Logo
Logo
×

অল্পকথা

মহালয়া ভাবনা

Icon

রূপম চক্রবর্ত্তী

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মহালয়া তিথি সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কাশফুল ফুটলে শরৎ আসে, নাকি শরৎ এলে কাশফুল ফোটে-এসব নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু মহালয়া এলেই যে দুর্গাপূজা এসে যায়, তা নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই। মহালয়া এলেই দেবী-বন্দনার সুর ধ্বনিত হয় বাংলার হৃদয়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত কম্পন, মা আসবেন সেই অপেক্ষায় থাকে ভক্তকুল। ‘মহালয়া’ শব্দটির অর্থ মহান যে আলয় বা আশ্রয়। শব্দটিকে স্ত্রীবাচক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কারণ এ দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়। মহালয়া ‘আনন্দ নিকেতন’ শব্দের সমার্থক। দেবী মায়ের আগমনি সুরে আনন্দের বার্তা আসে পৃথিবীজুড়ে। দেবীপক্ষের সূচনাকালেই ধরাধামে আবির্ভূত হন দুর্গা। মহালয়া থেকে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতি অর্ধমাসে একবার করে পূর্ণিমা ও অমাবস্যা হয়, তাই দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিনে অর্থাৎ পূর্ণিমায়। এ দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দিনটিতে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করে থাকেন।

দুর্গাপূজা মূলত পাঁচ দিনব্যাপী হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা। মহালয়ার আগের ১৫ দিন এবং মহালয়ার পরের ১৫ দিন সনাতনী সম্প্রদায় তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং মাতৃ আরাধনায় নিজেদের সমর্পিত করেন। সনাতন ধর্মের ইতিহাস অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। মানুষের বিশ্বাস, এ সময় পূর্বপুরুষরা পিতৃলোক ছেড়ে তাদের উত্তরপুরুষদের বাড়িতে অবস্থান করেন। পরে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে তারা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে তাদের উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়। মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু। হিন্দুধর্ম মতে, পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির আগের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এটি স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এ কারণে কেবল জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়, তাদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং গোত্রের পিতাকে স্মরণ করা হয়। এ কারণে একজন ব্যক্তির পক্ষে বংশের ছয় প্রজন্মের নাম স্মরণ রাখা সম্ভব হয় এবং এর ফলে বংশের বন্ধন দৃঢ় হয়। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্র বলছে, ‘ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম পিতা হি পরমন্তপঃ/পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।’

হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে, অশুভ শক্তির বিনাশ আর ধর্ম রক্ষায় যুগে যুগে মর্ত্যলোকে দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায়ই অসুরকুলের হাত থেকে দেবগণকে রক্ষায় দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল। পৃথিবীতে যখনই ব্রহ্মার বরপ্রাপ্তির মতো শক্তিশালী মহিষাসুরেরা ফিরে আসে, ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের ত্রাস-সংহারে দেবী দুর্গা ফিরে আসেন বারবার। আর দেবীর এ শুভাগমন ঘটে শুভ মহালয়ায়। এ পবিত্র তিথি আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে। এই শ্রদ্ধাকে যদি আমরা সমাজ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে সমাজ সুন্দর হবে।

রূপম চক্রবর্ত্তী : সনাতন ধর্মীয় বক্তা ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম