চট্টগ্রামে ডেঙ্গিতে এক বছরে প্রাণ গেল ৪১ জনের
আক্রান্ত ৫ হাজার ৪৩৯
এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামে ২০২২ সালে আতঙ্কের নাম ছিল মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গি। বছরের শেষ দিকেও এডিস মশার কামড়ে মানুষ ঘরে ঘরে যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার চেয়ে নগরীতে বেশি। এ কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। মশক নিধনে চসিকের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল না, অভিযোগ ছিল নগরবাসীর। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, গত ২২ বছরে এবার ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোনো বছর ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৪৩৯ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার চার কারণে চট্টগ্রামে ডেঙ্গির বিস্তার ঘটেছে। যদিও শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চসিককে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ২২ বছরের (২০০০ সাল থেকে) মধ্যে চলতি বছরে ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়। ওই বছর ২ হাজার ৫৪৮ জন আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মারা যায় ৫ জন। ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ১৩৫ জন। তবে ওই বছর কোনো রোগী মারা যায়নি। তার পরের বছর ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় ১১৭ জন। কেউ মারা যায়নি। ২০১৮ সালে একজন ডেঙ্গি রোগী মারা যায়। ওই বছর আক্রান্ত হয় ৭২ জন। ২০২০ সাল ছিল কোভিড-১৯ বছর। ওই বছর ডেঙ্গিতে কেউ মারা যায়নি। আক্রান্ত হয় ১৭ জন। ২০২১ সালে আক্রান্ত ২৭১ জন। মৃত্যু হয় ৫ জনের। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ ও নিয়ন্ত্রণ) ডা. মোহাম্মদ নুরুল হায়দার বলেন, ‘চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর (শুক্রবার) পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৩৯ জন ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯ মাসের শিশু থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন। সর্বশেষ গত সোম ও মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ২৮ জন চিকিৎসাধীন।’ বিশেষজ্ঞদের দাবি, চলতি বছরে মশার বংশবিস্তার, অসময়ের বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এবং বাহক-এই চারটি সূচক অনুকূলে থাকায় এডিস মশার কমড়ে কাবু হয়ে গেছে চট্টগ্রামবাসী। অপরদিকে ইনস্টিটিউট অব এপিডেমোলোজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) এর তথ্য মতে, চলতি বছর ডেঙ্গিতে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে। এবার ডেঙ্গির ১, ৩ এবং ৪ সেরোটাইপে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। একাধিক সেরোটাইপে সংক্রমণ হওয়ায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মো. মামুনুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, ‘২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গির প্রবণতা ছিল বেশি। অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোগী বাড়বে। অক্টোবর থেকে কমতে শুরু করবে। নভেম্বরে খুবই কম থাকবে। এরপর ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তেমন রোগী পাওয়া যেত না। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন।’
চলতি বছর সংক্রমণ বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত এডিস মশার জীবনকাল ৭-১০ দিন। এরপর এমনিতেই তারা মারা যায়। তবে এডিস মশার ডিম প্রকৃতিতে ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে। যখন স্বচ্ছ পানি পায় এসব ডিম ফুটতে শুরু করে। চলতি বছর অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এডিস মশার প্রজননে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাধারণত অনুকূল পরিবেশে ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হতে পারে। এসব কারণে এবার সংক্রমণ বেশি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। এছাড়া মানুষের পাশাপাশি গরু, ঘোড়া, শুকর ও বাদুড় ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক হিসাবে প্রমাণিত। এটাও সংক্রমণ বাড়ার একটা কারণ হতে পারে। তবে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এলে ডেঙ্গির প্রকোপ একেবারেই কমে যাবে বলে ধারণা করছি।