ কষ্ট শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ছোটবেলায় ঈদের চাঁদ দেখার যে আনন্দ হতো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই চাঁদ দেখা কিন্তু সমান আনন্দদায়ক হয় না। এগুলো হেডোনিক অ্যাডাপটেশনের ফলেই হয়।
* ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ
ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার যাকে ফিল গুড হরমোন বলা হয়। এটি ভালো লাগার অনুভূতি দেয়। কোনো কাজ করলে যখন আমাদের ভালো অনুভূতি হয়, তখন বুঝতে হবে এ কাজ করার ফলে আমাদের ডোপামিনের নিঃসরণ হয়েছিল। ডোপামিন আমাদের ব্রেইনের রিওয়ার্ড সেন্টারকে চালু রাখে। এ জন্যই যে কাজ করতে আমাদের ভালো লাগে তা বারবার করতে ইচ্ছা করে। ছোটবেলায় ঈদের চাঁদ দেখা, সালামি আদায় করা, এই সালামি দিয়ে শপিং করতে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, কোনো কিছু কিনে খাওয়া-এসব কাজ করলে আমাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণ ডোপামিনের নিঃসরণ হতো। বড় হওয়ার পর এই একই কাজ করলে কিন্তু একই রকম আনন্দ পাই না। এর কারণ হচ্ছে শুধু ডোপামিন রিলিজ হলেই হবে না, এর কাজ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রিসেপ্টরও থাকতে হবে। ডোপামিন যখন রিসেপ্টরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় তখনই আমরা আনন্দ বোধকরি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদশকে ডোপামিন রিসেপ্টরের সংখ্যা কমে যায় শতকরা ৬-১০ ভাগ। রিসেপ্টারের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে বয়সকালে ডোপামিন রিলিজ হয় ঠিকই কিন্তু ছোটবেলার মতো আর আনন্দ পাই না।
* নস্টালজিয়া বায়াস
এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায়। আমরা যখন আগের কোনো ঘটনা স্মৃতিচারণ করি, তখন ব্রেইন চায় এ ঘটনাকে পজিটিভলি বেশি বেশি প্রেজেন্ট করতে। চোখ বন্ধ করে স্কুল জীবনের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো লাগার স্মৃতিগুলো চোখে ভেসে উঠে। কিছু ক্ষেত্রে মার খাওয়ার স্মৃতি কষ্টের স্মৃতি হিসাবে আসে না। আগের স্মৃতিকে ব্রেইন একটি ওভারহোল ইমপ্রেসন দেয়। বয়সকালে আমরা যখন বলি, ঈদ আর আগের মতো নেই; এর কারণ হচ্ছে ব্রেইনে জমা হওয়া আগের স্মৃতির সঙ্গে আমরা বর্তমান স্মৃতির তুলনা করছি। অর্থাৎ ছোটবেলার ভালো স্মৃতিগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে এখনকার ঈদের সঙ্গে তুলনা করি। এটিই নস্টালজিয়া বায়াস।
* টেম্পোরাল পারসেপশন
ছোটকালে যে কোনো সময় পেরিয়ে যাওয়া ছিল অনেক দীর্ঘ। তখন মনে হতো, অনেক অনেক দিন পরে ঘুরে আবার ঈদ আসত। অর্থাৎ এক বছর অনেক বড় সময়। বড়কালে এর উলটো ঘটনা ঘটে। এ সময় মনে হয় ঈদ যেন একটু তাড়াতাড়িই চলে আসে। এ জন্য ঈদকে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। অর্থাৎ বয়সকালে এক বছর সময় এতবেশি মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে ধরুন আমাদের আয়ুকাল ১০০ বছর। এখন আপনার বয়স ৫০ বছর। তাহলে ১ বছর সময় হচ্ছে আপনার সারা জীবনের শতকরা ২ ভাগ। অর্থাৎ ১ বছর সময় মানে আপনার জীবন শতকরা ২ ভাগ সামনে এগোচ্ছে। অন্যদিকে যার বয়স ১০ বছর তার জন্য ১ বছর সময় মানে হচ্ছে তার জীবনের শতকরা ১০ ভাগ। অর্থাৎ তার জন্য ১ বছর সময় পার হওয়া মানে তার জীবনের দশ ভাগের এক ভাগ সময় পার করে ফেলা। জীবনের ২ ভাগ অতিক্রান্তের চেয়ে ১০ ভাগ অতিক্রান্ত করা বেশি মনে হবে। এভাবে বয়স যতো বাড়তে থাকে, ততো সময় ছোট হতে থাকে। এ জন্য বয়স যত বাড়ে তখন মনে হয় সময় অতিদ্রুত চলে যায়। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত এটা বোঝা যায় না। কিন্তু চল্লিশ বা পঞ্চাশের পর থেকে এটি বেশি বোঝা যায়।
* সোশ্যাল মিডিয়া
আমরা যতো বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউস বা স্টোর করতে থাকি, ততো বেশি আমাদের ব্রেইনে প্রচুর পরিমাণে শর্টটার্ম ডোপামিন রিলিজ হয়। এর ফলে আমরা ব্রেইনকে অনেক বেশি ডোপামিন নিঃসরণ করতে অভ্যস্ত করে ফেলছি। তাই যে কাজে ডোপামিন বেশি রিলিজ হয় না সেই কাজ ব্রেইন আর করতে চায় না বা যে কাজ করতে গেলে অনেক সময় পরে ডোপামিন আসে, সেই কাজ ব্রেইন আর করতে চায় না। অর্থাৎ রিল্স দেখতে যারা অভ্যস্ত তারা লং ভিডিও দেখার ধৈর্য পায় না। ঈদের আনন্দে যে কাজগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ডোপামিন দেয় না, সেই কাজগুলো ডোপামিন এবিউস করা মানুষ আর করবে না। ছোটবেলায় যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া তেমন ছিল না, ডোপামিন এবিউস করার তেমন সুযোগ ছিল না, এ জন্য ঈদের বিষয়গুলো ছিল অনেক আনন্দের।
* কীভাবে ঈদের আনন্দকে ফিরিয়ে আনবেন
► প্রথমত হেডোনিক অ্যাডাপটেশনকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ব্রেইন আগে যে কাজ করে আনন্দ পেত, এখন তা পাচ্ছে না-এগুলো বাদ দিয়ে নতুন কোনো কাজ ঈদের দিন করতে হবে। যেমন আমাদের দুর্দাশাগ্রস্ত, অবহেলিত শিশুদের ঈদের পোশাক কিনে দেওয়া, খাবার খাওয়ানো, তাদের নিয়ে গেম শো আয়োজন করা। এগুলো আপনাদের জন্য আনন্দের হবে।
► শিশুরা ঈদকে কেন্দ্র করে যে প্ল্যান করছে, আমরা তাদের সেই প্ল্যান বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে পারি, এতে তারা যে আনন্দ পাবে, তা দেখে আপনিও আনন্দ পাবেন।
► সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা। এটি যথেষ্ট কঠিন হলেও, যতটা পারা যায় করতে হবে।
লেখক : পোস্টডক্টরাল ফেলো, উটরেস্টে ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার, সুইডেন।