সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পরিচিত। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। প্রাচীনকালে এই নদীর তীরে বসে ঋষিগণ বিদ্যাচর্চা করতেন। সেখান থেকে পরবর্তীকালে নদীটি বিলুপ্ত হওয়ার পর বিদ্যার দেবীতে পরিণত হয়েছে। পুরাণে বলা হয়েছে, দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। জ্ঞান, সংগীত, শিল্প, প্রজ্ঞা ও শিক্ষার দেবী সরস্বতী। পুরাণ অনুযায়ী দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার মুখ থেকে উৎপত্তি লাভ করেন। দেবী সরস্বতীর সব রকম সৌন্দর্য ও দীপ্তির উৎস হলো ব্রহ্মা। পূজার দিনে দেবী সরস্বতীর মূর্তির পরিধানে থাকে শ্বেতবস্ত্র অর্থাৎ সাদা রংয়ের কাপড়, যা পবিত্রতার নিদর্শন। সরস্বতীর সঙ্গে থাকে রাজহাঁস, যা বিশুদ্ধতার প্রতীক; পদ্ম হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক, বীণা হচ্ছে সংগীত এবং বই হচ্ছে শিক্ষার প্রতীক।
মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের পঞ্চমী তিথিকে বসন্ত পঞ্চমী তিথি বলে। একদিকে শীত যাই যাই করে, অন্যদিকে বসন্তের আগমন ধ্বনিত হয় আকাশে-বাতাসে। এই বসন্ত তিথিতেই বাগদেবী সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, রীতি অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি আর বসন্তের আগমন-এ দুই মিলে এর আরেক নাম বসন্ত পঞ্চমী।
যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জ্ঞান, বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী হিসাবে সরস্বতীকে পূজা করে আসছেন। ‘রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী’, এমন কথা অনেকের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, তবে এক্ষেত্রে কিন্তু দেবী সরস্বতী নিজেই রূপে-গুণে অদ্বিতীয়া। বিদ্যা, বুদ্ধি ও জ্ঞান সবকিছুতে তিনি সত্ত্বগুণময়ী। তাছাড়া বাকশক্তির প্রতীক হিসাবে বাগদেবী নামে তিনি পরিচিত। ঋগ্বেদে দেবী সরস্বতীকে নদীর রূপে কল্পনা করা হয়েছে, যিনি প্রবহমান কর্মের দ্বারা বিশালতার অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। সংগীত, শিল্প ও বিদ্যার দেবী হিসাবে তার এক হাতে বই আর এক হাতে বীণা। তাছাড়া পুরাণের কাহিনী অনুসারে জানা যায়, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরদের বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তি কল্পনা করা হয়েছিল, তা ছিল এই মহাসরস্বতী দেবীর মূর্তি।
সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। আর এই মাঘ মাসের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফল হলো কুল। তবুও মনের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে ছোটরা কখনোই সরস্বতী পূজার আগে কুল খায় না। কেননা সবাই চায় পড়াশোনায় ভালো ফল করতে। যেহেতু সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাই দেবীকে প্রসাদ হিসাবে এই ফল অর্পণ করার আগে খাওয়া কোনোভাবেই যাবে না। এই বিশ্বাস প্রাচীনকাল থেকে আজও বিরাজমান।
পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবী হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীকালে বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি শুধু বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন। ঋগ্বেদে সরস্বতীর সঙ্গে বিদ্যাধিষ্ঠাতৃত্বের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগ্দেবী, যে কারণে তার হাতে বীণা দেখা যায়।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ বা ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসাবেই পরিচিত পৃথিবীতে।
তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ