গোলটেবিল বৈঠক
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জরুরি
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গবন্ধুই প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের আপামরসাধারণের রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল ফর ডিজেবল্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার হাত ধরেই স্নাতক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে চালু হয়। আজ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন’ জাতীয় সংসদে পাশ করে। কিন্তু আজও এ আইনের অধীনে পেশাজীবী নিবন্ধন, পেশাজীবীদের মধ্য থেকে রেজিস্ট্রার নিয়োগ, লাইসেন্স প্রদান, শিক্ষা কার্যক্রমের স্বীকৃতি ও অনুমোদন, শিক্ষা বা সেবা প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের মতো কোনো কার্যক্রমই দৃশ্যমান হয়নি। ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলোর ৯০ শতাংশই অবৈধ। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাকে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে এ চিকিৎসাকে যথাযথ কার্যকর করতে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০ আগস্ট দৈনিক যুগান্তর, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ও সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি)-এর যৌথ উদ্যোগে ‘রিহ্যাবিলিটেশন আইন ও বাস্তবায়ন’ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। যুগান্তর কার্যালয়ে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস-২০২৩ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ওই বৈঠকে মন্ত্রী, দেশের শীর্ষ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী ও নীতিনির্ধারকরা বক্তব্য দেন। তারা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যথাযথ বাস্তবায়ন ও সেবা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাবিষয়ক প্রতিবেদন করার ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মীদের আহ্বান জানান। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন কনসালটেন্ট, ফিজিওথেরাপি বিভাগ সিআরপি ও বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের মহিলা কল্যাণ সম্পাদক ডা. ফারজানা শারমিন।
এম এ মান্নান
পরিকল্পনামন্ত্রী
প্রত্যেক মানুষকে সুস্থ থাকতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি নিজেও ফিজিওথেরাপি সেবা নিচ্ছি। দেশে মানুষ বিভিন্ন সময় শারীরিক ব্যথা-বেদনার শিকার হচ্ছেন। এদের চিকিৎসায় একটি সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কর্মক্ষম হয়ে পড়বে মানুষ। আমাদের শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা শত শত। এসব সাধারণ মানুষের ফিজিওথেরাপিবিষয়ক চিকিৎসা প্রদানে পর্যাপ্ত সেন্টার এবং দক্ষ চিকিৎসক-জনবল নিশ্চিত করতে হবে। সরকার চিকিৎসাসেবায় সব ধরনের ব্যবস্থা করছে। সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু একটি সরকার তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সরকার তা আবার চালু করে এ ক্লিনিক সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে’।
আমি মনে করি, চিকিৎসাসেবায় আরও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা জরুরি। আমরা করছিও তাই। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসা। যে কোনো চিকিৎসা প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি রুখতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। অবৈধ সেন্টারগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমার সুনামগঞ্জ হাওড় এলাকায় আমি নিজেই জমি দেব-সেখানে একটি অত্যাধুনিক ফিজিওথেরাপি সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হবে। এমনটা বাস্তবায়নে আমি আহ্বানও জানিয়েছি। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমি আমার এলাকায় ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল করছি, যার ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমি খুব কাছ থেকে দেখছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়ন করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের কল্যাণে যা করার দরকার তা করতে হবে। স্থাপনা তৈরি করেন-মানুষ ঠিকই আসবে। সেবা নেবে, উপকৃত হবে।
সাইফুল আলম
যুগান্তর সম্পাদক
মানবকল্যাণে কাজ করছেন ফিজিওথেরাপিস্টরা। একজন মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে শারীরিকভাবে চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন ফিজিওথোরপি সেবার বিশেষ দরকার হয়। বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সনদধারী দক্ষ ব্যক্তিরা সে কাজটি করে থাকেন। আমি মনে করি, মানবকল্যাণেই তারা কাজ করছেন। এজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে এক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সেটা হলো আপনাদের কাজ ও কাজের মূল্যায়ন লেখনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন ভালো কাজ করছে। যুগান্তর সব সময় ভালো কাজের সঙ্গে আছে এবং থাকবে। আপনাদের পাশেও সব সময় থাকবে।
আশরাফ আলী খান খসরু
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই ফিজিওথেরাপি শিক্ষা চালু। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব মুক্তিযুদ্ধা-সাধারণ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের চিকিৎসা দিতে বঙ্গবন্ধু মরিয়া হয়ে ওঠেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠান। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল ফর ডিজেবল্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্নাতক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওথেরাপি শিক্ষা-১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষ চালু হয়। আজ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন যথাযথ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। বর্তমান সরকার এ চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সব ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। এদিকে আমরা যখন ঘোষণা দিলাম সারা দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্কুল করব, তখন রাতারাতি বিভিন্ন উপজেলা-ইউনিয়নে ৩-৪টি করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্কুল হয়ে গেছে। সেগুলো করছে কে? শিক্ষিত মানুষরাই। এখন এগুলো লাগামে আনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সারা দেশ ফিজিওথেরাপি সেন্টারে ছেয়ে গেছে। এসব সেন্টারের বেশির ভাগই অবৈধ। সংশ্লিষ্টরা দেখেও চ্যালেঞ্জ করছে না। আইন আছে; কিন্তু আইনের প্রতি কেউই শ্রদ্ধাশীল নয়।
ডা. এ এম পারভেজ রহিম
পরিচালক, ডিএনএ ল্যাবরেটরি ম্যানেজমেন্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
পাঁচটি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন থেরাপি নিয়ে কাজ করছে। চিকিৎসা বিষয়টি টেকনিক্যাল একটি প্র্যাক্টিস। পৃথিবীতে যত ধরনের হাসপাতাল আছে সেখানে যারা কাজ করেন, তাদের সবাইকে একটি রেজিস্ট্রির মধ্য দিয়ে আসতে হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি টেইলর তার প্রমাণ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে জন্মগত ত্রুটি যেমন সেরিব্রো-ভাস্কুলার স্ট্রোক, নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজ-অর্ডার, ডাউন সিনড্রোম ইত্যাদি সেবায় থেরাপি বিশেষ কার্যকর। এজন্য সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সাহায্যসেবা প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। যেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন থেরাপি নিয়ে কাজ করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এনসিডি কর্নার ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে এ সেবা দিচ্ছে। বাকি চারটি মন্ত্রণালয় নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সেবা দিচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি হাইস্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসডিজি ৩ নম্বর লক্ষ্য অর্জনে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা। এ কাজে থেরাপিস্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন জেনারেল ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট ও অকুপেশনাল থেরাপিস্ট পদ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য কারিকুলাম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ডা. সাহাদৎ হোসেন
বিপিএ সাধারণ সম্পাদক
কাউন্সিল আইন বাস্তবায়নে বিপিএ জোরালো ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন বাস্তবায়নে বিপিএ শুরু থেকেই জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়ায় জনমত গঠন, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি ও সরকারকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২০১৮ সালে বিপিএ-এর আয়োজনে প্রথম আন্তর্জাতিক রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবী সম্মেলন করেছে। ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা, আন্তর্জাতিক অটিজম ও স্নায়বিক বিকাশ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সায়মা ওয়াজেদ। তিনি সম্মেলনে দেশের সব রিহ্যাবিলিটেশন পেশাজীবীকে নিয়ে কাউন্সিল গঠনে গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি এ পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা গঠনের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরই জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন পাশ হয়েছে। কাউন্সিল গঠনের পর থেকে কাউন্সিল প্রক্রিয়া শুরু করতে বিপিএ নিরলসভাবে কাজ করছে। কিন্তু মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যথা লাঘবে ফিজিওথেরাপি সেবার নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অপচিকিৎসা দিচ্ছে। এজন্য মানদণ্ড অনুসরণ করে সবাইকে কাজের বিষয়ে সজাগ করতে হবে।
ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী
সভাপতি
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
কাউন্সিল শক্তিশালী করতে রেজিস্ট্রার নিয়োগ জরুরি। আমি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একজন প্রতিনিধি হিসাবে বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে কাজ করছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর করোনার দুবছর ও পরবর্তী সময়ে এ কাউন্সিলের তেমন কার্যকর কাজ দেখেনি। এখন পর্যন্ত কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার নিয়োগ হয়নি। মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব রেজিস্ট্রারের কাজ করছেন। তাছাড়া কাউন্সিলের প্রধান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, যিনি ভীষণ ব্যস্ত। নিয়মিত কাউন্সিল সভা হয় না। ফলে বিপিএ’র সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না। একজন মানুষকে কর্মক্ষম তথা শারীরিকভাবে সচল রাখতে হলে সুস্থ থাকতে হবে। ফিজিওথেরাপিস্টরা এটি নিয়ে কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করায় অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন পাশ হয়েছে। দ্রুত আইন হলেও কার্যক্রম সেভাবে হচ্ছে না। কাউন্সিলকে আরও শক্তভাবে এ পেশাজীবীদের রেগুলেট করতে হবে। রেজিস্ট্রার নিয়োগের মাধ্যমে এটিকে আরও সক্রিয় করতে হবে।
ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
বিপিএ সভাপতি
হাসপাতালে ওষুধবিহীন সেবায় ফিজিওথেরাপি বড় চিকিৎসা পদ্ধতি। কেউ এ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন না করলে তাকে ফিজিওথেরাপিস্ট বলা যাবে না। ঢাকায় তিন হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন। ২১০০-এর বেশি ফিজিওথেরাপি ক্লিনিক আছে। কিন্তু সেখানে বেশির ভাগই অযোগ্যরা কাজ করছেন। সমন্বয়হীনতার কারণে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা খাত অসাধুদের হাতে চলে যাচ্ছে। এ পেশাকে মূলধারায় ফেরাতে হলে আমাদের যে রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আছে সেটিকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রুত নীতিমালা করে বৈধ প্র্যাক্টিশনারদের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে কেউ ওভার প্র্যাক্টিস করতে না পারেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের ছাড়া টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে অবশ্যই ফিজিওথেরাপিস্টদের দরকার। এজন্য উপজেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে টারশিয়ারি লেভেল পর্যন্ত এ পেশাজীবীদের পদ তৈরি করে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।
ডা. শহিদুল ইসলাম
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এনসিডিসি শাখা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
পঞ্চম এইচপিএনএসপির ওপিতে ফিজিওথেরাপি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। একজন মানুষ মারা যাওয়ার দুটি কারণের মধ্যে একটি কমিউনিকেবল ডিজিজ বা সংক্রামক রোগ। অন্যটি নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) বা অসংক্রামক রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এনসিডি বা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি প্রায় ৭০ শতাংশ। ডব্লিউএইচও আরও বলেছে, বিশ্বে ২৩টা গুরুত্বপূর্ণ অসুখের মধ্যে ৯ নম্বর হচ্ছে মাস্কুস্কেলেটাল ডিজিজ। যেটির বিশ্ব স্বীকৃত একটি সেবা ফিজিওথেরাপি। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সদা তৎপর। এজন্য এনসিডিসহ অন্যান্য সেবাদানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়মিত কাজের বাইরে এইচপিএনএসপি’র অধীনে অপারেশন প্ল্যান (ওপি) চলমান রেখেছে। বর্তমানে চতুর্থ এইচপিএনএসপি’র অতিরিক্ত দুই বছরের শেষ পর্যায়ের চলছে। ইতোমধ্যে ফিফথ এইচপিএনএসপি’র ওপি চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আশা করিছ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। এ ওপিতে ফিজিওথেরাপি এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন আলাদা ও স্বাধীন উপাদান হিসাবে যুক্ত হবে। এজন্য পর্যাপ্ত বাজেট দেওয়া হবে। এনসিডি প্রোগ্রামের আওতায় প্রত্যেক জেলা-উপজেলা হাসপাতালে পৃথক ইউনিট খোলা হচ্ছে। সেখানে ফিজিওথেরাপি বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। এছাড়া নতুন ওপিতে সব জেলা হাসপাতালে মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজঅ্যাবেলিটি ইউনিট থাকবে। যেখানে আমরা ৬৪টি জন ফিজিওথেরাপিস্ট নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। স্পিচ থোরপি ও অকুপেশনাল থেরাপিস্টদের রাখার চেষ্টা চলছে। এসব ইউনিটে যারা কাজ করবেন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়ক সরঞ্জাম সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকবে।
ডা. আতিকুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল
রোগীদের সমন্বিত চিকিৎসায় জোর দিতে ভাবতে হবে। দেশে প্রতি হাজারে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর হার ১১ দশমিক ৭ জন। ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি স্ট্রোক সেন্টার রয়েছে। সেখানে প্রতিবছরে গড়ে ৭ হাজার রোগী ভর্তি হন। যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্নভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। যাদের চিকিৎসায় আমাদের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপি জরুরি। এ রোগীদের অন্য চিকিৎসা সম্ভব হবে না যদি থেরাপিপ্রাপ্তির দিকটা দুর্বল থাকে। আমরা চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেখেছি এসব রোগী যখন আমাদের কাছে আসছে, ততক্ষণে তাদের অধিকাংশেরই ব্রেনের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। কেউ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত, কেউবা দুই পা, শরীর বা শরীরের একটি অংশ প্যারালাইজড হয়ে আসছে। তখন তারা একটু হলেও যেন স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় সেজন্য কিছু ওষুধ দিয়ে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া নিউরোসায়েন্সে অসংখ্য শিশু অটিজম, সেরিব্রোলপালসি সমস্যা নিয়ে আসছে। যাদের প্রধান চিকিৎসা নিয়মিত অকুপেশনাল বা স্পিচ থেরাপি। তবে যত্রতত্র এ চিকিৎসা দেওয়ায় অনেকে সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারছেন না। ফলে ফিজিওথেরাপি নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। এজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগ নিতে হবে। আরেকটি বিষয় নিউরোলজিক্যাল এবং নিউরোসার্জারি ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন। যেটি ছাড়া এ চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফলে এ রোগীদের সমন্বিত চিকিৎসা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।
ডা. ফিরোজ কবির
চেয়ারম্যান, ফিজিওথোরপি ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভুয়া ফিজিওথেরাপি ক্লিনিক ঠেকানো জরুরি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল ফর ডিজেবেল্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে যেটি জাতীয় অর্থোপেডিকস হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) নামে পরিচিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৮ সালে ‘বাংলাদেশে কলেজ অব ফিজিওথোপি’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে কলেজ অব ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নেন। কিন্তু ২০১০ সালে মহাখালীতে ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন হলেও সেটি আজ অবধি হয়নি। তবে ২০১২ সালের পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ১০৩টি জেলা প্রতিবন্ধী সাহায্য সেবা কেন্দ্র চালু রয়েছে। সেখানে একজন করে ফিজিওথোরপি কনসালট্যান্ট ও ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট কাজ করছেন। ফিজিওথেরাপিতে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়েছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সটি পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু যারা পাশ করে বের হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরে চাকরি করছেন, তারা রাজস্ব খাতভুক্ত হতে পারছে না। ২০১৮ সালে রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন পাশ হলেও এ পেশাজীবীদের জন্য জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে দেশজুড়ে শত শত ভুয়া ফিজিওথেরাপি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। যাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
আবুল খায়ের চৌধুরী
সিনিয়র জিএম-মার্কেটিং, যুগান্তর
ব্যক্তির অসুস্থতায় রোগের গুরুত্ব বাড়ে। একজন ব্যক্তির কাছে কোনো রোগের চিকিৎসা গুরুত্ব তখন বাড়ে, যখন তিনি নিজে বা তার পরিবারের কোনো সদস্য আক্রান্ত হন। আমি আহ্বান জানাব আজকের আলোচনায় যেসব দাবি ও পরামর্শগুলো উঠে এসেছে। নীতিনির্ধারকদের মাধ্যমে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান করব।
ডা. আলতাফ হোসেন সরকার
বিপিএ উপদেষ্টা
ফিজিওথেরাপি সেবা গ্রামে পৌঁছানো জরুরি। স্বাধীনতায় অংশ নেওয়া যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল ফর ডিজেবেল্ড চালু করা হয়। তখন ডা. গ্রাস্ট নামে একজন ভারতীয় চিকিৎসক এ সেবায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে পোস্ট কোভিড, পোস্ট চিকুনগুনিয়াসহ নানা কারণে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ব্যথায় ভুগছেন। সিনিয়র সিটিজেনের অনেকে ব্যাক পেইন, শোল্ডার পেইনসহ নানা সমস্যায় প্রতিবন্ধী অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। এ চিকিৎসার প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সেবাটি প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো যায়নি। ফলে যত্রযত্র প্রতিষ্ঠান খুলে অনেকে সেবার নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। ভুল মানুষের কাছে সেবা নিতে গিয়ে যোগ্য ও বৈধ সনদধারী পেশাজীবদের প্রতিও অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আইন রয়েছে। যেটির যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ না হলে এমনটা চলতেই থাকবে।
সাংবাদিক মোহসীন-উল-হাকিম
বিশেষ প্রতিনিধি
যমুনা টেলিভিশন
ফিজিওথেরাপির নামে অপচিকিৎসা বন্ধ জরুরি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণমাধ্যমে এর প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। পেশাগত কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে, এ নিয়ে যথাযথ চিকিৎসা মিলছে না। মানুষ এ চিকিৎসায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে না। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ সচেতনতামূলক সংবাদ প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন তা হচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি। আবার এ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিয়ে নানা ধরনের অপচিকিৎসাও হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডা. ফারজানা শারমিন
সঞ্চালক, কনসালটেন্ট, ফিজিওথেরাপি বিভাগ
সিআরপি ও মহিলা কল্যাণ সম্পাদক, বিপিএ
নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া জরুরি। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপি গত ৪০ বছর বিরামহীনভাবে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন সেবায় কাজ করে আসছে। সিআরপি’র একটি বড় বিভাগ হচ্ছে ফিজিওথেরাপি বিভাগ। ফিজিওথেরাপি বিভাগে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ প্রতিবন্ধী রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেজেট অনুযায়ী ব্যাচেলরস অব সায়েন্স ইন ফিজিওথেরাপি-এর ভর্তি যোগ্যতাকে তোয়াক্কা না করে একশ্রেণির অসাধু ফিজিওথেরাপিস্ট কাজ করছে। ক্লিনিক্যাল বা প্র্যাক্টিক্যাল সুযোগ না রেখে ভাড়া বাড়িতে ফিজিওথেরাপি ইনস্টিটিউট ও কলেজ গড়ে তুলছে, সেখানে অযোগ্য লোককে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। এটি বন্ধে কাউন্সিলের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে নিবন্ধন প্রদান জরুরি।