চলাফেরা করতেন ‘বিচারক’ লেখা গাড়িতে
আগাগোড়াই বেপরোয়া ছিলেন সমাজসেবা কর্মকর্তা রাসেল
আ.লীগের দাপটে সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার * প্রকাশ্যে ভোট চাইতেন নৌকায়

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আগাগোড়াই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন রিকশাচালককে জুতা ও লাঠিপেটা করে দেশব্যাপী আলোচিত পবা উপজেলার আওয়ামীপন্থি সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহিদ হাসান রাসেল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তাকে নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপট দেখাতেন রাসেল। দলীয় প্রভাবের কারণে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধঃস্তনদের সঙ্গে করতেন দুর্ব্যবহার। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা দুদফা লিখিত অভিযোগও দেন। তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এদিকে সাময়িক বরখাস্তের পর রাসেলের ব্যাপারে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পবার নওহাটা পৌরসভার ডাস্টবিন তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে রয়েছে-এমন ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বিচারক লেখা গাড়ি ব্যবহারের ছবিও ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট চাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাসেলের স্ত্রী একজন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ। ২০২৩ সালে তিনি রাজশাহীর আদালতে বদলি হয়ে আসেন। এরপর পবা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসাবে বদলি হয়ে আসেন রাসেল। তারপর থেকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আলোচিত হতে থাকেন তিনি।
সবশেষ ২ ফেব্রুয়ারি জাজ কোয়ার্টারের সামনে এক রিকশাচালককে জুতাপেটা করেন রাসেল। গাড়ি থেকে লাঠি বের করে লাঠিপেটাও করেন। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সোমবার (৩ মার্চ) রাসেলকে সাময়িক বরখাস্ত করে সমাজক্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তারা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিচারক লেখা গাড়িতে অফিসে আসতেন : নিজে বিচারক না হলেও তিনি স্ত্রীর ‘বিচারক’ লেখা দামি প্রাইভেটকারে অফিসে যাওয়া-আসা করতেন। রাসেল প্রায়ই এ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতেন। সম্প্রতি সমাজসেবা কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা এক নারীর ছোট শিশু ওই গাড়িতে হাত দেয়। তখন তেড়ে গিয়ে ওই শিশুকে ধমকান রাসেল। এরপর থেকে অফিস সহকারী সোহাগ আলীকে গাড়িটি পাহারার দায়িত্ব দেন তিনি।
পবার ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ বলেন, যিনি বিচারক, শুধু তিনিই বিচারক লেখা গাড়িতে চড়তে পারবেন।
অধস্তনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার : রাসেল পবায় যোগদানের পরই তার দুর্ব্যবহার ও অশোভন আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত বছরের ৩১ মার্চ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শিমুল বিল্লাহ সুলতানা পবার ইউএনওর কাছে রাসেলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগে তিনি লেখেন, রাসেল বিভিন্ন কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালনকালে নোটিশ না দিয়ে এবং তারিখ কিংবা আলোচ্যসূচি উল্লেখ না করে উপস্থিতির স্বাক্ষরের জন্য পাঠাতেন। স্বাক্ষর না করলে অশোভন আচরণ করতেন। গত বছরের ৬ মার্চ উপজেলা পরিষদ চত্বরে তিনি সবার সামনে অশালীন আচরণ করেন। নারী সহকর্মী হিসাবে তার আচরণে আমি বিস্মিত ও হতবাক। এমন আচরণ সরকারী কর্মচারী বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও দাপ্তরিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৬ মে পবা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী সমাজসেবা কর্মকর্তা শারমিন আফরোজ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তৎকালীন উপপরিচালক হাসিনা মমতাজের কাছে অভিযোগ দেন। তিনি উল্লেখ করেন, ১৪ মে তিনি অফিসে এলে সমাজসেবা কর্মকর্তা তাকে ডাকেন এবং জোর করে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন। তিনি মেসেঞ্জারের কথোপকথন চেক করেন এবং অধস্তন কর্মচারীদের সামনে তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত ও মন্তব্য করেন। এ অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। উলটো ওই নারী কর্মকর্তাকে পবা থেকে পুঠিয়া উপজেলায় বদলি করা হয়।
ভোট চাইতেন নৌকায় : রাসেল কট্টর আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজশাহী-৩ আসনের তৎকালীন এমপি আয়েন উদ্দিনের কথায় তিনি সরকারি বিভিন্ন উপকারভোগীদের নিয়ে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সমাবেশের আয়োজন করেন। এসব সমাবেশে আয়েন উপস্থিত থাকতেন। সমাবেশে রাসেল সবাইকে নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাতেন। যদিও ওই নির্বাচনে আয়েন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি।
জাহিদ হাসানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে পবার ইউএনও বলেন, এই সমস্ত বিষয়গুলো এখন আসছে। আগে কেউ বলেননি। রিকশাচালককে মারধরের ঘটনায় জেলা প্রশাসক আমাকে তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। বিষয়টি তদন্তের জন্য আমি একটি কমিটি করে দিয়েছি। তদন্ত শেষে যথাসময়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
রাস্তা দখল করে ফাউন্ডেশনের ফটক : রাসেলের গ্রামের ২০ জন ব্যক্তি ২ মার্চ টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, সরকারি রাস্তা দখল করে ফাতেমা ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটক নির্মাণ করা হয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের একটি সংগঠন এবং এর নেপথ্যে দলটির নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ আছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বরখাস্ত হওয়া সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহিদ হাসান রাসেলকে ফোন করা হলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে খুদেবার্তা (মেসেজ) পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি। তাই এসব বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।