
প্রিন্ট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪৪ পিএম

আলম শামস
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
সময় বদলেছে। বদলেছে প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া। বদলেছে মানুষের মন, মনন, চিন্তাচেতনা, আদর্শ ও বিশ্বাসও। তেমনিভাবে বদলেছে জীবনের গতিপ্রকৃতি।
কয়েক বছর ধরে চরম বৈরী আচরণ করছে আবহাওয়াও। এর ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে ক্রমেই বিপর্যস্ত। বেড়ে গেছে ভারী বর্ষণ। বৃষ্টিপাতেও ব্যাপক অসংগতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বন্যা, পাহাড়ি ঢল, পাহাড়ধস, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো ও বজ্রপাত। অথচ মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের উত্তর জনপদ। পাহাড়ি অঞ্চলে অতিবৃষ্টি-ধস বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। তবে এ বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো দুর্বল। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা বার্ষিক গড়ে অন্তত ২৫০ মিলিমিটার। সীমিত জায়গা বা এলাকায় হঠাৎ কিংবা স্বল্পসময়ের মধ্যে অতিবর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বেড়েছে জনদুর্ভোগও। রাজধানীসহ বড় বড় শহর-নগরে পানিবদ্ধতা ও দুর্ভোগের এটি অন্যতম কারণও। চলতি বছর বর্ষাজুড়ে দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা গত বছরের ৩২ শতাংশ বেশি। এবার বর্ষার পরও ভাদ্র মাসজুড়ে বর্ষাকালের মতো অতিবৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল এমনকি চীনেও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দুর্যোগ ও দুর্ভোগের মাত্রাও।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়া আবহমানকালের চিরচেনা রূপ ও বৈশিষ্ট্যের বদল হয়েছে। এলোমেলো হয়ে উঠছে আবহাওয়া ও পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। ক্রমাগত অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবহাওয়া। বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। নিত্যনতুন দুর্যোগ-দুর্ভোগ ও সংকট তৈরি হচ্ছে। ফল-ফসলের উৎপাদন ব্যাহত এবং উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্বাভাবিক মতিগতি এবং চরম ভাবাপন্নরূপে দেখা দিচ্ছে আবহাওয়া। চিরায়ত ষড়ঋতুর আদি চরিত্র পালটে যাচ্ছে। পঞ্জিকার ছকে ‘বর্ষা’য় বৃষ্টি ঝরে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অকালে’ অঝোর বর্ষণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। বছর বছর অনাবৃষ্টি ও খরার প্রকোপ বেড়ে গিয়ে মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে বরেন্দ্রভূমিসমেত দেশের সুবিশাল উত্তর জনপদ। অন্যদিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘন ঘন প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ও অতিবর্ষণে ভাসছে। ছোট ছোট জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বাড়ছে। গ্রীষ্মের খরতাপ যেন মরুর আগুনের হলকা। অসহনীয় ‘গরমকাল’ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, কিন্তু শীতের দাপট চলে অল্প কিছুদিন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত আলাদা করে জনজীবনে তেমন আর অনুভূতি জাগায় না।
পরিবেশবিদরা বলছেন, আবহাওয়া-জলবায়ু হয়ে উঠছে রুগ্ণ খেয়ালি বৈরী এমনকি রুদ্র রুক্ষ প্রলয়ংকরী। অনেক সময়েই পূর্বাভাসের সঙ্গে মিলছে না। মানুষবান্ধব নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন জটিল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আবহাওয়ার বিরূপতা জীবনযাত্রায় চরম অনিষ্ট ও দুর্ভোগ ডেকে আনছে। এর ফলে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে মানবসম্পদের সার্বিক উৎপাদনশীলতা। কমছে সক্ষমতার হার। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি ও করাল গ্রাসে বসতি হারিয়ে প্রতিবছর পিছু হটে মূল ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে আসছে উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চলের ভূমি ও বসতিহারা অভাবী মানুষজন। সাগরের উপরতল ফুলে-ফেঁপে উঠছে। উপর্যুপরি সতর্কসংকেত দেখানো হচ্ছে সমুদ্রবন্দরগুলোকে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামায় চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া জেঁকে বসেছে।
অতিসম্প্রতি পর্যবেক্ষণ অনুসারে, আবহাওয়া-জলবায়ুর অন্যতম প্রধান নিয়ামক ও সূচক বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ব্যাপক অসংগতি হচ্ছে। গত কয়েক মাসেই সারা দেশে সামগ্রিকভাবে গড় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তবে এলাকাভেদে কমবেশি বৃষ্টি বা তারতম্য ঘটেছে। অথচ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কমই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত ৮ মাসের আবহাওয়ায় সারা দেশে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিক হারের চেয়ে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। বাতাসের আর্দ্রতায়ও খুব হেরফের হচ্ছে। এতে অনুভূত হচ্ছে অসহনীয় ভ্যাপসা গরম। বছরের বছরের অধিকাংশ সময়ই গুমোট হয়ে থাকছে আবহাওয়া। এ কারণে নৌ-চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনাও। মারাত্মক ভাঙন বিস্তৃত হচ্ছে সমুদ্র উপকূল ও নদনদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায়। বৈরী জলবায়ু পরিবেশের মুখে ক্ষতির শিকার গৃহস্থ অসংখ্য মানুষ হারাচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু, চাষবাসের জমি। এদের বলা হচ্ছে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। ‘মোরা’, ‘সিডর’, ‘নার্গিস’, ‘আইলা’, ‘কোমেন’-এর মতো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও ভূমিধসের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
গত বছরে এ যাবৎ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি (তাছাড়া গভীর সঞ্চারণশীল মেঘ, মৌসুমি বায়ুচাপে তারতম্যে আধিক্য) ইত্যাদি কারণে সতর্কতা সংকেত দেখাতে হয়েছে ৫৮ দিন। ঘনঘন লঘুচাপ, নিম্নচাপ সৃষ্টির কারণে আশান্ত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও উপকূল। বিরূপ আবহাওয়ায় মাছ শিকারের উপায় নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ার কারণে দেশের ৭১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলভাগ চর ও দ্বীপাঞ্চলের অন্তত দুই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে-এমনটি আশঙ্কা বিশেষজ্ঞ মহলের।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর আদি বৈশিষ্ট্যগুলোর ওলট-পালটের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার নাভিমূলে বঙ্গোপসাগরের কিনারাজুড়ে, হিমালয়ের ভাটিতে ভৌগোলিক বিশেষ অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব বেড়েই চলেছে। অধিক জনবহুল অথচ দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশের জনবসতি, কৃষি-খামার, জীবিকা, জনস্বাস্থ্য, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ জনজীবনের নানামুখী ক্ষেত্রে গিয়ে পড়ছে এর কমবেশি ধকল। আকস্মিক ও অসময়ে বন্যা, পাহাড়ি ঢল, খরা, হঠাৎ অতিবৃষ্টি, পানিতে আর্সেনিক ও লবণাক্ততার আগ্রাসন মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাদুর্ভাব ঘটছে অতি আর্দ্র ও উষ্ণতা, মৌসুমি ভাইরাসজনিত (ট্রপিক্যাল) হরেক রোগ-ব্যাধি যেমন সর্দি-কাশি প্রদাহজনিত জ্বর, বাতজ্বর, ফ্লু, পেটের পীড়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও ট্রপিক্যাল রোগ। রোগবালাই প্রতিরোধক ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকুল হারিয়ে ফেলছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। বাড়ছে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সংক্রমণ। কৃষিজ খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে কম, পুষ্টিমানও লোপ পাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১ শতাংশ হারে ভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় প্যারাবনের আকার-আয়তন কমে যাচ্ছে। জনজীবনে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। উপকূলীয় বাসিন্দারা বাস্তুহারা হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের মাঝে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। নৌপথে পরিবহণ হচ্ছে ব্যাহত, বাড়ছে ঝুঁকি। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক মাছের বিচরণ বিঘ্নিত হচ্ছে। মাছের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। সাগরে মাছসহ প্রাণিজগতের খাদ্যশৃঙ্খল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ জনজীবনের বিরূপ প্রভাব ফেলছে।