আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের তেলবীজ পাওয়া যায়। যেমন-সরিষা, তিল, চিনাবাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, জলপাই, নারিকেল ইত্যাদি। এগুলো যেমন চর্বিসমৃদ্ধ, তেমনি এতে আছে প্রোটিন। চর্বি থাকার কারণেই এসব বীজ থেকে তেল বের করা সম্ভব। দু’ধরনের তেল আমরা উদ্ভিদ থেকে পাই। একটি উদ্বায়ী, অন্যটি অনুদ্বায়ী। উদ্বায়ী তেল সুঘ্রাণযুক্ত এবং খোলা রাখলে বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। কমলা লেবুর খোসা, দারুচিনি, লেবু গাছের পাতা থেকে যে তেল বের করা হয়, সেগুলো উদ্বায়ী তেল। সাধারণত কেক, বিস্কুট তৈরিতে লেমন এসেন্স, অরেঞ্জ এসেন্স ব্যবহার করা হয়। যা এ ধরনের সুগন্ধি তেল থেকে তৈরি হয়। আবার যেসব তেল উড়ে যায় না, সেগুলো অনুদ্বায়ী। এ তেলই ভোজ্য তেল। তেল খাবারের একটি অপরিহার্য উপাদান। তেলবীজ থেকে তেল বের করে নেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটা প্রোটিনসমৃদ্ধ। এই অবশিষ্ট অংশটুকু পশুখাদ্যে ব্যবহৃত হয়।
▶ সরিষা : যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে সরিষার প্রচলন হয়ে আসছে। সরিষার পাতা শাক হিসাবে খাওয়া হয়। এটি ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস। সরিষার বীজে ৪০-৪৫ শতাংশ চর্র্বি ও ২৪-২৫ শতাংশ প্রোটিন থাকে। ঘানিতে ভাঙালে ৩৩ শতাংশ তেল পওয়া যায়। মেশিন ভাঙালে পাওয়া যায় আরও বেশি। সরিষার খৈলে প্রোটিন থাকে ৪০ শতাংশ। এ প্রোটিন খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের কোনো পদক্ষেপ আজও নেওয়া হয়নি। সরিষা বাটা দিয়ে রান্না বাঙালির একটি ঐতিহ্য বহন করে। যেমন-সরষে ইলিশ, সরষে সজনে ডাটা, ছোট মাছ রান্না, নিরামিষ, কাসুন্দি, আচার, চাটনি, বোরহানি, তেহারি, খিচুড়ি, ভর্তা ইত্যাদিতে সরষে ও সরষের তেল ব্যবহার করা হয়।
▶ তিল : তিল হয় কালো রঙের। তিলে চর্বি থাকে ৪৩.৩ শতাংশ এবং প্রোটিন থাকে ১৮.৩ শতাংশ। এতে ক্যালসিয়াম, লোহা ও থায়ামিন আছে। তিলের ওপরের খোসা ফেলে দিলে ভেতরে সাদা রঙের তিল পাওয়া যায়। এটি দিয়ে নাড়ু, খাজা, পিঠা তৈরি করা হয়। তিলের তেলে জারণরোধক পদার্থ থাকার কারণে তিলের তৈরি খাবার সহজে নষ্ট হয় না। বিভিন্ন দেশে রান্নায় তিলের তেল ব্যবহার করা হয়। এটি স্বাস্থ্যসম্মত । আফ্রিকায় তিলের তেল দিয়ে শিশু খাদ্য তৈরি হয়।
▶ চিনাবাদাম : এতে ২২-২৮ শতাংশ প্রোটিন, ও ৪২-৫০ শতাংশ চর্বি থকে। এটি ভিটামিন বি, ফলিক এসিড, ভিটামিন ই এবং ফসফরাসের ভালো উৎস। চিনাবাদামের প্রধান প্রোটিন হলো গ্লোবিউলিন। এর বীজ থেকে তেল বের করা ছাড়াও চিনাবাদাম ভেজে খাওয়া হয়। বাদাম থেকে শিশুখাদ্য ও মাখন তৈরি হয়। কেক, বিস্কুট, শিঙাড়া এবং মুরগির রোস্ট তৈরিতে বাদাম ব্যবহার করা হয়। পিনাট বাটার শিশুদের জন্য খুবই পুষ্টিকর। ভগ্ন-স্বাস্থ্যের লোকদের জন্য এ বাদাম খুবই উপকারী। বিশেষ করে যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ওজন কম। তাদের খাবারে বাদামের গুঁড়া মিশিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়। বাদাম তেল অন্যান্য তেলের চেয়ে সস্তা। অ্যাকজিমা ও মেছতা দূর করার জন্য চিনাবাদাম উপকারী। তবে বাদামের ওপরের লাল আবরণসহ খেতে হবে। চিনাবাদামে আছে মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। যা হৃদরোগের জন্য ভালো। এটি বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি ঘটায়।
▶ সয়াবিন : সয়াবিন প্রোটিন সমৃদ্ধ বীজ। এতে আছে ৩৫-৪৫ শতাংশ প্রোটিন ও ১৭-২২ শতাংশ চর্বি। এটি অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এডিসের ভালো উৎস। এছাড়া আছে থায়ামিন রাইবোফ্লাভিন ও নায়াসিন। অর্থাৎ এটি ভিটামিন বি সমৃদ্ধ। সয়াবিন ডালের মতো ব্যবহার করা যায়। তেল সংগ্রহের পর এর খৈল গরু-মহিষ, হাঁস-মুরগির খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিকভাবে সয়ারুটি, সয়াবিস্কুট, সয়াবিন তৈরি করা হয়। সয়াবিনের গুঁড়া দিয়ে বিনকার্ড তৈরি করা হয়, যা দিয়ে কেক তৈরি করা সম্ভব। এ কেকের নাম টফু। এটি জাপানীদের কাছে জনপ্রিয় খাবার। অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড থাকার কারণে নিরামিষ ভোজীদের খাবারে সয়াবিন থাকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রোটিন প্রাণিজ প্রোটিনের সমতুল্য। সয়ামিল্কে আইসোফ্ল্যাবনস (প্ল্যান্ট হরমোন) শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের সমান কাজ করে, অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে। এটি বার্ধক্যের গতি মন্থর করে।
▶ সূর্যমুখী : সূর্যমুখীর বীজে ৪০ শতাংশ তেল থাকে। এর রঙ প্রায় সরিষার তেলের মতো। তবে এটাতে ইরোসিক এসিড নেই। এটি সরিষার তেলের চেয়ে উপকারী। এতে লিনোলেয়িক এসিডের পরিমাণ বেশি আছে। সূর্যমুখীর বীজ চিনাবাদামের মতো ভেজে খাওয়া যায়। এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি আর্থাইটিস প্রতিরোধে ভালো কাজ করে। সূর্যমুখীর বীজ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এতে আছে ভিটামিন ই, ভিটামিন বি। এটি মানসিক চাপ কমায়। ম্যাগনেশিয়ামের জন্য মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঠিক রাখে।
▶ জলাপাই : জলপাই ফল হিসাবে ব্যবহার হলেও, এটা থেকে তেল বের করা হয়। যা হৃদরোগীদের জন্য নিরাপদ। জলপাই রক্তের এই ভালো চর্বি বাড়াতে সাহায্য করে। এতে আছে ভিটামিন সি ও ই। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জলপাই মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। জলপাই পিত্তথলির রসে ঠিকমতো কাজ করে বলে পিত্তে পাথর হওয়ার প্রবণতা রোধ করে। জলপাই দিয়ে আচার-চাটনি তৈরি করা হয়। এটা শীতকালীন ফল।
▶ নারিকেল : নারিকেল থেকে যে তেল বের করা হয়, সেটা আমাদের দেশে রান্নায় তেমন ব্যবহার হয় না। তবে শ্রীলংকা ও কেরালায় এর ব্যবহার ব্যাপক। নারিকেল সুস্বাদু, এটি খাবারের স্বাদ বাড়ায়। এতে রয়েছে ফ্যাটি এসিড। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং এমাইনো এসিড এটি সহজে জমে যায়। মাথাব্যথার পথ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। যুগ যুগ ধরে বাণিজ্যিকভাবে চুলের তেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নারিকেলের দুধ, গরুর দুধের চেয়ে উপকারী। দেখা যায় দক্ষিণ ভারতীয়দের বুদ্ধিবৃত্তি অন্যান্যদের চেয়ে বেশি। কারণ তাদের রান্নায় নারিকেলের ব্যবহার বেশি। মস্তিষ্কের উৎকর্ষ সাধনে নারিকেলের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এটি ত্বক ও চুলকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখে। বিভিন্ন ধরনের রান্নায় নারিকেল ব্যবহার করা হয়। যেমন-চিংড়ি মালাইকারি, হাঁসের মাংস, পোলাও, মিষ্টান্ন এবং পিঠা-পায়েস ইত্যাদি।
লেখক : সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।