হৃদরোগের মহামারি ঠেকাতে করণীয়
অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বে বিভিন্ন রোগে যত মানুষের মৃত্যু হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হৃদরোগ ইদানীং বেড়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ খেয়াল না করলে তার ফলে কেবল মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকলেও অনেক জটিলতা নিয়ে বাঁচতে হয়। কিছু নিয়ম মানলেই এটি থেকে পরিত্রাণ অনেকাংশে সম্ভব। বিস্তারিত লিখেছেন অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক
বাংলাদেশে হৃদরোগের ঝুঁকি বিভিন্ন কারণে বাড়ছে। শুধু প্রচলিত ঝুঁকি ফ্যাক্টরগুলোর কারণে নয়, বরং কিছু নতুন এবং উদীয়মান ঝুঁকি ফ্যাক্টরও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
* প্রচলিত ঝুঁকি ফ্যাক্টর
▶ উচ্চরক্তচাপ (হাইপারটেনশন) : দেশের জনগণের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ একটি সাধারণ সমস্যা। উচ্চরক্তচাপ দীর্ঘমেয়াদে থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়ে।
▶ ডায়াবেটিস (টাইপ-২) : টাইপ-২ ডায়াবেটিস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এটি হৃদরোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি ফ্যাক্টর। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে শর্করা বেশি থাকায় রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা হার্টের সমস্যাকে প্রভাবিত করে।
▶ ধূমপান ও তামাক ব্যবহার : তামাক ও ধূমপান দেশে খুবই প্রচলিত, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে। এটি রক্তনালিকে ব্লক করে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, যা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু হার্টের ওপর নয়, পুরো শরীরের ওপর পড়ছে।
▶ অ্যাকটিভিটি ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা : শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং দীর্ঘসময় বসে থাকার জীবনযাত্রা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে সহায়তা করে। বসে থাকার কারণে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে এবং শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম সঠিকভাবে চলে না, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
* নতুন ঝুঁকি ফ্যাক্টর
▶ আর্সেনিক দূষণ : বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষ করে মাটির পানি এবং খাদ্যে। আর্সেনিক একটি পরিচিত বিষাক্ত পদার্থ, যা দীর্ঘমেয়াদে সেবনে রক্তনালিতে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং হার্টের সমস্যার সৃষ্টি করে।
▶ বায়ু দূষণ : ঢাকা এবং অন্য বড় শহরে বায়ুদূষণ গুরুতর একটি সমস্যা। বিশেষ করে পিএম২.৫ কণাগুলোর উচ্চমাত্রা হৃদরোগীদের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষুদ্র কণাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং সঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা সৃষ্টি করে।
▶ পুষ্টির অভাব : বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পুষ্টির অভাব সাধারণ একটি সমস্যা। বিশেষ করে ভিটামিন ডি এবং জিংকের অভাব হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পুষ্টির অভাব হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং এটি রক্তনালিরও ক্ষতি করে।
* বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসাব্যবস্থা
বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার পথচলা ১৯৭০-৮০ দশকে শুরু হয়, যখন দেশে প্রথম করোনারি কেয়ার ইউনিট (CCU) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। এ সময় থেকে হৃদরোগের চিকিৎসা আধুনিকায়নের দিকে প্রবৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে।
* বর্তমানে চিকিৎসা সুযোগ
বর্তমানে, বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রটি অনেক উন্নত হয়েছে এবং বিভিন্ন আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অন্যতম-
▶ ইসিজি : এসিজি একটি অত্যন্ত সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যা হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করে। এটি হৃদরোগের অনেক প্রাথমিক চিহ্ন শনাক্ত করতে সহায়তা করে, যেমন অ্যারিথমিয়া বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।
▶ ইকোকার্ডিওগ্রাফি : ইকোকার্ডিওগ্রাফি বা ইকো হৃৎপিণ্ডের গঠন এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ব্যবহৃত একটি প্রযুক্তি। এটি হৃৎপিণ্ডের আকার, স্তরের গতি এবং মাংসপেশির কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করতে সহায়ক।
▶ স্ট্রেস টেস্ট : স্ট্রেস টেস্ট হৃৎপিণ্ডের সঞ্চালন সক্ষমতা এবং সঠিক কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি রোগীর হৃদরোগের ঝুঁকি পরীক্ষা করতে সহায়তা করে এবং শারীরিক চাপের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়।
▶ সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি : সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি আধুনিক প্রযুক্তি যা রক্তনালির মধ্যে কোনো বাধা বা সংকোচনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে সহায়তা করে। এটি কনভেনশনাল করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফির তুলনায় অনেক নিরাপদ, এবং এটি করতে কম সময় নেয়।
* ইনভেসিভ চিকিৎসা
▶ পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (PCI) : পারকুটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (PCI) বা এনজিওপ্লাস্টি একটি ইনভেসিভ চিকিৎসা পদ্ধতি যা করোনারি আর্টারি বা রক্তনালিতে ব্লক সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
▶ করোনারি বাইপাস গ্রাফটিং (CABG) : এটি একটি সলিড এবং পরীক্ষিত সার্জিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে বন্ধ বা সংকুচিত করোনারি আর্টারি বাইপাস করা হয়। এটি গুরুতর হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে যেখানে PCI সম্ভব নয়।
▶ অন্য আন্ত্রিক অস্ত্রোপচার ইন্টারভেনশন : বাংলাদেশে আরও কিছু উন্নত আন্ত্রিক অস্ত্রোপচার এবং শল্যচিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য। এসব পদ্ধতি হৃদযন্ত্রের নানা ধরনের সমস্যা যেমন, হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্ষমতা দুর্বল হওয়া, মাইট্রাল বা অ্যাওরটিক ভালভ সমস্যা এবং অন্য রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়।
* চিকিৎসা ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ
যদিও বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসাব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, তবে চ্যালেঞ্জও আছে। এর মধ্যে রয়েছে-
▶ চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং জনবলের অভাব।
▶ উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা।
▶ শহরাঞ্চলের বাইরে চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হলেও আরও সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়নের প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এবং স্বল্প আয়ের জনগণের জন্য।
* স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ
দেশের জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত লবণ, চিনি, ও ফ্যাটের ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য খাদ্য আইন এবং নিয়মাবলি চালু করা উচিত।
▶ ধূমপান ও তামাক পরিহার : জনগণকে ধূমপান এবং তামাক পরিহার ও উদ্বুদ্ধ করতে নতুন আইন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করা উচিত।
▶ শারীরিক পরিশ্রম এবং ক্রীড়া : জনগণকে শারীরিক পরিশ্রম এবং ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা উচিত। এর মাধ্যমে শরীরের স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব, বিশেষত হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে এটি কার্যকর। সরকারি উদ্যোগে সারা দেশে ক্রীড়া ক্ষেত্রের উন্নয়ন এবং ফ্রি ফিটনেস প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
▶ বায়ুদূষণ কমানো : বাংলাদেশের শহুরে এলাকাগুলোয় বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে সহায়ক। তাই, পরিবেশগত নীতিমালা পরিবর্তন করা জরুরি। সরকারের মাধ্যমে কার্যকর নীতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন যানবাহনে ধোঁয়া নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ কার্যক্রমের শূষণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পরিদর্শন, এবং কেমিক্যাল অপচয় কমানো।
▶ শহুরে পরিকল্পনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ : শহুরে পরিকল্পনা উন্নত করে সবুজ অঞ্চল সৃষ্টি করা উচিত এবং শহরের বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি, বায়ু বিশুদ্ধকারক যন্ত্রের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা শহরকে বিশুদ্ধ রাখা একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে।
* পরিশেষে
হৃদরোগ সম্পর্কিত আরও গবেষণা করা জরুরি, যা বাংলাদেশে এ রোগের প্রকৃত কারণ এবং ঝুঁকি ফ্যাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবে। এর মাধ্যমে এ ধরনের রোগের পূর্বাভাস এবং প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব হবে, যা ভবিষ্যতে এ মহামারি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে, জেনেটিক, পরিবেশগত এবং জীবনযাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষণা আরও ব্যাপক করা উচিত। হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় নীতিমালা এবং চিকিৎসা নির্দেশিকা তৈরি করা জরুরি। এ নির্দেশিকাগুলো দেশের প্রতিটি স্তরের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অনুসরণ নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি, রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ সম্পর্কিত পরামর্শ, প্রোটোকল এবং গাইডলাইনগুলো তৈরি ও বাস্তবায়ন করা উচিত, যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা এবং জনগণ সঠিকভাবে চিকিৎসা পেতে পারে এবং এর ফলে রোগের বিস্তার কমানো সম্ভব হবে।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস, মালিবাগ, ঢাকা।