Logo
Logo
×

গোলটেবিল বৈঠক

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উদ্যোগে এবং ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগিতায় বিশ্ব ফুসফুস দিবস উপলক্ষ্যে গোলটেবিল আলোচনা

সুস্থ ফুসফুসের জন্য চাই বিশুদ্ধ বায়ু

দেশে বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। এ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে ফুসফুসের রোগ শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। ফুসফুসের রোগ নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণকল্পে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। এ পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফুসফুস দিবস। বিশুদ্ধ বায়ু ও সুস্থ ফুসফুস সবার জন্য-এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উদ্যোগে এবং ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগিতায় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দেশের খ্যাতনামা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞরা এক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হন। এ আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার দৈনিক যুগান্তর ও চ্যানেল আই।

Icon

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি ও রোগীর চিকিৎসা ব্যয় কমানো জরুরি

বিশ্ব ফুসফুস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘Clean air & healtly Lungs for all’ অর্থাৎ নির্মল বাতাস ও সবার জন্য সুস্থ ফুসফুস। পৃথিবীব্যাপী বায়ুদূষণ বাড়ছে। তাই আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে যে, বাতাস যদি আমরা বিশুদ্ধ রাখতে পারি তবে ফুসফুসও সুস্থ থাকবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ স্বল্পতা রয়েছে। পৃথিবীতে স্বাস্থ্য খাতে কম বাজেটের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দেশের জনগণকে হেলথ ইন্সুরেন্সের আওতায় আনতে হবে। স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। কোভিড-পরবর্তী ফুসফুসের রোগ বেড়ে গেছে। তাই বায়ুদূষণ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার এখনই সময়। স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণে পৃথিবীব্যাপী শীর্ষে অবস্থান করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে বক্ষব্যাধির প্রকোপ মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং হবে। যেহেতু রোগীর চিকিৎসা খরচ বাড়ছে, তাই মৃত্যুঝুঁকি জেনেও অনেকেই চিকিৎসার মাঝপথে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। পরিষ্কার বায়ু ও স্বাস্থ্যকর ফুসফুস একজন মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং ফুসফুসের জন্য ফ্লু ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে হবে। ধূমপায়ীদের সিগারেট বর্জন অতীব প্রয়োজনীয়। ফুসফুসের অনেক রোগে পারিবারিক প্রভাব থাকে। ফুসফুসে ক্যানসার যেন প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হয়, সেজন্য দেশব্যাপী স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করা সময়ের দাবি।

-অধ্যাপক ডা. মো. আলী হোসেন

সাবেক পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একযোগে কাজ করতে হবে

ফুসফুসের চিকিৎসায় রোগ নির্ণয় ও ট্রিটমেন্ট এ দুটি প্রধান অংশ থাকে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা সেবা প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রাইমারি কেয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকে দেওয়া হয়। এখানে সাধারণ ফুসফুসের রোগ যেমন: নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, সিওপিডি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কমন কোল্ডের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ জায়গায় আলাদা করে রেসপিরেটরি ইউনিট থাকে না। সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত ওষুধের মাধ্যমে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেকেন্ডারি কেয়ারে রেসপিরেটরি ইউনিট দেশব্যাপী ৪২টি আছে। এখানে বহির্বিভাগের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় মাইক্রোসকপি ও জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে করা হয় এবং এর চিকিৎসা দেওয়া হয়। টারশিয়ারি সেবা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এখানে কফের কালচার, জিন এক্সপার্ট, স্পাইরোমেট্রি, ব্রঙ্কোসকপি হয়। টারশিয়ারি লেভেলে ফুসফুসের সব চিকিৎসা বহির্বিভাগ ও রোগী ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। দেশের বক্ষব্যাধি চিকিৎসায় রেফারেল সেন্টার হলো জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ফুসফুসের সব চিকিৎসা যেন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। ফুসফুস সুস্থ রাখতে শুধু দিবস পালনের মাধ্যমে আটকে থাকলে চলবে না। সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ কাজটি নিয়মিত চালিয়ে যেতে হবে। ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত রোগীরা যেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত না হন, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এ রোগীদের অন্য কোনো কাজে পুনর্বাসন করতে হবে। দেশ যত উন্নত হবে ফুসফুসের সমস্যা ততই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বায়ুদূষণ রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

-অধ্যাপক ডা. সাকি মো. জাকিউল আলম

বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

নিয়মিত শ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে

আমরা যদি বাতাস বিশুদ্ধ রাখতে পারি, তাহলে ফুসফুসজনিত রোগ শতকরা ৫০ ভাগ কমে যাবে। গত কয়েক বছরে ঘরের বাইরে দূষণ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যারা দূষণযুক্ত পরিবেশে কাজ করেন, তাদের ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। যার নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা বিশ্বের কোথাও নেই। ঘরের কার্পেটে থাকা মাইট অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট বাড়ায়। তাই কার্পেট ঘরে না রাখাই ভালো। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, শিপিং ফ্যাকটরিতে যারা কাজ করেন, তাদের অকুপেশনাল লাং ডিজিজ হয়। এক্ষেত্রে মাস্ক ও ড্রেস কোড পরিধান করতে হবে। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব হলেই অ্যাজমা ও সিওপিডি রোগীদের নিউমোনিয়া ও ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। ব্যাকটিরিয়াজনিত কারণে ফুসফুসের রোগ নিউমোনিয়া হয়। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা গ্রহণ জরুরি। না হলে নিউমোনিয়া থেকে মৃত্যুঝুঁকি থাকে।

-অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম

সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বক্ষব্যাধি বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল

রোগীরা প্রায়ই দেরিতে ডাক্তারের কাছে আসেন

বুকের সব অঙ্গপ্রতঙ্গের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালিকা ছাড়া সব চিকিৎসা থোরাসিক সার্জনরা দিয়ে থাকেন। যক্ষ্মা ও ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় থোরাসিক সার্জারির ভূমিকা আছে। যক্ষ্মা রোগে ফুসফুসের ভেতর গর্ত বা ক্যাভিটি তৈরি হলে এবং তা চলে না গেলে এ গর্তে যক্ষ্মার জীবাণু থেকে যায়। ফলে যক্ষ্মা থেকে নিরাময় পাওয়া যায় না। তখন এ ক্যাভিটিকে অপারেশন করে সারিয়ে তোলা হয়। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার একদিকের ফুসফুস আক্রান্ত হলে এবং ওষুধে ভালো না হলে তখন সেই ফুসফুসকে অপারেশনের মাধ্যমে ফেলে দেওয়া হয়। একটি সুস্থ, স্বাভাবিক ফুসফুস নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব। যক্ষ্মা রোগী সঠিকভাবে চিকিৎসা না নিলে কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে তখন ওষুধে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন অপারেশন করা জরুরি হয়।

-অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল আনাম কিবরিয়া

বিভাগীয় প্রধান, থোরাসিক সার্জারি বিভাগ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

রোগীর অ্যালার্জি কীসে হচ্ছে, তা শনাক্ত করা দরকার

অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ায় শরীর কিছু কেমিক্যাল নিঃসরণ ঘটায়, ফলে কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। ঘরের ভেতরের বা বাইরের কিছু জিনিস, কোনো বিশেষ খাবার, হাউজ ডাস্ট, মাইটস, ঘরের ধুলা, ধোঁয়া এবং কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে তাদের লোম বা লালা থেকে কমন অ্যালার্জি হতে পারে। ধূমপান করতে গিয়ে যে নিকোটিন, কার্বন মনো-অক্সাইড বা কেমিক্যালস নেওয়া হয় সেগুলোও অ্যালার্জেন হিসাবে কাজ করে। কোনো বিশেষ খাবারে কারও শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করলে সে খাবার সে ব্যক্তি পরিহার করে চলবেন। অ্যালার্জিজনিত শ্বাসনালির অসুখ হচ্ছে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা। এতে শ্বাসনালির রাস্তা, অ্যালার্জির কারণে সরু হয়ে যায় এবং উপসর্গ সৃষ্টি করে। নাক কোনো বিশেষ অ্যালার্জেনের সংস্পর্শ এলে নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি, নাক বন্ধ, নাক থেকে সাইনাসে ইনফেকশন, মাথাব্যথা ইত্যাদি নাকের অ্যালার্জির লক্ষণ। অ্যালার্জির ঠিক একই মেকানিজমে চোখে র‌্যাশ, চুলকানি হয়। ত্বকেও এর প্রভাব পড়ে।

-অধ্যাপক ডা. মাজহারুল শাহীন

অধ্যক্ষ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং নাক, কান ও গলা রোগবিশেষজ্ঞ

রোগীর জীবন ধারণে পরিমিতবোধ থাকতে হবে

ফুসফুসের রোগের জন্য কী কী ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান আছে, তা জানতে হবে। একজন ফুসফুসের রোগী ধূমপান করবেন না, শারীরিক ওজন যেন না বাড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখবেন, এমন খাবার খাবেন, যাতে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা হয়। এমন কোনো জীবিকার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না যেখানে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পাথর কাটা, পাথর ভাঙা, জাহাজ ভাঙা, বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করা ব্যক্তিদের সর্বদা স্বাস্থ্যসচেতন থাকতে হবে। এসব কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন রিএজেন্ট, কেমিক্যাল ও দূষণের কারণে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকেন। শেষ রাতে ঠান্ডায় যাওয়া বা বায়ুদূষণের স্থানে গেলে ফুসফুসের সমস্যা বেড়ে যায়। এসব জায়গায় গেলে মাস্ক পরিধান করবেন এবং নিয়মিত ফ্লু ও নিউমোনিয়ার টিকা নিতে হবে। বাসার পোষা পাখি, প্রাণী পুষলে তা থেকে ফুসফুসের রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পাহাড়ে ওঠা, ড্রাইভিং করা থেকে বিরত থাকবেন। অপেশাদার বা হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছ থেকে কোনো ওষুধ কিনে খাওয়া যাবে না। অ্যাজমা রোগীরা একটু সুস্থবোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করে দেন। ওষুধ শুরু বা বন্ধ করা, ডোজ বাড়ানো-কমানো চিকিৎসকের পরামর্শে করতে হবে। কিছু রোগী আছেন যারা আশা ছেড়ে দেন বা ধারণা করেন তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। তাদের উদ্দেশে বলব, শেষ পর্যন্ত আশা রাখতে হবে।

-অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

উন্নত চিকিৎসার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ চাই

বিশ্বকে একটি পরিবার ধরা হলেও ভৌগোলিক, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কারণে এ দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ফুসফুসের অসুখগুলোর মধ্যে কি কোনো বিভাজন আছে? দেখা যায়, নিউমোনিয়া, সিওপিডি, অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসার বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে হয়। কিন্তু দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থাকলে কিছু কিছু অসুখ বেশি হতে দেখা যায়। পৃথিবীর যে অঞ্চলে বায়ুদূষণ বেশি, সেখানে দূষণজনিত ফুসফুসের অসুখ বেশি হয়। চিকিৎসা ও গবেষণায় বিশ্বব্যাপী যেন কোনো বৈষম্য না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে সবার কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে সমস্যা হচ্ছে। উন্নত দেশে সব ধরনের পরিবেশে দূষণের জন্য ট্রিটমেন্ট আছে। স্বল্প ও মধ্য পরিসরে আমাদের দেশে যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো আছে, সেখানে পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রিটমেন্ট তেমন একটা দেখা যায় না। বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের রোগের চিকিৎসায় একই প্রটোকল ফলো করা হয়। ফুসফুসের সব ধরনের রোগের চিকিৎসায় ব্যবস্থাপনা আমাদের আছে, আরও আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। দেশের স্বাস্থ্য বাজেটে ঘাটতি আছে, বাজেটের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সেসব পাশ কাটিয়ে আমাদের স্বাস্থসেবা নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। ফুসফুসের সব রোগের চিকিৎসায় বাইরে যাওয়া অযৌক্তিক। দেশেই ভালোমানের চিকিৎসা আছে বলে আমি মনে করি।

-ডা. আব্দুস শাকুর খান

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে

বিশ্বব্যাপী বক্ষব্যাধি সংক্রান্ত চিকিৎসকদের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তাদের মহাদেশীয় একটি সংগঠন রয়েছে। অর্থাৎ এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা প্রত্যেকের নিজস্ব একটি সংগঠন আছে। একপর্যায়ে এ আন্তঃমহাদেশীয় সংগঠনগুলো একসঙ্গে হয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার নাম ফেডারেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রেসপেরিটরি সোসাইটি। এর মূল উদ্দেশ্য, বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের রোগ নিয়ে যে কাজ হয়, তা যেন সমন্বিতভাবে করা যায়। এ পথ পরিক্রমায় ২০১৭ সালে চাটার্ড ফর লাং হেলথ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন প্রথম থেকেই এ চাটার্ডে স্বাক্ষর দেয়। বর্তমানে প্রায় ২৫০টি দেশ এ চাটার্ডে স্বাক্ষর করে ফেলেছে। এদের উদ্যোগে ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় একটি দিন নির্ধারিত হবে বিশ্ব ফুসফুস দিবস উদ্যাপন করার। এর উদ্দেশ্য হবে ফুসফুস সংক্রান্ত যত ব্যাধি আছে সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা। নিরাময়ের জন্য করণীয় দিকগুলো সম্পর্কে জানানো এবং রোগ প্রতিরোধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন তৈরি করা। চিকিৎসকদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উন্নত চিকিৎসা যেন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছায়-সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া। প্রতিবছর বিশ্ব ফুসফুস দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে এ সচেতনতা বৃদ্ধি। শুধু এ দিনে নয় বছরব্যাপী এর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

-ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর

সহকারী অধ্যাপক (সাবেক), জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

ফুসফুসের রোগের সব ধরনের ওষুধ ইনসেপটা বাজারজাত করছে

ফুসফুসের রোগীরা এখন আর দেশের বাইরে চিকিৎসা করতে যান না। এক্ষেত্রে এদেশের চিকিৎসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ইনসেপটা ২০০১ সালে ফুসফুসের রোগে ব্যবহৃত মন্টিলুকাস্ট বাজারজাত করেছে। ফ্লু ও নিউমোনিয়ার ব্যবহৃত যে ভ্যাকসিন ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস দেশে এনেছে তা শুধু একটি প্রোডাক্ট নয়। বরং এটি আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত একটি উপাদান হয়ে গেছে। ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসার মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ও টারগেটেড থেরাপি ইনসেপটা বাংলাদেশে বাজারজাত করছে। ফলে ওষুধের দাম এখন সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। অ্যাজমা, সিওপিডি ও আইএলডি চিকিৎসার ওষুধও ইনসেপটার রয়েছে। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার ওষুধ এখন অ্যাপ্রুভাল পর্যায়ে রয়েছে। এটি এফডিএ স্বীকৃত একটি ওষুধ, যা শুধু ইনসেপটা অ্যাপ্রুভাল পেয়েছে। ফুসফুসের রোগের সব ধরনের ওষুধ ইনসেপটা বাজারজাত করছে।

-মো. মিজানুর রহমান

জেনারেল ম্যানেজার, মার্কেটিং, ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

ফুসফুস ছাড়া অন্য অঙ্গের কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে

আমাদের জানতে হবে ফুসফুসের সমস্যায় কী কী লক্ষণ থাকে এবং এ লক্ষণ দেখা দিলে কখন বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রধান লক্ষণ কাশি, দ্বিতীয়ত কাশির সঙ্গে কফ, তৃতীয়ত কাশির সঙ্গে রক্ত এবং চতুর্থত বুকে ব্যথা, শ্বাসকস্ট এবং শ্বাসের সঙ্গে শব্দ হওয়া। এর সঙ্গে জ্বর, ক্ষুধামান্দ্য ও ওজন কমে যাওয়াও থাকতে পারে। যদি কারও কাশি একটানা তিন সপ্তাহের বেশি থাকে তখন কফ পরীক্ষা করা দরকার। যক্ষ্মা নির্ণয় হলে ডটস বা ব্র্যাক সেন্টারে বা কোনো বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করতে হবে। বয়স্ক রোগীর কাশির প্যাটার্নে কোনো পরিবর্তন হলে এবং এ পরিবর্তন অনেক ধরনের ওষুধ খেয়েও না সারলে তার ফুসফুসে ক্যানসার হতে পারে। সিওপিডি’র একটি উপাদান হচ্ছে ক্রনিক ব্রংকাইটিস। ব্রংকাইটিসে কারও একটানা ৩ মাস ও পরপর ২ বছর কাশি থাকে। এ রোগ ধূমপান থেকে হয়। তাই ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলো থেকে কেউ দূরে থাকলে এ রোগগুলো হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। ডিপিএলডি নামক রোগে ফুসফুস শুকিয়ে যায়। এর প্রধান উপসর্গ শুকনো কাশি যাতে কফ বের হয় না এবং এ সমস্যায় কাশতে কাশতে রোগীর ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটে। কাশির সঙ্গে কফ বের হলে এবং এর রং পরিবর্তন ও দুর্গন্ধ হলে সাপোরেটিভ লাং ডিজিজ হয়েছে ধরা হয়। কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে যক্ষ্মা ও ক্যানসারের কথা চিন্তা করতে হবে।

-ডা. গোলাম সারওয়ার

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি অসুখে জিনের প্রভাব রয়েছে

ফুসফুসের অসুখগুলো হওয়ার পেছনে পারিবারিক জিনগত প্রভাবও রয়েছে। দেখা গেছে, পিতা-মাতা যে কোনো একজনের অ্যাজমা থাকলে তাদের বাচ্চাদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগের অ্যাজমা হওয়ার প্রবণতা থাকে। এ বাচ্চাদের এটোপি বলা হয়। পিতা-মাতা দুজনেরই অ্যাজমা থাকলে অনাগত সন্তানদের শতকরা ৫০ ভাগের অ্যাজমা হতে পারে। মনোজাইগোটিক টুইন বা জমজ বাচ্চাদের মধ্যে অ্যাজমা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। কোনো নির্দিষ্ট জিন নয় বরং অনেকগুলো জিনের প্রভাবে বংশানুক্রমে ফুসফুসের রোগগুলো হয়ে থাকে। প্রায় ১০০টি জিন অ্যাজমা হওয়ার পেছনে কাজ করে। সিওপিডিতে আলফা ওয়ান এন্টি ট্রিপসিনের অভাব থাকলে তাদের অল্প বয়সে সিওপিডি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বায়ুদূষণ ও ধূমপানের ইতিহাস না থাকলেও তারা সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়ে যান। ব্রঙ্কিয়েকটিসে যে রোগী দীর্ঘমেয়াদে কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগে তাদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীর সিস্টিক ফাইব্রোসিস থাকে। এতে শ্বাসনালি ফুলে যায়। গবেষণা চলছে, ফুসফুসে ক্যানসারের জন্য জিনের প্রভাব কতখানি রয়েছে। কিছু কিছু জেনেটিক কারণেও ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এজন্য প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসায় ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনে নিতে হবে।

-ডা. মামুনুর রশিদ

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

বিশুদ্ধ বায়ুতে নিশ্চিত হয় সুস্থ ফুসফুস

ফুসফুসে সাধারণত সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি হয়। দূষণ নিয়ে যারা আইনের কাজ করেন তারা সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ তুলে ধরবেন। কোভিড-পরবর্তী সময়ে মাস্ক পরার কারণে অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ অনেক কমে গিয়েছিল। তাই বায়ু দূষণ থেকে নিজেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মাস্ক পরা প্রয়োজন। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা দেওয়া যায় ততই রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সব শ্বাসকষ্টই কিন্তু অ্যাজমা নয়। আমাদের দেশে শিল্প বিকশিত হচ্ছে। এর সঙ্গে পেশার কারণে ফুসফুসের রোগও বাড়ছে। এ অবস্থায় এ পেশাজীবীদের ড্রেস কোড বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা ঘুমের মধ্যে নাক ডাকেন, তাদের চিকিৎসায় বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ও শল্যচিকিৎসকরা অন্তর্ভুক্ত থাকেন। কর্মক্ষম থাকতে হলে একজন মানুষের সুস্থ থাকা ও সুন্দর ঘুম হওয়া প্রয়োজন। এ রোগীদের বেশির ভাগই স্থূল থাকেন। প্রাণখুলে হাসার মাধ্যমেও ফুসফুস সুস্থ থাকে। বিশুদ্ধ বায়ু সুস্থ ফুসফুস হোক সবার জন্য। যক্ষ্মার চিকিৎসা ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রামের আওতায় বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়।

-ডা. জিয়াউল করিম

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

পেশাগত কারণেও ফুসফুসের রোগ হতে পারে

ফুসফুসের শ্বাসনালির প্রধান রোগ হচ্ছে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি, যা বায়ুদূষণ ও ধূমপানের কারণে হয়। ফুসফুসের ক্যানসার যা প্রধানত ধূমপানের জন্য হয়। এছাড়া এমফাইসিমা, ক্রনিক ও একিউট ব্রঙ্কাইটিস, সিস্টিক ফাইব্রোসিস। ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ বা নিউমোনিয়া, যা সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার জন্য হয়। এটি বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত রোগ। প্রদাহজনিত আরেকটি রোগ যক্ষ্মা, যা বিশ্বব্যাপী হতে দেখা যায়। এছাড়া ফুসফুসে ক্যানসার, ফুসফুসে পুঁজ হওয়া বা অ্যাবসেস, একিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম। এছাড়া ইন্টারস্টিসিরাল রোগ, যা ফুসফুসে ধীরগতিতে হয়। এতে ফুসফুসের পর্দা আক্রান্ত হয়। ফুসফুসের রক্তনালিতে পালমোনারি এমবলিজম ও পালমোনারি হাইপারটেনশন হয়। ফুসফুসের পর্দার রোগ হয় নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ফুসফুসে ক্যানসার ও কোনো দুর্ঘটনার কারণে এ পর্দায় রক্ত জমতে পারে। ফুসফুসের পর্দায় বাতাস ঢুকে নিউমোথোরাক্স হয়। মেসোথেলিওমা হচ্ছে ফুসফুসের পর্দার একটি রেয়ার ডিজিজ।

-ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

ফুসফুসের বেশির ভাগ অসুখ প্রতিরোধযোগ্য

পরিবেশ বা বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলো সহজে আমাদের শ্বাসনালিতে ঢুকে পরে। নাকে প্রবেশকারী বাতাস ফিলট্রেসন, হিউমিডিফিকেশন, ওয়ার্মিং ও ডিসইনফেকশন হয়ে ফ্রেস বাতাস দেহে প্রবেশ করে ও আমরা সুস্থ থাকি। কেউ নাক বন্ধ করে মুখ দিয়ে শ্বাস নিলে, দূষিত বাতাস শরীরে সরাসরি ঢুকে পড়ে। অ্যাজমা ও অ্যালার্জি রোগীরা খুব ঘন ঘন হাঁচি দেয়-এ রোগীর সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি। আমাদের দেশেও এ রোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। রাতে ঘুমানোর সময় মাইট আমাদের নাকে যায় ও শ্বাসনালিতে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ, ইনফেকশন তৈরি করে। ধূমপান শ্বাসনালিকে সরাসরি ক্ষতি করে, ধূমপানের নিকোটিন ধূমপায়ীদের আনন্দ দেয় এবং এই নিকোটিনকে বার্ন করার জন্য ২৪৬টি ভোলাটাইল পদার্থ আমাদের দেহে ঢোকে। মোটিভেশন, ট্যাক্স বাড়ানোর মাধ্যমে ধূমপান থেকে বিরত থাকা যায়। পরিবেশ দূষণের কারণেও ফুসফুসে ক্যানসার হয়। এর থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

-ডা. এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন

কো-অর্ডিনেটর, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম