শিশুর বমির কারণ ও করণীয়
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিশু বিভিন্ন কারণে বমি করে। একেক বয়সের শিশু ভিন্ন ভিন্ন কারণে বমি করতে পারে। তাই, শিশুর বমির কারণ বিশ্লেষণপূর্বক বয়সভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। লিখেছেন অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
* নবজাতক
▶ জন্মের পরপরই যদি বমি শুরু করে তাহলে খাদ্যনালিতে জন্মগত ত্রুটি আছে কিনা নিশ্চিত হতে হবে। বমি যদি সবুজ পিত্তের রং হয় তাহলে খাদ্যনালি বন্ধ হয়ে আছে বা সরু আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
▶ জন্মের ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর যদি বমি শুরু হয় এবং সেটা যদি দূরে ছিটকে পড়ে ও বমির আগে পেটের ওপরের দিকে চাকা দেখা যায়, রং সবুজ না হয় আর বমির পরপরই বাচ্চা আবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তাহলে খাদ্যনালির জন্মগত ত্রুটি বা পাইলেরিক স্টেনসিস হতে পারে ।
▶ দুধ খাওয়ানোর পরপরই যদি বমি করে, তাহলে দেখতে হবে খাওয়ানোর পদ্ধতিতে কোনো ভুল হচ্ছে কিনা, যেমন-শোয়ানো অবস্থায় খাওয়ানো, ঢেঁকুর না তোলানো অথবা অতিরিক্ত দুধ খাওয়ানো। দেখতে হবে বাচ্চার ঘুম, প্রস্রাব ও ওজন ঠিক আছে কিনা। স্বাভাবিকভাবে একটা বাচ্চা সারা দিনে অনেকবার বমি করতে পারে যাকে প্রচলিত ভাষায় দুধ তোলা বলা হয়।
▶ শরীরে ইনফেকশনের কারণে অসুস্থ হলে বমি হতে পারে। নবজাতক শিশুর হরমোনের সমস্যার জন্যও বমি করতে পারে। এর সঙ্গে বাচ্চার প্রজননতন্ত্রের সমস্যাও থাকতে পারে।
* তিন মাস থেকে এক বছর
▶ রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া প্রথমে বমি দিয়ে শুরু হয়, পরে পাতলা পায়খানা হয়।
▶ তীব্র জ্বরে অনেক বাচ্চা বমি করে। শ্বাসনালির সংক্রমণে কাশির সঙ্গে শিশু বমি করতে পারে।
▶ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ালেও বাচ্চার বমি হতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক বিরতি দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াবেন ও ঢেঁকুর তোলাবেন। জোর করে খাওয়াবেন না।
▶ পেটের যে কোনো সমস্যায় পেট ফাঁপলে, গ্যাস হলে পেট ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমি হয়।
* বড় বাচ্চা
▶ প্রস্রাবে ইনফেকশন হলেও বমি ও পেট ব্যথা হতে পারে।
▶ গলায় ইনফেকশন, ঠান্ডা, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলেও বমির সঙ্গে কফ যায়।
▶ মাইগ্রেন, সাইনাসের ব্যথা, ব্রেইনে ইনফেকশনেও বমি হতে পারে।
▶ পেটে কৃমি বা জন্ডিস হলেও বমি হয়ে পেটব্যথা হয়।
▶ কোনো ধরনের বদহজম, খাদ্যে বিষক্রিয়া বা অ্যালার্জির জন্যও বমি হয়।
▶ কোনো কোনো বাচ্চা গাড়িতে উঠলে বমি করে, যাকে মোশন সিকনেস বলে।
* বমি হলে করণীয়
▶ অনবরত বমি হলে প্রথমেই বাচ্চাকে বাম কাতে শোয়াবেন বা উপুড় করে দেবেন। এতে শ্বাসনালিতে বমি চলে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। বমি পরিষ্কার করার পর সোজা করে শোয়াবেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার খাওয়ানোর জন্য জোর করবেন না। আগে শিশুকে সুস্থির হওয়ার সময় দিন।
▶ পরে খাওয়া দেওয়ার ১৫-২০ মিনিট আগে বমির ওষুধ খাওয়াবেন। ১৫ মিনিট পরপর ১ চামচ করে পানি দেবেন।
▶ পরবর্তী ১ ঘণ্টা বমি না করলে এক-দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে এক-দুই চামচ করে জাউ দেবেন, স্যালাইন খাওয়াবেন।
▶ একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ডাবের পানি, কোমল পানীয় গ্লাসে ঢেলে গ্যাস বের হওয়ার পর ১৫ মিনিট পরপর এক চুমুক করে খেতে দেবেন। একইভাবে এক দেড় ঘণ্টা বমি না হলে জাউ, স্যুপ, শরবত, পানি তরল খাবার একটু একটু করে শুরু করাবেন।
▶ বমি বন্ধ হয়ে পাতলা পায়খানা শুরু হলে নিওস্যালাইন খাওয়াবেন। স্যালাইন খেতে না চাইলে ডাবের পানি, ইলেক্ট্রলাইট ড্রিংক খাওয়াবেন। ধীরে ধীরে কাঁচকলার জাউ, মুরগির মাংস দিয়ে শুরু করাবেন।
▶ এরপরও বমি বন্ধ না হলে বা প্রস্রাব কমে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
* দীর্ঘদিন ধরে বমি হলে এর প্রতিকার
▶ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত, পেটের নাড়িতে কোনো সমস্যা আছে কিনা।
▶ অ্যালার্জি আছে এমন খাবার খাওয়াচ্ছেন কিনা।
▶ জোর করে অতিরিক্ত খাওয়াচ্ছেন কিনা। অনেক মা বাচ্চাদের জোর করে খাওয়ায়। ফলে দেখা যায়, মাকে আবার খাবার আনতে দেখলেই বাচ্চা বমি শুরু করে।
▶ বাচ্চা মানসিক চাপের মধ্যে আছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখুন। প্রতি মাসে বমি করা বাচ্চাদের ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কিনা। এদের খাবার, ঘুম নিশ্চিত করার পাশাপাশি হতাশা, দুশ্চিন্তা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
▶ মৃগী রোগের একটা ধরন হচ্ছে হঠাৎ পেটে ব্যথা, বমি হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন বমি থাকলে এদিকটাও ভাবতে হবে।
▶ কোনো নির্দিষ্ট খাবারে অ্যালার্জি থাকলেও বাচ্চারা বমি করতে পারে, গায়ে র্যাশ থাকুক আর না থাকুক। অনেক বাচ্চারই গরুর দুধে অ্যালার্জি থেকে বমি হয়।
লেখক : শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।