Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

পাখির পায়ের তলায় ভাগ হয়ে গেছে সময়

Icon

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রমথ চৌধুরী তার ‘সাহিত্যের ভাষা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘কথার যে শুধু শব্দ তাই নয়, রূপ, তেজ এমনকি গন্ধও আছে। কবি কথার এ পঞ্চগুণের সন্ধান রাখেন।’ বিভিন্ন উপাদানের একত্রীকরণ কাব্যের প্রাণস্বরূপ। সব উপাদান একত্র করে কথা বললে কথায় শব্দ, রূপ, তেজ, গন্ধের সমন্বয়ে ঘটনাবলি বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত হয়। কবিরা নানাভাবে, বিচিত্র ছন্দ, বিচিত্র প্রসঙ্গ, অজস্র রীতিবৈচিত্র্যের মাধ্যমে শব্দ নিয়ে খেলা করে। অনুকরণ অনুসরণও কাব্যধারায় কম পাওয়া যায় না। রবীন্দ্র অনুকরণ থেকে বেরিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৩০-এর দশকের কবিদের এক রকম আন্দোলন করতে হয়েছিল।

কবিরা কখনো সরল ভাষায় ছন্দ মিলিয়ে উপমা, উৎপেক্ষা, রূপক ও চিত্রকল্পের সাহায্যে সহজেই পাঠকের মন আকৃষ্ট করে, আবার কখনো তারা ‘সন্ধা ভাষা’য় (সন্ধা ভাষা অর্থ অভিসন্ধিত বা অভিপ্রায়যুক্ত ভাষা) কথা বলেন যা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণের বোধগম্য হয় না, শুধু বোদ্ধা পাঠকই তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। যেভাবেই বলা হোক, কবিতায় সর্বদাই সমাজের বাস্তবচিত্র প্রতিফলিত হয়। শব্দই কবিতার প্রাণ। এমনি শব্দের ভেতর ওতপেতে বসে থাকা কবি মালেক মুস্তাকিম। যার কবিতায় ম্যাজিক রিয়েলিজম স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে। তার ধ্যানমগ্নতা, বিশ্বজনীনতা, প্রেম-ভালোবাসা ও প্রকৃতি বন্দনায় ঋদ্ধ এমনই এক ম্যাজিক রিয়েলিজম কবিতার বই ‘সেলাই করা হাওয়ার গান’।

মালেক মুস্তাকিমের কবিতা পড়ে রস আস্বাদন করার আগে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তববাদ সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা থাকা আবশ্যক। জাদুবাস্তববাদ কী? জাদু বাস্তববাদ হলো সাহিত্যের একটি ফর্মেট, নমুনা বা গঠন। যতদূর জানা যায় জাদু বাস্তববাদ প্রধানত ল্যাটিন-আমেরিকান বর্ণনামূলক কৌশল যা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত কল্পকাহিনিতে চমৎকার বা পৌরাণিক উপাদানগুলোর বিষয়-অবস্থার অন্তর্ভুক্তি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যদিও এ কৌশলটি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতির সাহিত্যে পরিচিত, তবে জাদু বাস্তববাদ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন ১৯৪০-এর দশকে কিউবান ঔপন্যাসিক আলেজো কার্পেন্টিয়ার, যিনি এ বৈশিষ্ট্যকে অনেক ল্যাটিন-আমেরিকান সাহিত্যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

জাদুবাস্তববাদ এই পৃথিবীর এমন একটি পরিবেশে ঘটে যা পাঠকের কাছে পরিচিত। এর উপাদান কথা বলা বস্তু থেকে শুরু করে মৃত চরিত্র এমনকি টেলিপ্যাথি পর্যন্ত। প্রতিটি জাদুবাস্তববাদের কবিতায় এমন কাল্পনিক উপাদান থাকে, যা আমাদের পৃথিবীতে ঘটে না। যেমন বলেছেন মালেক মুস্তাকিম তার ‘বৃষ্টিবহুল মৃত্যু’ কবিতায়-গতরাতে বৃষ্টিতে কাটা পড়েছে আমার শরীর/অসংখ্য বুদবুদের ভেতর/ঢেউয়ের স্বরে/ভেসে গেছে/মুখমণ্ডল;/আমার রক্তে ভিজে গেছে/ফুলের টবে ন্যাতানো নদী ও ঈশ্বর,/ইশারাক্রান্ত ঘুম;/ ও মানুষ, এমন বৃষ্টিতে/কেন জুড়ে দাও/ওমের পাখনা-/সুই ও সুতো?

জাদুবাস্তববাদের লেখকরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের কবিতায় জাদুকে ব্যাখ্যাতীত রেখে দেন যাতে এটি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করা যায় এবং এটি দৈনন্দিন জীবনের অংশ তা দৃঢ় করা যায়। ‘ঘামের কপিকল ঠেলে স্রোতের মতো এ দেহে/ঢেউ তোলে শস্যের কুচকাওয়াজ, পতন ধ্বনি-/অনিদ্রার ঘোর কেটে গেলে, কোনো এক রাতে-/সেলাই করা জলের কানকায় গুঁজে রাখি দেহফুল।’

জাদুবাস্তবতার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো অপ্রাকৃত উপাদানের উপস্থিতি। সাদা চোখে একে সহজ বলে মনে হতে পারে। মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় বর্ণনার কথা যার মাঝে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাব উপস্থিত থাকে। ‘স্তব্ধতার পরিভাষা’ কবিতায় যেমন বলা হয়েছে-‘এখানে সন্দেহ বিছিয়ে শুয়ে আছি/দীর্ঘশ্বাস আড়াল করেছে পাখিদের ভাষা-গোধূলি সংকেত-/ ঘুমের ভেতর নৈঃশব্দ্যের শোকসভা ভেঙে গেলে/ঝরাপাতা ঠেলে উঠে আসে না ফেরা অরণ্য।’

লেখকরা প্রায়শই জাদুবাস্তববাদ ব্যবহার করে সমাজের, বিশেষ করে রাজনীতি এবং অভিজাততন্ত্রের অন্তর্নিহিত সমালোচনা করে। ল্যাটিন আমেরিকার মতো বিশ্বের কিছু দেশে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়িত এবং শোষিত ছিল সেখানে এ ধারাটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জাদু বাস্তববাদী লেখকরা তাদের বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করতে এ ধারাটি ব্যবহার করেছিলেন। কবি মালেক মুস্তাকিমও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘মুক্তির ভাষা’ কবিতায় বলেছেন-‘কান পেতো শোনো-মানুষের চিৎকার-বৃক্ষের আর্তনাদ-/বাতাসে দুলছে যে ফসলের মাঠ, কার কাছে/জমা আছে তার মুক্তির খতিয়ান?’

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে জাদুবাস্তববাদ অন্যান্য সাহিত্য ধারার মতো সুস্পষ্ট শুরু, মধ্য এবং শেষসহ সাধারণ আখ্যান চক্র অনুসরণ করে না। এটি অধিকতর তীব্র পাঠের অভিজ্ঞতা তৈরি করে, কারণ পাঠক জানে না কখন প্লটটি এগিয়ে যাবে বা কখন দ্বন্দ্ব সংঘটিত হবে। ‘পাওয়ার গন্ধে পাখি হয়ে যাই’ কবিতায় বলেছেন, ‘নদীর নামে লিখে রেখেছি পাহাড়-/পাহাড় পেরুতে পারে কতটা উড়াল?/দৃশ্যের পাতা থেকে খসে পড়ছে হলদে শরীর/আমাদের আড়ালে/পাওয়ার গন্ধ পেলে মানুষ কি পাখি হয়ে যায়?’

জাদুবাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য হলো কাল্পনিক উপাদান, বাস্তব-জগতের পরিবেশ, লেখকের সংযম, রহস্য, এবং রাজনৈতিক সমালোচনা যা কবিতায় সবচেয়ে সহজে শনাক্ত করা যায়। জাদুবাস্তববাদ উপকথা, পৌরাণিক কাহিনি এবং কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য বা দক্ষতার উপাদানগুলোকে একত্রিত করে। জগতের উপাদানগুলো কাল্পনিকভাবে কাজ করতে পারে, বৃষ্টি নিচের দিকে না গিয়ে উপরে ভ্রমণ করতে পারে, অথবা ভবনগুলো এমন জায়গায় উপস্থিত হতে পারে যেখানে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন বলেছেন ‘বিনিদ্র পুষ্পের গুঞ্জন’ কবিতায়-‘ফুলের পৃষ্ঠে আমাদের শহর ও নদী,/পাতায় সেঁটে আছে নিদ্রাফুলের মতো মঞ্জুরিত বারান্দা,/যাওয়া-আসার সাঁকো, পাখনা-’

বাংলাদেশে ম্যাজিক রিয়েলিজম আন্দোলনের সফল কবি মালেক মুস্তাকিমের অসাধারণ কবিতার সংকলন ‘সেলাই করা হাওয়ার গান’ বইয়ে ৬৩টি কবিতা রয়েছে প্রতিটি কবিতাই সুখপাঠ্য। কবিতাগুলোতে উঠে এসেছে তার ধ্যানমগ্নতা, বিশ্বজনীনতা, প্রেম-ভালোবাসা ও প্রকৃতি বন্দনা। কবিতায় ব্যবহৃত রূপকের মাধ্যমে উঠে এসেছে অসাধারণ চিত্রকল্প যেন সত্যি মনে হয়-‘পাখির পায়ের তলায় ভাগ হয়ে গেছে সময় ও শস্যদানা।’

সেলাই করা হাওয়ার গান : মালেক মুস্তাকিম। প্রকাশক : অন্যপ্রকাশ। প্রচ্ছদ : আনিসুজ্জামান সোহেল। মূল্য : ২৮০ টাকা।

মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম