ভ্রমণ
ষাট গম্বুজ মসজিদের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য
সেলিম আল রাজ
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্থাপত্যের প্রতি বরাবরই টান ছিল আমার। অনার্স পর্যায়ে একটা সাবজেক্টও ছিল স্থাপত্য কলার ওপর। তখন থেকে আরও আগ্রহ জন্মে। আশপাশে অনেক জায়গা দেখার সুযোগও হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে প্রবল ইচ্ছা ছিল বাগেরহাটে যাওয়ার। ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হচ্ছিল না। অনেক দূরের পথ। আমাদের ঠিক উল্টো রাস্তা। সে কারণে হয়তো আমাদের অঞ্চল থেকে খুলনায় যাতায়াতটা তুলনামূলক কম। তাই বলে আমাদের সংকল্প কি আটকিয়ে রাখা যায়। হঠাৎ একদিন গল্পের ছলে কয়েকজন একমত হয়ে গেলাম খুলনা যাওয়ার ব্যাপারে।
তখন মার্চ মাসের প্রথম সাপ্তাহ। ঝকঝকে আবহাওয়া। গৌরীপুর থেকে হাওড় ট্রেনে চড়ে ঢাকায় পৌঁছে যাই বেলা তিনটায়। সন্ধ্যায় চিত্রা এক্সপ্রেসে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সঙ্গে শফিকুল ইসলাম মিন্টু, এমদাদুল হক, আব্দুল মালেক ও রাজু ভুঁইয়া। আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও মানসিক পার্থক্য তেমন ছিল না। সবাই সজ্জন। ট্রেনে ভিড় কম থাকায় নিজেরাই গল্পে মেতে উঠি। মাঝে মাঝে কম্পার্টমেন্টে শোনা যায় বিভিন্ন স্টেশনের নামের ঘোষণা। যাত্রীরা ওঠানামা করে।
যমুনা সেতু অতিক্রম করার সময় ট্রেনের গতি ছিল মন্থর। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করি যমুনা ব্রিজ ও নদীর রূপ। সেতুর পাশেই চলমান ছিল আলাদা আরেকটা রেল সেতুর কাজ। ট্রেনের গতির সঙ্গে বাড়তে থাকে রাত। তন্দ্রাচ্ছান্ন অনেকের সঙ্গে আমিও। মিন্টু কাকার আওয়াজ তন্দ্রা ভাব কাটিয়ে দিল। ‘ওই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। অন্ধকারের মধ্যেই দেখার চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব। ট্রেন চলছে তার আপন গতিতে। ভোর বেলা খুলনা স্টেশনে পৌঁছে যাই আমরা।
রেল স্টেশনের কাছেই রাজু ভূঁইয়ার মামা আলম সাহেবের বাসা। অতিথিপরায়ণ পরিবারের লোকজন। ফ্রেশ হয়ে দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলাম। শরীরে চাঙা ভাব এলো। সকালের নাশতা সেরে বের হলাম। সারা দিনের জন্য একটা অটোগাড়ি রিজার্ভ করে চলি আমাদের গন্তব্যের পথে। খুলনা শহরে কোথাও তেমন যানজট চোখে পড়েনি। পিচঢালা পথ। রাস্তায় এক টং দোকানে চা বিরতি নিলাম। এমদাদ ভাই পানপ্রিয় মানুষ। উনার সঙ্গে আমরাও সবাই পান নিলাম। পানগুলো বেশ বড় বড়। আমাদের এলাকায় এত বড় পান খুব একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। আবারও রওনা দিলাম। ছোট-বড় কয়েকটি ব্রিজ পেরিয়ে বারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা ষাট গম্বুজ মসজিদে। লালচে ইটের গড়া চমৎকার স্থাপনা।
আমাদের মতো অনেকেই এসেছে দেখার জন্য। আমার বহুল প্রতীক্ষিত একটা জায়গা। ঘুরে ঘুরে দেখলাম মসজিদের বাইরের চারপাশ। প্রাণ জুড়ে গেল। ইতোমধ্যে আজানের ধ্বনি উঠল। মসজিদের পশ্চিম পাশে ঐতিহাসিক ঘোড়াদীঘির ঘাটে গিয়ে ওজু করে ভেতরে প্রেবশ করলাম। নামাজ আদায় শেষে মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা হলো অনেকক্ষণ। ইমাম সাহেবকে নিয়ে মসজিদের ভেতর অংশের স্থাপত্য বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য পেলাম। মেহরাব, মিম্বার, খিলান ও দেওয়ালে সুন্দর অলঙ্করণ দৃষ্টি কাড়ে। মূলত বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে বৃহত্তম এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ। ইতিহাস ঐতিহ্যের কালের সাক্ষী এ মসজিদটি নির্মাণ করেন খানজাহান আলী। বিশাল আয়তকার মসজিদ ভবনটি মূলত ইট দ্বারা নির্মিত। মসজিদ অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট এবং প্রস্থ ১০৮ ফুট। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব প্রাচীরে এগারটি, উত্তর এবং দক্ষিণ প্রাচীরে সাতটি করে খিলানপথ রয়েছে। আভিধানিকভাবে ঘাটগম্বুজ অর্থ হলো ৬২টি গম্বুজ সংবলিত। তবে সাধারণভাবে মসজিদটিতে ৮১টি গম্বুজ পরিলক্ষিত হয়। মসজিদের ছাদে সাতাত্তরটি এবং চার কোণে কর্নার টাওয়ারের উপর চারটি। মসজিদের বিশাল গম্বুজ ও ষাটটি স্তম্ভ সম্ভবত একে ‘ষাট খামবাজ’ (খামবাজ অর্থ স্তম্ভ) হিসাবে জনপ্রিয় করে তোলে যা পরবর্তীকালে শাব্দিক বিবর্তনের মাধ্যমে মসজিদটিকে ষাটগম্বুজ হিসাবে পরিচিত করে তুলেছে। মসজিদের অলঙ্করণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পোড়ামাটির ফলক ও ইট সংযোগে সাধিত, তবে হালকা রিলিফের খোদাইকৃত বিরল প্রস্তর অলঙ্ককরণও এতে রয়েছে। দৈনন্দিন প্রার্থনা ছাড়াও মসজিদটি দরবার বা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ষাটগম্বুজ মসজিদ।
মসজিদের ভেতরে থেকে আবারও ঘোড়াদীঘি ঘাটে গিয়ে বসলাম। স্থানীয় লোকজন গোসল করায় ব্যস্ত। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। ঘোড়াদীঘিটি খাঞ্জালীর দীঘি নামে সুপরিচিত। এ দীঘিটির পরিমাপ ১২৪৭ (পূর্ব-পশ্চিম) ফুট ৭৪০ (উত্তর-দক্ষিণ) ফুট। কথিত আছে খানজাহান (র.) বাগেরহাটে ৩৬০টি দীঘি খনন ও মসজিদ নির্মাণ করেন। এ সুবিশাল দীঘিটি তিনটি মৌজার (মগরা, সুন্দরঘোনা ও বাজেয়াপ্তী সুন্দরঘোনা) অন্তর্গত প্রায় ৪০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এ দীঘির নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তির শ্রুতিকাহিনি রয়েছে, হজরত খানজাহান (র.) দীঘি খননোত্তর কালে দীঘিতে পানি না ওঠায় তিনি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে দীঘির অভ্যন্তরে পরিভ্রমণ করেন বলে এরূপ নামকরণ করা হয়। অনেকেই নানা রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি, মনোবাসনা পূরণের আশায় দীঘির পানি পান করে থাকেন কিংবা গোসল করে নিজেকে পবিত্র করে তোলেন। এ দীঘিটি ১৯৮৬ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকাভুক্ত করা হয়।
হাঁটতে হাঁটতে মসজিদ চত্বরের একপাশে অর্থাৎ মেইন ফটকের প্রবেশ পথের ডান পাশে ৫২০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে বাগেরহাট জাদুঘরে গেলাম। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রদর্শনী ছাড়াও একটি বহির্কোঠা বিদ্যমান। এখানে জাদুঘরে পরিচিতিমূলক বোর্ড ছাড়াও খলিফাতাবাদ থেকে বাগেরহাট, শহর মুহম্মদাবাদ থেকে দৌলতপুর, বারবাজার এবং গৌড়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত বিভিন্ন আমলের মুসলিম প্রত্ন ইমারতাদির আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। ১নং প্রদর্শনী কক্ষে (বাম দিক থেকে) পনেরো শতকের সুলতানি আমলের প্রাচীন শহর খলিফাতাবাদ থেকে প্রাপ্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসম্পদ এবং ২নং প্রদর্শনী কোঠা ষোল শতকের সুলতানি আমলের শহর মুহাম্মদাবাদ এবং ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদ দিয়ে সজ্জিত।
মসজিদের মূল ফটকের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক। কয়েকজন ভ্যান গাড়িতে ডাব বিক্রিতে ব্যস্ত। আমরা সবাই ডাব খেলাম। পাশে আরেকটা মসজিদ দেখা যায়। এক গম্বুজবিশিষ্ট সিঙ্গাইর মসজিদ। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে ১৫০ দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরঘোণা গ্রামে অবস্থিত। বর্গাকারে নির্মিত সিঙ্গাইর মসজিদের আয়তনে ক্ষুদ্র আকৃতির। দেয়ালগুলো দ্ইু আড়াই মিটার চওড়া। তার চতুরকোণে গোলাকার বুরুজ রয়েছে। বুরুজের কাছে কার্নিসগুলো বক্রকারে নির্মিত। পূর্বকোণে তিনটি এবং উত্তর-দক্ষিণে মুক্ত দরজা আছে। পশ্চিম দিকে একটি অলংকৃত মেহরাব। এ মসজিদটি পঞ্চদশ শতকে নির্মিত হয়। কিছু সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম খানজাহান আলীর সমাধি স্থলের উদ্দেশ্যে। হযরত খানজাহান আলী (র.) (জন্ম ১৩৬৯-মৃত্যু অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯) ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাগেরহাটের শাসক। এ আধ্যাত্মিক পুরুষ উলুঘ খান, খান-ই-আজম নামেও পরিচিত। তিনি বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার ঘটান। তার নেতৃত্বে অনেক মসজিদ ও দীঘি খনন করা হয়েছিল।
হজরত খানজাহান আলী (রা.) নব্বই বছর বয়সে ষাটগম্বুজ মসজিদের দরবার হলে এশার নামাজরত অবস্থায় পরলোকগমণ করেন এবং বাগেরহাটেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি স্থলের সম্মুখ অংশেই বিখ্যাত খানজাহান আলীর মাজার দীঘি অবস্থিত। দুইশ একর আয়তনের বিশাল এ দীঘিটি খনন করার পর যাতে কেউ দীঘির পানি নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দীঘিতে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছাড়া হয়।
এ কুমিরগুলোর কথা আগেও শুনেছি। আমরা সবাই ঘাটে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষায় ছিলাম। কুমিরগুলো কখন আসে যায় তার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। হঠাৎ দূরে দুইটা কুমির ভাসতে দেখলাম। বেশ বড়সড়। পানিতে স্রোত তোলে মাজার ঘাটের দিকে আসছে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। বর্তমানে পুরোনো আমলের একটি পুরুষ কুমিরসহ ২০০৫ সালে ২৪ জুন ভারতের মাদ্রাজ থেকে আনা ৪টি মিঠা পানির কুমিরের ৩টি এ দীঘিতে রয়েছে। খানজাহান আলী মাজার দীঘির কুমিরের রয়েছে কল্পকাহিনি। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখে দেখে সারাদিন কেটে গেল চোখের পলকে। স্মৃতি হয়ে রইল সবকিছু।