Logo
Logo
×

গোলটেবিল বৈঠক

মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ’র উদ্যোগে বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষ্যে গোলটেবিল বৈঠক

ক্যানসার জয়-আমরাই পারি

আজ বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দেশে ক্যানসার চিকিৎসার বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে উপজীব্য করে বরেণ্য ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্প্রতি একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের সঞ্চালনায় এ রোগের চিকিৎসায় করণীয় ও সুপারিশমালা এ বৈঠকে বিশদভাবে উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এ আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার যুগান্তর ও চ্যানেল আই।

Icon

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্যানসার রোগীদের সমন্বিত চিকিৎসা প্রয়োজন

ক্যানসার রোগীর সংখ্যা গত এক দশকের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। প্রায় ৮৫ ভাগ ক্যানসার রোগী রোগের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। ক্যানসার রোগ নির্ণয়ের পর অপারেশন, কেমো ও রেডিওথেরাপি দেওয়ার প্রস্তুতির জন্য রোগীদের কিছু সময় দিতে হয়। মেডিকেল অনকোলজিস্টরা কেমো, ইমিউনো, টার্গেটেড ও হরমোনথেরাপি প্রেসক্রাইব করেন। রোগীদের কোনো জটিলতা হলে কিংবা প্যালিয়েটিভ কেয়ারে মেডিকেল অনকোলজিস্টরা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এজন্য এদের ম্যানেজার অব ক্যানসার কেয়ার বলা হয়। জেলা সদর হাসপাতালে মেডিকেল অনকোলজিস্ট প্রয়োজন। এতে অতিরিক্ত অবকাঠামো প্রয়োজন নেই। এছাড়া বিভাগীয় শহরে সমন্বিত ক্যানসার সেন্টার থাকা প্রয়োজন। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে নবীন ডাক্তারদের যদি ক্যানসারের ট্রেনিং প্রতিনিয়ত দেওয়া হয় তাহলে তাদের দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়বে।

- অধ্যাপক ডা. পারভীন শাহিদা আখতার

প্রেসিডেন্ট, মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ।

আরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন

কোনো দেশের মেডিকেল কারিকুলাম তৈরি করা হয় সে দেশের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে। এ কারিকুলাম এভিডেন্স বেসড হতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি কিশোরগঞ্জে একটি জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি শুরু করে। তাতে ক্যানসার আক্রান্তের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা দেখে আমরা বিচলিত হই। দেশে পুরুষ ও নারীর প্রধান ক্যানসারগুলো নিয়ে আমরা যা ধারণা করি তার বিপরীত ধরন এ রেজিস্ট্রিতে পাওয়া গেছে। দেশে মেডিকেল অনকোলজিস্ট আছেন মাত্র ৩২ জন ও দেশজুড়ে অনকোলজিস্টের সংখ্যা প্রায় ৩০০ জন। মেডিকেল অনকোলজিস্টদের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্রুত দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি চালু করতে হবে। এর ফলে কোর্সের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হবে। এটি বাড়লে ট্রেনিংয়ের সংখ্যাও বাড়বে।

- অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কামাল আজাদ

প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সমন্বিত ক্যানসার সেন্টার বাড়াতে হবে

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩.৫ কোটি ক্যানসার রোগী শনাক্ত হবে। ক্যানসার যদি শুরুতে শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যায়, তবে ক্যানসারমুক্ত জীবনযাপন করা সম্ভব। স্কুল লেভেলের পাঠ্যপুস্তকে ক্যানসারের কারণ ও প্রতিরোধ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সারা দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে রেফারেল সিস্টেম চালু না হলে ক্যানসারের শনাক্ত ও চিকিৎসা থেকে অনেক রোগী বঞ্চিত হবেন। দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ক্যানসার সেন্টার চালু করতে এখনো প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও অন্যান্য জনবল সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ক্যানসার রোগী ও তাদের এটেনডেন্টদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালের বাইরে ডরমেটরির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে সেন্টার অব এক্সিলেন্স করা সময়ের দাবি। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা হাসপাতালে সব ধরনের টেস্ট যেন করা যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

- ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর

পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, সার্জিক্যাল অনকোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

বিদেশে চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ নিলে দক্ষতা বাড়ে

আমরা জানি প্রশিক্ষণেই শক্তি, প্রশিক্ষণেই মুক্তি। দেশে বিরাজমান প্রশিক্ষণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ শেষে রিফ্রেশার ও বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা কতটুকু লাভবান হতে পারি, সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। দেশের হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমেই দেখতে হবে কারিকুলাম যথেষ্ট ভালো আছে কিনা, লগবুক সঠিকভাবে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি কিনা, প্রশিক্ষক যথেষ্ট আছে কিনা, প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেইনিং এগুলো সঠিক নিয়মে আছে কিনা-এসব দিকে লক্ষ রাখলে দেশে যারা পোস্টগ্র্যাজুয়েট করছে তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেশেই হয়ে যাবে। প্রশিক্ষণ শেষে যখন চিকিৎসকরা অন্যান্য ইনস্টিটিউটে যাবে, তখন তাদের রিফ্রেশার কোর্সের প্রয়োজন হবে। কোন দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের আলোকে ক্যানসার চিকিৎসার আন্তর্জাতিক গাইডলাইনগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানা যায়।

- ব্রি. জেনারেল ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী (পিআরএল)

সিনিয়র কনসালটেন্ট, মেডিকেল অনকোলজি, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতাল, উত্তরা, ঢাকা।

প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দিতে হবে

ক্যানসার রোগে সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োজন। এর অন্যতম অনুষঙ্গ রেডিয়েশন থেরাপি। যদিও বর্তমানে দেশে এ থেরাপির যথেষ্ট স্বল্পতা রয়েছে। ক্যানসার রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন কেমোথেরাপি, ইমিউনো ও টার্গেটেডথেরাপি, রেডিওথেরাপি, সার্জিক্যাল চিকিৎসা যে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া সম্ভব। এ সার্ভিসগুলোয় দেশে দক্ষ জনবল প্রস্তুত রয়েছে। এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেশের ৮টি বিভাগের মেডিকেল কলেজে সুপার নিউমারি পদে পদায়ন করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্যানসার ফ্যাকাল্টি চালু করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে, ক্যানসার চিকিৎসায় পারসোনালাইজড মেডিসিন পদ্ধতি প্রচলন করা। এজন্য দেশে পর্যাপ্ত মলিকুলার ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মেডিকেল অনকোলজিস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে জেলা পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দিতে হবে।

- ডা. মো. রফিকুল ইসলাম

মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও সাধারণ সম্পাদক, মেডিকেল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ।

রোগ নির্ণয়ের ফ্যাসিলিটিজ বাড়ান দরকার

ক্যানসার চিকিৎসার বেশ কিছু পর্যায় রয়েছে। প্রথমত রোগ নির্ণয় করতে হয়, দ্বিতীয়ত প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে সার্জারি করতে হয়, তারপর মেডিকেল অনকোলজিস্টরা কেমো, ইমিউনো ও টার্গেটেডথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেন এবং এর সঙ্গে রেডিয়েশন অনকোলজিস্টরা প্রয়োজন অনুযায়ী রেডিওথেরাপি দিয়ে থাকেন। ব্লাড ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় মূলত বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রয়োজন হয়। যেমন-লিউকেমিয়া, মাল্টিপল মারেলোমা, হজকিনস ও নন-হজকিনস লিম্ফোমা এ ধরনের ক্যানসার। সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যায় প্যালিয়েটিভ চিকিৎসার জন্য। দেশের বেশিরভাগ রোগী যেহেতু রোগের অগ্রসর পর্যায়ে আসে, তাই প্যালিয়েটিভ ট্রিটমেন্টের বেশি প্রয়োজন হয়। আমাদের ক্যানসার রোগীরা অত্যন্ত নিগৃহীত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি ছাড়া কোনো চিকিৎসাই করা যায় না।

- মেজর জেনারেল ডা. মো. আজিজুল ইসলাম (পিএআরএল)

কনসালট্যান্ট ফিজিসিয়ান জেনারেল, ডাইরেক্টরেট জেনারেল মেডিকেল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।

আমাদের দক্ষতা বেড়েছে

রোগী ও চিকিৎসকদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও চিকিৎসকদের ব্যবহারগত বিষয়টি ক্যানসার রোগীদের বিদেশে চিকিৎসার দিকে ধাবিত করছে। টেকনোলজির দিক থেকে বিভিন্ন লজিস্টিক ও আন্তর্জাতিকমানের ওষুধ দেশে রয়েছে। শতকরা ৮০-৯০ ভাগ ক্যানসারের ওষুধ দেশেই প্রস্তুত হয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এরপরও ক্যানসার চিকিৎসায় দেশে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ সমস্যাগুলো দূর করে দেশেই সব ধরনের ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং রোগী নির্ণয় ও চিকিৎসার অগ্রগতি বোঝার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সারা দেশে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মতো সমন্বিত ক্যানসার সেন্টার আরও বাড়াতে হবে।

- ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন

সহযোগী অধ্যাপক, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

নারী ক্যানসার রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে

নারীদের প্রজননতন্ত্রের ক্যানসার হচ্ছে গাইনি অনকোলজিক্যাল ক্যানসার। এর ৭০ ভাগই হচ্ছে জরায়ুমুখের ক্যানসার। বাকি ৩০ ভাগ হচ্ছে ডিম্বাশয়, এন্ডোমেট্রিয়াল, ভালভার ও ভ্যাজাইনাল ক্যানসার। বেশিরভাগ রোগী স্টেজ-৩ ও ৪-এ চিকিৎসকের কাছে আসেন। তখন চিকিৎসা করা জটিল হয়ে পড়ে। অনিয়মিত মাসিক বা মেনোপজের পর রক্তক্ষরণ শুরু হলেও এ দেশের নারীরা লজ্জায় কাউকে শেয়ার করেন না। নারীরা লজ্জায় বা সংকোচে সমস্যার কথা বলেন না। এজন্য পরিবারকে পাশে থাকতে হবে। ৭০ ভাগ জরায়ুমুখের ক্যানসার ডায়াগনেসিস হয় যখন আর অপারেশন করা যায় না। আরেকটি সমস্যা হলো, এ নারীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। জরায়ুমুখের ক্যানসার সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য ক্যানসার। সব নারিকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। ভ্যাকসিন দিয়ে এ ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। ১০-১৪ বছর বয়সে এবং কমিউনিটি লেভেলে এ ভ্যাকসিন দিতে হবে।

- অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন

সভাপতি, গাইনি অনকোলজিক্যাল সোসাইটি ইন বাংলাদেশ।

বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সেবা বাড়াতে হবে

ক্যানসার চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগী নির্ণয়ে ও চিকিৎসা প্ল্যানিংয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার হয়। এরপর ক্যানসার চিকিসায় রোগীর প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। আমাদের বেশিরভাগ রোগী যেহেতু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তাই তাদের পক্ষে ক্যানসারের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। সরকারি পর্যায়ে আমরা বেশ কিছু কেমোথেরাপি ওষুধ রোগীদের বিনামূল্যে দিয়ে থাকি। কিন্তু অতিরিক্ত রোগীদের চাপে সব রোগীকে সারা বছর ওষুধ বিনামূল্যে দিতে পারছি না। সরকারি পর্যায়ে বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যয়ের পার্থক্য অনেক বেশি। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিদের অনুরোধ করব, তারা যেন নতুন নতুন মলিকুল তৈরি করে ও গুণগত মান ঠিক রেখে ওষুধের দাম সবার জন্য সহনশীল পর্যায়ে রাখে।

- অধ্যাপক ডা. নাজরীনা খাতুন

বিভাগীয় প্রধান, মেডিকেল অনকোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ও স্ক্রিনিং বাড়াতে হবে

অন্যান্য রোগের মতো ক্যানসার প্রতিরোধও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দুটি ধাপে এ প্রতিরোধ করা যায়। একটি হলো, ক্যানসার তৈরি করে এমন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলো কমিয়ে আনা, দ্বিতীয়টি হলো, ক্যানসার রোগের শুরুতেই রোগ নির্ণয় করা ও দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া। রিস্ক ফ্যাকটরগুলো কমাতে টোব্যাকো, ধূমপান ও অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক সক্রিয়তার সুবিধা বৃদ্ধি করা, পরিবেশ দূষণ রোধ করা, নিরাপদ খাবারের ব্যবস্থা করা এবং কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ রিস্কগুলো কমাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব রয়েছে। তামাক ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য ব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান নয়। পৃথিবীর সব দেশে কোলন, ফুসফুস, ব্রেস্ট ও জরায়ুর মুখের ক্যানসারের স্ক্রিনিং হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এটি সার্বজনীন ও বিস্তৃত করতে হবে।

-ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিয়েশনের গুরুত্ব অপরিসীম

ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। যদি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হয় তবে অনেক রোগে শুরুতেই রেডিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা আছে। জরায়ুমুখের ক্যানসারের চিকিৎসায় ও কণ্ঠনালির চিকিৎসা রেডিওথেরাপির মাধ্যমে দেওয়া যায়। রেডিওথেরাপি ছাড়া প্যালিয়েটিভ কেয়ার দেওয়া কষ্টসাধ্য। হাড়ে, ব্রেনে, স্পাইনাল কর্ডে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে রেডিওথেরাপি দিলে রোগীর সুস্থতার পথ প্রশস্ত হয়। মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে চলতি মাসে দুটি নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন চালু হবে। সারা দেশে রেডিওথেরাপি মেশিনের সংকট রয়েছে। এর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। রেডিয়েশন মেশিন স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সাপেক্ষ হলেও, এটি অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। অতিদ্রুত রেডিওথেরাপি মেশিনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে প্রান্তিক পর্যায়ে রোগী চিকিৎসাসেবা পেতে পারে।

- অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ

বিভাগীয় প্রধান, রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন চালু করা প্রয়োজন

দেশের বাইরে কোনো কনফারেন্সে গেলে রোগের পরিসংখ্যান ও এপিডেমিওলোজির প্রসঙ্গ এলে আমরা নীরব হয়ে যাই। কারণ দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক কোনো ক্যানসার রেজিস্ট্রি নেই। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক একটি ক্যানসার রেজিস্ট্রি চালু করা আছে। এর লজিস্টিক বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম যেমন সচেতনতা ও স্ক্রিনিংয়ে আমাদের বাজেট অত্যন্ত কম। জরুরিভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন। সরকারপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেডিওথেরাপি মেশিন একসঙ্গে ৫০টি কেনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজে যেন ক্যানসার বিভাগ বিশেষ করে মেডিকেল অনকোলজিস্ট থাকে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণ সেন্টার চালু করা প্রয়োজন। উপজেলায় টেলিমিডিসিন চালু করলে তা রোগীদের জন্য ফলপ্রসূ হবে। ৫০০ বেডের জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এখনো ৩০০ বেডের জনবল দিয়ে কাজ চলছে। যথাযথ লোকবল নিয়োগ এখনই সময়ের দাবি।

- অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

প্রকল্প সমন্বয়কারী ও প্রিভেন্টিভ অনকোলজি বিভাগ, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল।

মলিকুলার ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে

ক্যানসার রোগ নির্ণয়ে বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। সিটিস্ক্যান, এমআরআই ছাড়াও পেট সিটিস্ক্যান, ক্যানসার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বেশ প্রয়োজন হয়। সরকারি পর্যায়ে ৩টি ও বেসরকারি পর্যায়ে শুধু ঢাকাতেই এ পেট সিটি রয়েছে। প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে যেখানে অনকোলজি ইউনিট আছে সেখানে পেটসিটির ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর মূল্য যেন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সাধারণ মানুষের জন্য সহনশীল থাকে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। দেশে দক্ষ অনকোলজিক্যাল রেডিওলজিস্টের সংখ্যা খুব কম। সর্বত্র অন্তত বায়োপসি নেওয়ার জন্য দক্ষ জনবল লাগবে। পরবর্তী সময়ে মডার্ন ট্রিটমেন্টের জন্য এনজিএস করা প্রয়োজন। দেশের অন্তত ৮টি পুরোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসারের সমন্বিত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অনুরোধ করব, বেসরকারি পর্যায়ে দেশের উদ্যোক্তারা যেন ক্যানসার চিকিৎসায় বিনিয়োগ করেন।

- ডা. ফেরদৌস আরা বেগম

কনসালটেন্ট, মেডিকেল অনকোলজি, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

ক্যানসার চিকিৎসায় প্রয়োজন টিমওয়ার্ক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কনসেপ্ট অনুযায়ী ক্যানসারের চিকিৎসা কোনো এক বিশেষজ্ঞের ওপর পুরোপুরি বর্তায় না। মেডিকেল, সার্জিক্যাল ও রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ইনসেনটেভিস্ট ও প্রশিক্ষিত নার্সের সমন্বয়ে ক্যানসারের চিকিৎসার টিম গঠিত। দেশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিউমার বোর্ড সীমিত পরিসরে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে আছে। এর আরও ব্যাপ্তি ঘটাতে হবে। ইন্টার্ন ডাক্তারদের ক্যানসার চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে রেফারেল সিস্টেমের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতির জন্য নিরাময়যোগ্য কানসারও অনেক ক্ষেত্রে অনিরাময়যোগ্য হয়ে যায়। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের বিদেশেও প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত। বিদেশে প্রশিক্ষণ নিলে মাল্টিডিসিপ্লিনারি কেয়ারের অভিজ্ঞতা বাড়ে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে তাও দেখতে হবে। দেশে ও বিদেশে ক্যানসারসংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং বাড়াতে হবে।

- ডা. মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বিদ্যুত

সহযোগী অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

চিকিৎসাসেবা বাড়াতে হবে

দেশে এখনো জাতীয়ভাবে ক্যানসার রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। এটি শুরু করার কাজ প্রক্রিয়াধীন। দেশে প্রায় ১৫ লাখের বেশি ক্যানসার রোগী আছে। প্রতি বছর দেড় লাখ ক্যানসার রোগী নতুনভাবে শনাক্ত হচ্ছে এবং প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার এবং নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ক্যানসারের এ পরিসংখ্যান কমিয়ে উন্নত দেশের মতো আমরাও চিকিৎসা দিতে সক্ষম হব।

- ডা. এ টি এম কামরুল হাসান

মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও গবেষণা সহকারী, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।

ক্যানসার গবেষণা তহবিল গঠন প্রয়োজন

স্বাস্থ্যখাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্যানসার বিষয়ে প্রতিনিয়ত নুতন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে এবং এর চিকিৎসায় উত্তরণ ঘটছে। ক্যানসার গবেষণায় আমরা পিছিয়ে আছি এবং এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও অপ্রতুল। সুযোগ ও উদ্যোগের অভাবের পাশাপাশি পরিবেশ ও অবকাঠামোগত কিছু ত্রুটিও রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গবেষকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণা করেন। এতেও মূল্যায়ন ও সমর্থনের অভাব রয়েছে। কোন দেশের স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা হয় স্বাস্থ্য গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। তাই যুগপযোগী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা দরকার।

- ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম

মেডিকেল অনকোলজিস্ট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।

ইনসেপটা ক্যানসারের ওষুধ সুলভে বাজারজাত করে

বিশ্ববাজারে নতুন নতুন যে ক্যানসারের ওষুধ আছে তা যেন দেশের বাজারে অতিদ্রুত আনতে পারি, সেটিই আমাদের মূল লক্ষ্য। ইনসেপ্টা ক্যানসারের ওষুধ জনগণের জন্য অনেক সুলভ মূল্যে বাজারজাত করছে। ক্যানসার কেমোথেরাপির অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ফিলগাস্টিম ও পেগফিলগাস্টিম এখন পূর্বের থেকে এক-তৃতীয়াংশ কমে পাওয়া যাচ্ছে।

- আশরাফ উদ্দীন আহমেদ

নির্বাহী পরিচালক, ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম