Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

প্রশান্তির খোঁজে ঐতিহ্যের লীলাভূমি মুন্সীগঞ্জ

Icon

লেখা ও ছবি রাজীব পাল রনী

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পৈতৃক নিবাস তবুও বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে মুন্সীগঞ্জের আশপাশে দর্শনীয় স্থান কখনো ঘুরে বেড়ানো হয়নি। বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভান্ডার মুন্সীগঞ্জ জেলার আশপাশ ঘুরে দেখার। মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন নাম বিক্রমপুর। ভ্রমণের দিন ঠিক করা হলো। কুয়াশামাখা স্নিগ্ধ সকালে আমরা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে ঢাকা থেকে রওনা হলাম মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে। আমার ভ্রমণসঙ্গী হলেন রূপন, কনা, পূর্ণিমা, রুদ্রদিপ কৌশিক, দিপ্তি, আশিক চন্দ্র মন্ডল, মেহেদী, হিমেল ও আকাশ। আমাদের প্রথম গন্তব্য ইদ্রাকপুর কেল্লা। ধলেশ্বরী নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু পার হয়ে পৌঁছায় ইদ্রাকপুরে মুন্সীগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল পুরোনো কাচারি সড়কের পশ্চিম পাশে কোটগাঁও এলাকায়।

এখানেই মুঘল স্থাপত্য ইদ্রাকপুর কেল্লা। কেল্লায় প্রবেশ করতেই অন্যরকম এক ভালো লাগা যেন ছুঁয়ে গেল আমাদের। এ কেল্লাটি তৈরি করতে ব্যবহার হয় ইট, চুন ও সুরকি। মুঘল সুবেদার মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে এ কেল্লাটি নির্মাণ করেন। সাড়ে তিনশ বছরের পুরোনো মুন্সীগঞ্জের ইন্দ্রাকপুর কেল্লা। কেল্লার প্রাচীর শাপলা পাপড়ির মতো। সিঁড়ি দিয়ে মূল দুর্গের চূড়ায় আমরা সবাই মিলে উপরে উঠি। সিঁড়ি পথ ধরে আমরা উপরে উঠেই অভিভূত হলাম এর অপূর্ব নির্মাণ কাজ দেখে। এ কেল্লাটি ২১০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২২৪ ফুট প্রস্থ। কেল্লার পাশেই রয়েছে ইদ্রাকপুর কেল্লা জাদুঘর। ১০ টাকার টিকিট কেটে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম আমরা। জাদুঘরে পোড়ামাটির মৃৎপাত্র, ঢাকনা, ল্যাম্পস্ট্যান্ড, কলম, পিরিচ, পাথরের টুকরা ও বিভিন্ন ছবি দেখলাম।

কেল্লার ভেতরে শানবাঁধানো ঘাটে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম অতীশ দীপঙ্করের জন্মভিটা দেখতে। রাস্তার দুপাশের গ্রামীণ পরিবেশ দেখতে দেখতে জেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্কর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সে পৌঁছে গেলাম। শুভেচ্ছা ফি ১০ টাকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। শ্রী জ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতীশ দীপঙ্করের জন্মভিটায় আমরা দেখতে পেলাম বৌদ্ধরীতিতে একটি পবিত্র স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এটিকে দীপঙ্কর স্মৃতি বা অতীশ দীপঙ্কর শান্তিস্তূপ বলা হয়। স্তূপকে ঘিরেই অবস্থিত পবিত্র উপাসনালয়। পবিত্র স্মৃতিস্তম্ভের ভেতরে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের কয়েকটি বৌদ্ধ মূর্তি। চীনা স্থাপত্যরীতি অনুসারে নির্মিত হয়েছে মন্দির ও গ্রন্থাগার। অতীশ দীপঙ্করের ভিটেমাটি পবিত্র শান্তিস্তূপ্তটি বর্তমানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসাবে পরিণত হয়েছে। আমরা এখান থেকে বেরিয়ে আবার রওনা হলাম প্রশান্তির খোঁজে। মাইক্রোবাস যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই মাইলের পর মাইল মন জুড়িয়ে গেল রোপণ করা গোল আলু গাছের জমি দেখে। রাস্তার দুই ধারে সবুজের সমারোহ। রাস্তার পাশে হঠাৎ চোখে পড়ল সরিষা ক্ষেত। শীতের সৌন্দর্য সরিষা ফুল। হলুদ ক্ষেত দেখে রুদ্রদিপ বায়না ধরল ছবি তোলার জন্য। তার প্রিয় হলদে সরিষা ক্ষেত। সরিষার ক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে তার ঘ্রাণ আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। আমরা একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে চোখ জুড়ানো সরিষা ফুলের সঙ্গে নিজেদের ছবি তুললাম। সরিষার ক্ষেতে নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রুদ্রর সঙ্গে সব বন্ধুরা।

ছবি তোলার পর্ব শেষ করে আমরা এখন রওনা করলাম সোনারং-এর জোড়া মঠ দেখতে। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম টংগিবাড়ীর সোনারং গ্রামে। সোনারং জোড়া মঠ বাংলাদেশের অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। সোনারং গ্রামে রূপচন্দ্র নামক এক বণিক দুই ধাপে মঠটি নির্মাণ করেন। বড় মঠটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার আর ছোট মঠটির উচ্চতা ১২ মিটার। মঠটি গোলাকার গম্বুজ আকৃতির। জোড়া মঠ হিসাবে পরিচিতি লাভ করলেও মূলত এটি জোড়া মন্দির। অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত সোনারং জোড়া মঠটি দেখে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে আমরা রওনা হলাম মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাটে। ভরপুর রোদে তেজ নেই, আকাশ কুয়াশা। শীতের অলস সূর্যটা আরও কিছুটা হেলে পড়েছে তখন দুপুর ২টা। পেটে টান পড়ে। পেট শান্ত করতে আমরা চলে এলাম প্রজেক্ট হিলসায়। ইলিশের মতো দেখতে আকর্ষণীয় আধুনিক রেস্তোরাঁ ‘প্রজেক্ট হিলসা’।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমার চলে এলাম পদ্মা নদীর উপর নির্মিত বাংলাদেশের দীর্ঘতম বহুমুখী সেতু ‘পদ্মা সেতু’ দেখতে। মাওয়া প্রান্তে শিমুলিয়া ঘাটে পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য দেখতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করলাম। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে নৌকায় এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা। আমরা একে একে ভাড়া করা নৌকায় গিয়ে বসলাম। নৌকায় বসে পূর্ণিমা গান ধরে- ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...। পদ্মা নদীর অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে নৌকা ভাড়া করে পদ্মা নদীর বুকে ঘুরে বেড়াতে পারেন। প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা মাওয়ার বাঁধ এলাকায় শহরের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান। শেষ বিকালে পদ্মায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন সূর্য অস্ত যাওয়ার মনোরম দৃশ্য। খোলা হাওয়ায় সময় কাটাতে চাইলে আসতে পারেন অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠা মাওয়ার পদ্মার পাড়। বিনোদনবঞ্চিত দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবনে কিছুটা হলেও স্নিগ্ধতার পরশ মিলবে পদ্মা নদীর তীরে। পশ্চিম আকাশের সূর্য ঢলে পড়েছে। অস্ত যাওয়ার ছবি ফ্রেমবন্দি করলাম ক্যামেরায়। এবার বিদায়ের পালা। কিন্তু মন যেন বিদায় দিতে চাইছে না। তবুও যেতে তো হবে, তাই আমরা সবাই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ ভ্রমণের স্মৃতি মনের গহিনে থাকবে আমাদের চিরকাল।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম