শিক্ষায় সংস্কার আর করোনার ধকল কাটাতেই বছর পার
নতুন শিক্ষাক্রম, শিখন পদ্ধতি ও পাঠ্যবই যুক্ত হয়েছে, কিন্তু যাচ্ছে নিম্নমানের বই * প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে * আপত্তি সত্ত্বেও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষা
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় লন্ডভন্ড করে গেছে শিক্ষা খাত। ২০২০ ও ২০২১ সালে লেখাপড়া হয়েছে কোনোরকম। বেশির ভাগ সময়ে বন্ধ। এ সময়ে ডিজিটাল সামগ্রী আর ইন্টারনেট ও বিভিন্ন অ্যাপের সহায়তায় নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে চলে শিক্ষা চালানোর প্রচেষ্টা।
কিন্তু অবকাঠামোগত সংকট তাতে অনেকটাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। ফলে শিক্ষায় শিখন ঘাটতি, ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ আর শিশুশ্রমের মতো ক্ষত রেখে যায়। ২০২২ সাল আসে এসব ক্ষতি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে। বছরজুড়ে ছিল সেই যুদ্ধে জয়লাভের প্রচেষ্টা। মাঝেমধ্যে করোনার প্রকোপ চোখ রাঙালেও তা উপেক্ষা করে বছরজুড়েই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলেছে লেখাপড়া।
অন্যদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। প্রযুক্তির বিপ্লবে হঠাৎ উদিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য থেকে জাতীয়ভাবে লাভ ঘরে তুলতে দরকার ছিল যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম। তাই করোনায় পিছিয়ে গেলেও এ বছরের শুরু থেকে তা (শিক্ষাক্রম) আধুনিকায়নের ওপর জোর কার্যক্রম চলে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। প্রাথমিকের শিক্ষাক্রমও হালনাগাদ করা হয়েছে। এর ফলে আগামীকাল বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই প্রবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষাক্রম বা অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতিতে লেখাপড়া করবে। তাদের শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে হাতেকলমে শেখানো এবং বাস্তব জ্ঞান দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বলে কোনো বিভাগ থাকবে না। এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুটি, তবে ফল ঘোষণা হবে দুটি পরীক্ষার ফল একত্র করে। এই শিক্ষাক্রমে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও সারা দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দুদিন কার্যকর করা হয়েছে। তবে এরপরও কিছু নেতিবাচক ঘটনা শিক্ষা খাতে তোলপাড় সৃষ্টি করে যায়। এর মধ্যে প্রথমেই আসে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক। সরকারের নির্ধারিত দরের চেয়েও অনেক কম মূল্যে এসব বই ছাপানোর কাজ নেন মুদ্রাকররা।
মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কাজ নিতে এমনটি করেছেন কাজ পাওয়া ব্যক্তিরা। এ অবস্থার মধ্যে সরকারের ডলার সাশ্রয় নীতি আর জ্বালানি স্বল্পতা সংকটকে তীব্র করেছে। বাজারে কাগজ সংকটের কারণে মানসম্মত পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং বইয়ের মান তদারককারী পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান রহস্যজনক কারণে বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে না ধরে চুনোপুঁটিকে শায়েস্তা করছে বলে অভিযোগ আসছে।
ফলে নতুন বছরে নিউজপ্রিন্ট আর নিম্নমানের কাগজ-ছাপায় বই যাচ্ছে শিশুর হাতে। এছাড়া বিদায়ি বছরে উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে তৈরির মতো ঘটনাও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দারুণ বিব্রত করেছিল। যদিও দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুরসংখ্যক শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি এবং স্নাতক পর্যায়ের কলেজে প্রায় এক লাখ পদ শূন্য আছে। দীর্ঘদিন আটকে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া। বিদায়ি বছরে এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাড়ে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগের ফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ৩৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুনভাবে আরও ৬৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে? সবমিলিয়ে ২০২২ সালজুড়ে দেড় লাখ শিক্ষক নিয়োগের বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। এছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করেছে সরকার। এ সংখ্যা ২ হাজার ৭১৬টি।
পিইসি আউট, ইন প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা : ২০০৯ সালে আকস্মিকভাবে চালু করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। পরের বছর নিম্নমাধ্যমিকে জেএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়। শুরু থেকেই এসব পরীক্ষা বাতিলের ব্যাপারে দাবি ছিল সুশীল সমাজের। কেননা এ কারণে নোট-গাইড আর কোচিং ব্যবসা লাগামহীন হয়ে পড়েছিল। ২০২০ সালে করোনার ডামাডোলে প্রাথমিক আর নিম্নমাধ্যমিকের ওই দুই পরীক্ষা বাতিল হয়। কিন্তু বছর শেষে এসে হঠাৎ একযুগ বন্ধ থাকা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা চালু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শুক্রবার সারা দেশে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষাও বাতিলের দাবি ছিল সুশীল সমাজের। তাদের দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে।
বন্যায় পেছায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা : করোনার কারণে এমনিতেই এ দুই স্তরের শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ছোট করার পাশাপাশি পরীক্ষা ফেব্রুয়ারি আর জুনের পরিবর্তে আগস্ট-অক্টোবরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। কিন্তু বন্যার কারণে এই পরীক্ষা পেছাতে হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা বিলম্বে নেওয়া হয়। ফলে পিছিয়ে যায় উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস। বর্তমানে এই শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। আর কয়েকদিন আগে শেষ হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। আর এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রমও পেছাবে। শুধু তাই নয়, দেরিতে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ায় সেশনজট মাথায় নিয়েই চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে ছাত্রছাত্রীরা।
ঝরে পড়ার হার বেড়েছে : করোনাভাইরাস ও বন্যার কারণে এক বছরের ব্যবধানে সারা দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২ লাখ ২১ হাজার পরীক্ষার্থী কমেছে। একইভাবে কমেছে এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী। এভাবে আরও নানান ক্ষেত্রে সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে পার হয়েছে শিক্ষার বছর ২০২২।