দেশে সম্ভাবনাময় নবায়নযোগ্য শক্তি
তুহিন চাকমা
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নবায়নযোগ্য শক্তি বলতে বোঝায় সেই শক্তি, যা প্রকৃতির অবিরাম প্রক্রিয়ায় পুনরায় উৎপাদিত হয় এবং এ শক্তি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনর্ব্যবহার করা যায়, যেমন-সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি ও বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও একাধিক চ্যালেঞ্জ এ খাতে বাধা সৃষ্টি করছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তির একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। বিষুবরেখার সন্নিকটে হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। বিশ্বব্যাংকের তৈরি সৌরসম্পদের মানচিত্র অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণাঞ্চল, উপকূলীয় দ্বীপসমূহ এবং পার্বত্য এলাকায় সৌর বিকিরণ বেশি হওয়ায় সেসব এলাকা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অধিকতর উপযোগী। অনুমান করা হয়, সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে সৌরশক্তি থেকে ১০৮৪.৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, যা দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ২০২৩ সালের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ২৩ শতাংশ এবং পাকিস্তান ৪৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার কারণে ভবিষ্যতে ব্যবসা ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং প্রবল অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বড় কোনো নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে এবং বর্তমান হারে ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ২০২৫-২০৩১ সালের মধ্যেই আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাবে। ফলে আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করতে হবে, যা ব্যয়বহুল। তাছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব তো আছেই। পক্ষান্তরে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উত্তরণের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার কমে যাবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে ধীর করবে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত ধোঁয়া ও দূষিত কণার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি পায়। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব। নবায়নযোগ্য শিল্পে বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এছাড়াও নবায়নযোগ্য শক্তি অর্থ সাশ্রয়েও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কেবল ২ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপন করা হলে বছরে জ্বালানি আমদানি বাবদ ১.১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে।
তবে নবায়নযোগ্য শক্তিতে উত্তরণ সহজ নয়। এক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ প্রারম্ভিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের পর তা সংরক্ষণের জন্য ব্যাটারি ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন, যা এখনো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের জন্য বড় পরিমাণ জমি প্রয়োজন। ফলে বসতি ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সম্ভাবনাময় এ খাতের উন্নয়নে দূরদর্শী, স্বচ্ছ ও টেকসই পরিকল্পনা দরকার। সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের মোট জমির মাত্র ৪ শতাংশ ব্যবহার করেই নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। জমির ঘাটতি মেটাতে ভবনের ছাদে সৌর প্যানেল স্থাপন, ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তির ব্যবহার কার্যকর সমাধান দিতে পারে। অর্থায়ন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বেসরকারি খাতকে আরও বেশি উৎসাহিত করা প্রয়োজন। ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে সহজ ঋণ ও সরকারি ভর্তুকি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
তুহিন চাকমা : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়