ভ্রমণ
সুনামগঞ্জের বারিক্কা টিলা
লেখা ও ছবি : সুমন্ত গুপ্ত
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যান্ত্রিক এ নগরে ব্যস্ততম দিনে সকাল শুরু হয় ঘড়ির অ্যালার্মে। শনিবার আসতেই মন বিষণ্ন হয়ে যায়। আগামীকাল আবার একঘেয়ে জীবনের পদাবলি শুরু। আর ভালো লাগছিল না কোলাহলমুক্ত ও সবুজে ঘেরা কোথাও যাওয়া দরকার। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। প্রাণ কেমন যেন হায় হায় করছিল। এর মধ্যে হঠাৎ প্রদীপ দাদার কল বেজে উঠল। দাদা আসছে সপ্তাহে সিলেটে আসবে ভ্রমণের নিমিত্তে। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম-হঠাৎ মনে হলো সুনামগঞ্জের দিকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে। সকাল হতেই তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যে যাওয়ার নিমিত্তে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল নয়টা আমাদের চার চাকার বাহন এগিয়ে চলছে। সুনামগঞ্জ অভিমুখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। কিন্তু সুনামগঞ্জের কোন জায়গায় তা ঠিক করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত দারস্ত হলাম আমার অফিস সহকর্মী মুসা ভাইয়ের কাছে। তিনি বললেন, বারিক্কা টিলার কথা। তবে সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় দেড়ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে বারিক্কার টিলায়। যাত্রা পথের সঙ্গীদের অভিমত ওই পথে যাওয়ার। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে গাছের ছায়া আমাদের অভিভূত করল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম সুনামগঞ্জ শহরে। আমাদের চার চাকার বাহনের কান্ডারি পলাশ ভাই বললেন, সুনামগঞ্জ শহর থেকে গাড়িতে গ্যাস ভরে নিতে হবে। শহরের বাইরে গেলে পরে গ্যাস বা তেলের কোনো পাম্প নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই আমরা গাড়িতে গ্যাস ভরার নিমিত্তে একটি সিএনজি পাম্পের সামনে দাঁড়ালাম। সেখানে বিশাল লাইন পরিলক্ষিত হলো কিন্তু কিছু করার নেই। বিরতির মাঝে আমরা পেটপূজার নিমিত্তে ঢুকে পড়লাম পাম্পের পাশের এক রেস্তোরাঁয়। পরিবেশ খুব একটা ভালো না, তার পরেও কিছু করার নেই। সেই সকালে বের হয়েছি পেটে দানাপানি কারও পড়ে নাই। পরোটা, সবজি, চায়ের অর্ডার দিল প্রদীপ দা। কিছু সময় পর আমাদের মাঝে পরিবেশন করা হলো খাবারগুলো। অনেক সময় পরে পলাশ ভাই গাড়িতে গ্যাস ভরতে পারলেন। এবার আমরা বারিক্কা টিলা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। মুসা ভাই আগেই বলেছিলেন প্রথমে আমাদের জাদুকাটা নদীর তীরে যেতে হবে, সেখান থেকে নৌকা করে পার হয়ে ইঞ্জিনচালিত যান করে যেতে হবে বারিক্কার টিলায়। আমরা চলছি পিচঢালা পথে, কিন্তু একটু পর পর পলাশ ভাই রাস্তার আগন্তুকের কাছে জানতে চাইছিলেন জাদুকাটা নদীর তীরে যাওয়ার রাস্তা কি ঠিক আছে? আমি মনে মনে অবাক হলাম, একটি দর্শনীয় স্থান কিন্তু কোথাও কোনো পথের নির্দেশনা নেই। কিন্তু আমরা অন্য দেশের দিকে চোখ ফেললে দেখব শুধু পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। কিন্তু আমার দেশ এ ক্ষেত্রে একদম পিছিয়ে। যাই হোক পথের বিড়ম্বনা ভোগের পরে আমরা এসে পৌঁছালাম জাদুকাটা নদীর তীরে। অসাধারণ রূপ জাদুকাটা নদীর। যেন চোখের পাতা ফেলতে মনে চায় না। একপাশে বাংলাদেশের সীমান্ত, ওপাশে ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া পাহাড়। চিত্রপটে আঁকা এক অপূর্ব ক্যানভাস। আমাদের সঙ্গে সর্ব কনিষ্ট ভ্রমণসঙ্গী আদৃতা খুব খুশি একটু পর পর বাবার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে। আমরা ধু-ধু বালুময় পথ পেড়িয়ে এগিয়ে গেলাম নৌকার ঘাটের দিকে। সূর্যদেবের প্রখরতা আমাদের একটু সইতেই হলো। নৌকার ঘাটে এসে এবার নৌকার জন্য অপেক্ষার পালা। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু যানবাহনও দেখলাম অপেক্ষা করছে ওপাড়ে যাওয়ার জন্য। অপরূপা সীমান্ত নদী জাদুকাটা। এ নদীর পানি এমনই স্বচ্ছ, নিচের বালি স্পষ্ট দেখা যায়। যেন বালি ও পানি খেলা করছে। অপেক্ষার পালা শেষ করে আমারা নৌকায় উঠলাম, বেশ বড় নৌকা। নৌকাটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল, ঠেলাগাড়ি নিল ওপাড়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমি একটু ভয় পেলাম বৈকি। কারণ আমি সাঁতার জানি না, তাই অল্প পানি দেখলেই বুকটা কেঁপে ওঠে। যাই হোক, ফেরির মাঝি আমাদের ওই পাড়ে পৌঁছে দিলেন। ফেরি থেকে নেমেই আমরা তিন চাকার বাহন নিয়ে নিলাম বারিক্কার টিলা দর্শনের উদ্দেশ্যে। গ্রামীণ ধুলোমাখা পথে আমরা এগিয়ে চলছি। উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দেওয়া একটু অসাধ্য, তবে নতুন গন্তব্যে যাওয়ার আনন্দে সেসব কিছু তুচ্ছ। প্রায় পৌনে একঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো। এবার হেঁটে ওপরে উঠতে হবে। আমরা সবাই নেমে হাঁটা ধরলাম। হেঁটে যতই উপরে উঠছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের তত বিমোহিত করছিল। মেঘালয় পাহাড়ে মেঘগুলো মনে হয় হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। পাহাড়ের গায়ে নানা রঙের মেঘের খেলা। মেঘ কখনো সবুজ পাহাড়কে ঢেকে দিচ্ছে, আবার কখনো তার রূপে বিলিয়ে দিচ্ছে তার আপন ভালোবাসায়। পাহাড় আর মেঘের সম্মিলনে এক অপরূপ শোভা। আমরা টিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বারিক্কার টিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখে মনে হবে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন, যা আপনাকে বারবার স্মৃতির পাতায় নিয়ে যাবে। কথা হলো ওই এলাকার এক প্রবীণের সঙ্গে তিনি বললেন, এ বারিক্কা টিলা বাংলাদেশের মানচিত্রে যেন স্বর্গের অংশ। একদিকে সবুজ পাহাড়, হাওরে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বিল, নদী। বর্ষায় পাহাড়ি রূপবতী জাদুকাটার বুকে স্রোতধারা। আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়া জাদুকাটার বুকজুড়ে ধু-ধু বালুচর। আইফেল টাওয়ার খ্যাত বারিক্কা টিলা থেকে ১২ মাস বিভিন্ন রূপবৈচিত্র্য উপভোগ করা যায়। পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সারি সারি উঁচু-নিচু খাসিয়া পাহাড়, সবুজ বনায়ন ও মাটিয়া পাহাড় যা প্রতিনিয়ত ছুটে আসা লোকজনের দৃষ্টি কাড়ে। এখানে রয়েছে হরেক রকম গাছগাছালি; রয়েছে বিশাল বনভূমিতে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে বলীয়ান আদিবাসী ও বাঙালি বসতি। রয়েছে তাদের নিজেদের গোছানো বাড়িঘর ও ফসলি জমি। আদিবাসীদের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আপনি যখন বারিক্কা টিলায় উঠবেন তখন আপনার মনে হবে আপনি বাংলার আইফেল টাওয়ার থেকে পুরো তাহিরপুর উপজেলাকে দেখছেন। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে গ্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু তখন আপনার চোখের সামনে অপার্থিব হয়ে উঠবে।
কীভাবে যাবেন
বারিক্কা টিলা বা বারেক টিলা দেখতে চাইলে প্রথমে সুনামগঞ্জ আসতে হবে। প্রতিদিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহণের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহণের বাস। এসব নন-এসি বাসে জনপ্রতি টিকিট কাটতে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা লাগে, আর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। সুনামগঞ্জ থেকে সিএনজি কিংবা মোটরসাইকেল ভাড়া করে সরাসরি বারিক্কা টিলায় আসতে পারবেন।