তাদেরকে বৈশ্বিক চেতনায় প্রবলভাবে দানবীয় করে তোলা হয়েছে

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজা, যেখানে কিছুই নেই, আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ। তবুও তো আছে! স্মৃতির গহিন থেকে উঁকি দেয় এক সময়কার সেই ছাদ, সেই বারান্দা, সেই অলিভ বাগান। স্মৃতিতে যা অক্ষত, তারই ক্ষতবিক্ষত রূপের সামনে আজ দাঁড়িয়ে গাজার মানুষ। তবু বৈধ তাদের মাতৃভূমিকে ভালোবেসে কষ্ট ভুলে থাকার আদিম আকাঙ্ক্ষাটুকু। তাদেরই একজন মোহাম্মদ এল-কুর্দ। এই লেখক, কবি, সাংবাদিক তার Perfect Victims: and the Politics of Appeal -এ তিনি শৈশবে প্রথমবার ইসরায়েলি দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। বহু সম্মাননা ও পুরস্কারপ্রপ্ত এ লেখকের বই ‘পার্ফেক্ট ভিকটিমস’ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে যে, সহানুভূতি পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের কতটা অসম্ভব মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। মোহাম্মদ এল-কুর্দ এই বই এবং গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কথা বলেছেন লিট হাব’র সঙ্গে। অনুবাদ মেজবাহ উদ্দিন
যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ শেষে আপনার অনুভূতি কেমন?
: মিশ্র। একদিকে আশা জাগ্রত হয় এবং গর্ববোধ হয় যে গাজার জনগণ অনেক দিক থেকে গণহত্যার উদ্দেশ্যকে পরাজিত করতে পেরেছে। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা যেন তাদের দৃঢ়তা ও স্থিতিস্থাপকতাকে কেবল রোমান্টিক দৃষ্টিতে না দেখি, কারণ তাদের অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং অনেকেই জায়নিস্ট শাসকের হাতে নিহত হয়েছে। স্পষ্টতই, মৃত্যুর সংখ্যা আমরা যা জানি তার তুলনায় অনেক কম বলা হয়েছে। আমার কাছে সবচেয়ে প্রবল যে অনুভূতিটা হয় তা হলো ব্যর্থতার বা পরাজয়ের অনুভূতি। আমরা এ গণহত্যা থামাতে পারিনি। আমাদের মতো কর্মী ও ইতিহাসের সঠিক দিকে থাকা মানুষদের প্রচেষ্টায় এটি বন্ধ হয়নি।
মানুষ কীভাবে ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে এ ধরনের বর্ণনার মাধ্যমে দেখে যে, তারা সব সময়ই টিকে থাকবে?
: এটি শেষ পর্যন্ত আরেকটি রূপকথার সৃষ্টি করে। মূলধারার বর্ণনায় ঐতিহ্যগতভাবে ফিলিস্তিনিদের এমন একটি ভীতিকর সন্ত্রাসবাদীর রূপ দেওয়া হয়েছে, যারা আপনার প্লেন ছিনতাই করবে বা আপনার স্ত্রী-সন্তানদের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাবে। এবং অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের এমন এক পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত করা হয়েছে যারা সবকিছু সহ্য করতে পারে, পাহাড়ের মতো অটল, যারা কখনো ভাঙবে না বা পরাজিত হবে না।
আমি মনে করি এটি বিপজ্জনক; কারণ আপনি এই চরম দুটি দৃষ্টিভঙ্গির যে কোনো একটিকে প্রহণ করলেও, ফিলিস্তিনিদের মানবিক রূপ মুছে ফেলছেন। আপনি তাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলো সংকীর্ণ করে দিচ্ছেন, তাদের মানবতার পরিধিকে সংকুচিত করছেন।
কিন্তু একইসঙ্গে, আমি মনে করি এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের জন্য শক্তির, দৃঢ়তার এবং অবিচলতার একটি চিত্র তৈরি করুক। কারণ এ ধরনের লোককথা, গল্প, শিক্ষকদের বা বাবা-মায়ের কাছ থেকে শোনা বর্ণনা আপনাকে বিশ্বে নিজের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষত যখন আপনার ওপর রকেট হামলা চলছে বা দখলদার শাসকের বুটের নিচে জীবন কাটাতে হচ্ছে।
কারণ এমন অসংখ্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যা আপনার আত্মাকে ধ্বংস করতে চায়, রয়েছে কারাগার, প্রাচীর ও অবরোধ; যা আপনার মনোবল ভেঙে দিতে চায়। এবং এই দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের গল্পগুলোর মাধ্যমে আপনি এমন একটি শক্তিশালী চরিত্র তৈরি করতে পারেন, যা দীর্ঘ বছরের কারাবাস বা অবরুদ্ধ জীবনের ভার সহ্য করতে সক্ষম।
আপনার বইয়ে আপনি বলেছেন-‘জেল একটি অদ্ভুত জায়গা স্বাধীনতা খোঁজার জন্য, কিন্তু তাও কিছু মানুষ সেখানে তা খোঁজে।’ আপনি এখানে হুই পার্সি নিউটনের (আফ্রিকান আমেরিকান বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক কর্মী) রেভল্যুশনারি সুইসাইড বইটি থেকে ভাবার্থ গ্রহণ করেছন। যেটা সেই প্রসঙ্গটিকে আরও গভীরে নিয়ে যায়, যেখানে আপনি বলেছেন-শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় এমনকি দখলদারত্বের মধ্যেও, এমনকি বন্দিত্বের মধ্যেও
: আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম যখন নিউটনের রেভল্যুশনারি সুইসাইড বইতে এটি প্রায় শব্দে-শব্দে মিলে গেল, এবং আমি এটিকে আমার লেখায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি এটি ভাবার্থে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম কারণ আমার কাছে এ সমান্তরাল দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা কেবল ‘আমরা সবাই নিপীড়িত’ বা ‘আমরা সবাই প্রান্তিক’ ইত্যাদি পরিচয়ভিত্তিক ধারণার বাইরে গিয়েও অনেক কিছুকে প্রকাশ করে।
কিন্তু কেবল নিপীড়নই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে না, আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে সেসব উপায়, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, লড়াই করেছি। আমাদের এ অটলতা, প্রতিরোধের মনোভাব এবং জেদই আমাদের সংযুক্ত করে। একইসঙ্গে, আমি মনে করি এ বইয়ের মূল যুক্তি-যে আমাদের নিখুঁত শিকার হওয়া যাবে না-আর এটি খুবই মৌলিক এক ধারণা। এটি বহুবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি সংগ্রামে এবং কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিক ঐতিহ্যে। এটি নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, বিশেষ করে যখন আলোচনা হয় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়াদের কীভাবে দেখা উচিত সে সম্পর্কে।
এ বইটি সেই যুক্তিটিকে আরও প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে এবং পাঠকের কাছে একের পর এক জটিল শিকার বা ‘ইমপারফেক্ট ভিকটিম’-এর কাহিনি তুলে ধরে পাঠককে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছে। যেন পাঠক নিজে উপলব্ধি করতে পারে-এ যুক্তিটি কতদূর পর্যন্ত তার গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে পড়ে।
আপনি এ বইয়ের ‘অলৌকিক এপিফ্যানি’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন, কীভাবে আপনাকে ‘বর্ণনা করার অনুমতি’ দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে আপনি এ বিষয়ে লড়াই করেন যে, অনেক লোক আপনাকে ফিলিস্তিনি আন্দোলনের একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেখে। আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?
: আমি মনে করি এটি খুবই বিপজ্জনক, যখন কোনো পাবলিক ফিগার বিশ্বাস করেন যে, তারা একটি বৃহৎ শ্রোতার কাছে পৌঁছতে পেরেছেন শুধু যোগ্যতার কারণে। আমি বুঝি যে, বিভিন্ন পরিস্থিতির সমন্বয় আমাকে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আমিই একমাত্র ফিলিস্তিনি নই যার বাড়ি দখল করা হয়েছে। এবং ফিলিস্তিনে আমাদের এলাকাই একমাত্র এলাকা নয়, যা উপনিবেশবাদী সংগঠন দ্বারা সক্রিয়ভাবে জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাক্রমে, আমরা এমন একটি সুন্দর এলাকায় বসবাস করতাম, যা দূতাবাস ও কনসুলেট দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, যেখানে অনেক তথাকথিত প্রবাসী বসবাস করতেন এবং তারা তাদের বারান্দা থেকে টিয়ার গ্যাস দেখতে পেতেন এবং এ বিষয়ে কিছু বলতে বাধ্য হতেন।
সুতরাং, আমার ইংরেজি বলার নির্দিষ্ট শৈলী, আমার আমেরিকান ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি নির্দিষ্ট মাত্রার বোঝাপড়া, আমার চেহারার ধরন-এসব কিছু একসঙ্গে মিলিয়ে আমাকে এমন একটি অবস্থানে এনেছে যেখানে আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি এবং এ ধরনের সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করার উপায় খুঁজতে পারি।
আপনি লিখেছেন যে, দখল সম্পর্কে কথা বলার জন্য প্রথমবার যখন আপনি সংবাদমাধ্যমের দ্বারস্থ হন তখন আপনি শিশু ছিলেন এবং এটি আমাকে গাজার শিশুদের সেই সংবাদ সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর আয়োজন করেছিল। আপনি কি আলোচনা করতে পারেন কেন শিশুদের নির্দোষতাকে প্রায়ই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়, যদিও আমরা জানি যে তাদেরও এ সহিংসতা থেকে রেহাই দেওয়া হয় না, বরং অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃত লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে?
: এ ধরনের কৌশল আমরা এখানে-সেখানে প্রয়োগ করি-এবং শেষ পর্যন্ত শিশুরাই এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয়। এটি মূলত এ বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় যে, তারা ‘কলুষমুক্ত’ বা ‘পবিত্র।’ তারা এক ধরনের নিরপেক্ষ পক্ষপাতহীন চরিত্র; এ ধারণা থেকেই আমরা শিশুদের মঞ্চে তুলে দিই। এমনকি আমরা শিশুদের কংগ্রেসে কথা বলতে পাঠাই।
আমাকেও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং কংগ্রেসে কথা বলতে পাঠানো হয়েছিল, আমি ওবামাকে চিঠি লিখেছিলাম ইত্যাদি, কারণ এখানে একটি প্রচ্ছন্ন উপলব্ধি রয়েছে যে শ্রোতারা, যাদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি, যেসব আইনপ্রণেতারা আছেন, তারা বর্ণবাদী এবং তারা স্বেচ্ছায় প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি পুরুষদের সঙ্গে বসবেন না, যাদের বৈশ্বিক চেতনায় প্রবলভাবে দানবীয় করে তোলা হয়েছে।
কিন্তু এ কৌশলের সমস্যা শুধু শিশুর মানসিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের পুরুষ ও নারী এবং আমাদের শিশুদের মধ্যে একটি দূরত্বও তৈরি করে এবং একটি বিচ্ছেদ ঘটায়। আমরা এমনভাবে কাজ করি যেন এ শিশুরা নিছক এক ধরনের অচেনা সত্তা, যারা এ নির্বোধ সংঘাতের পটভূমিতে কেবল বিদ্যমান, অথচ বাস্তবে তারা ফিলিস্তিনি সংগ্রামের অংশ ছিল এবং রয়েছে, বহু উপায়ে, বহু সময় ধরে।
তাই শিশুদের বিষয়টি নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে, তবে এটি শেষ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টার মধ্যে পড়ে যে, আমরা কিছু মিথ তৈরি করি, কিছু এমন জিনিস খুঁজে বের করার চেষ্টা করি যা নির্দিষ্ট শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাবে এবং এর চারপাশে একটি শিল্প গড়ে তুলি এ আশায় যে, এটি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু আমরা বারবার দেখেছি যে, এ কৌশল আমাদের বিরুদ্ধেই গেছে। আমরা দেখি স্নাইপাররা শিশুদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়, তাদের মাথায় গুলি করে হত্যা করে যখন তারা সৈকতে ফুটবল খেলছিল। এমনকি শিশুদের সাধারণ চিত্রকলা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। আমার মনে হয়, নিজেদের নির্দোষতার (‘ফ্রেমওয়ার্ক’)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা, যা শিশুদের সঙ্গে জড়িত, শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই কাজ করছে।
সূত্র : লিট হাব