কারফিউ দিনের কবিতা মূলত একটি রাজনৈতিক কবিতার বই। কবি তরুন ইউসুফ রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যবর্তী ব্যারিকেডকে সংজ্ঞায়িত করে আমাদের দৃষ্টিকে ওই পথের দিকে নিয়ে গেছেন, যে পথে ব্যক্তি তথা যুগ যুগ ধরে আমাদের নাগরিক অধিকার হারিয়ে যায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা রক্ষার দাম্ভিকতায়। এ কাব্যগ্রন্থটি এজন্য শেষমেশ হয়ে উঠেছে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলিল। ১৯৭১-এ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রে আমাদের রক্ত ঢালার দিন যেন শেষই হয় না। স্বাধীনতার পরও দেশীয় শোষকদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লোভ আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সমাজজীবনকে বারবার বিপর্যস্ত করে তোলে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলন। জুলাইয়ের স্বৈরাচার হঠানোর সংগ্রামে আমাদের বদ্ধ ও শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলো কবি চিত্রায়িত করেছেন তার ‘কারফিউ দিনের কবিতা’ গ্রন্থে; যেন রাজনীতি সচেতন এ কবি আমাদের ইতিহাসের একটি দলিলকে খুব সচেতনভাবে আটকে ফেলেছেন তার কবিতা। কবিতাগুলো তিন পর্বে লেখা: বদ্ধ দিনের গান, কারফিউ দিন এবং আগুন পাথর। এ তিন পর্বের কবিতাগুলো পাঠককে ২৪ জুলাইয়ের স্বৈরাচার হঠানোর আন্দোলনের দিনগুলোতে নিয়ে যাবে। কীভাবে রাজপথে রক্তলাল পলাশ ফোটে, কেনই-বা শাসকের বন্দুকের সামনে এসব লাল লাল পলাশ আত্মাহুতি দেয়, এসব প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তরলিপি গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লেখা আছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতর বসবাস করেও শাসকদের খেয়ালিপনায় সাধারণ মানুষ বরাবরই যাপন করেছেন মানবেতর জীবন। সেসব আহত জীবনের ব্যথিত চিত্রকল্প কবি তরুন ইউসুফ তুলে ধরেছেন তার কবিতাগ্রন্থের প্রথম পর্বে। এ পর্বের নাম ‘বদ্ধ দিনের গান’। কবি ১৯টি কবিতা রেখেছেন এ পর্বে। এ পর্বের প্রতিটি কবিতায় কবি মূলত তুলে এনেছেন শোষক কর্তৃক এক বিকলাঙ্গ রাষ্ট্রের হতাশাগ্রস্ত নাগরিক মনের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো-
‘মাঝে মাঝে মনে হয়/সবচেয়ে উঁচু ভবন থেকে
লাফিয়ে পড়ে দেখাই/এর চেয়েও নাগরিক কতটা পতিত’
(বিক্ষিপ্ত আছি)
রাষ্ট্র যখন নাগরিকের আশ্রয়স্থল না হয়ে শোষণযন্ত্র হয়ে ওঠে, তখন এ যন্ত্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত মাড়াই হতে থাকে ব্যক্তিজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের সব সোনালি স্বপ্ন। এখানে জীবন নিয়ে কবিও যেন ধারণ করেন এক ইতরসদৃশ জীবন।
ইদানীং আশপাশে তাকাই/চারদিকে শুধু/লেজ গুটানো জীবন
আর কুই কুই শব্দ।/ (নেড়ি)
রাষ্ট্রীয় সব ধাপ্পাবাজি কবির কাছে ধরা পড়তে থাকে নিয়ত। যাপিতজীবন বিশ্লেষণ করে কবি বুঝে যান, সভ্যতা গড়ার নামে মানুষের মানবিক স্বপ্নকেই গিলে নিচ্ছে এক হাঙর রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আটকা পড়ে যাচ্ছে মানুষ, শোষণের বলি হয়ে মানুষ হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের খাবার। এ খাবার খেয়েই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে এ দানবীয় শোষক রাষ্ট্র; আর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নাগরিক জীবনের কদর্যতার নগ্নতা
‘অতএব সভ্যতা/একটা আস্ত জঙ্গল/তুমি আমি
নিখুঁত খাদ্যশৃঙ্খল।’ (খাদ্যশৃঙ্খল)
এখানে আনন্দের গীত নেই; এখানে প্রতিদিন যেন বেজে চলেছে শোকের শ্লোক। এ দানবীয় শোষক রাষ্ট্রে কবি বেঁচে থাকাকেই যেন আজ অপরাধ মনে করেছেন। রাষ্ট্র কর্তৃক এক প্রতারিত নাগরিক কবি, রাষ্ট্রকে আর নিরাপদবোধ করতে পারেন না। কাঠামোগত উন্নয়নকে ঘটিয়ে মানবিক-পঙ্গু রাষ্ট্র কখনোই মানুষের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে না। এ রাষ্ট্রের মুখের ওপর থুতু ছিটিয়ে কবি ঘোষণা করেন তার প্রতিবাদী উপহাস-
বাঘকে হরিণ ভেবে ভুল করি/যেমন রাষ্ট্রকে ভাবি নিরাপদ
ডোরাকাটা থাকলেই বাঘ হরিণ নয়/রাষ্ট্র থাকলেই মানুষ নিরাপদ নয়। (বাঘ ও রাষ্ট্র)
নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে ছেড়ে কবি শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলেন, মৌলিক অধিকারের দায়িত্ব কবি যাদের হাতে তুলে দিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে মুক্তি চেয়েছিলেন, সেই তারাই ডাকাতি করে নিয়েছে মানুষের সব স্বপ্ন, আশা ও স্বাধীনতাকে-
‘যাদের ভেবেছি দেবতা তাদের/মুখোশ খুললে ভিন্ন
কতবার যাকে প্রণাম করেছি/সেই দেখি খুব ঘৃণ্য!’
(জন্ম আমার আজন্ম মিথ্যা)
তবে প্রতারক রাষ্ট্রের এ প্রতারণাকে কবি শেষমেশ নীরবে সইয়ে যাননি, যায়নি রাষ্ট্রের নাগরিকরাও। মানুষের বিক্ষিপ্ত মন ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। মানুষ হয়েছে প্রতিবাদী, নেমেছে রাজপথে। তার স্পষ্ট ছাপচিহ্ন আমরা পাচ্ছি কবির লিখিত এ গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে। আমাদের আশা ভঙ্গের গানে নতুন নতুন সুর তুলেছে এক একটি স্বদেশীয় স্বৈরাচার। এসব স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে রাজপথে, কবিতায় ও গানে। ২৪ জুলাই আন্দোলনের সময় লেখা কবি তরুন ইউসুফ কবিতা সেই সাক্ষ্যই দেয়। কলমে জ্বালিয়েছেন তিনি বিবেকের বারুদ-
‘খতিয়ে দেখলাম/এই জুলাইয়েৎআমরাও সম্ভাবনার
আগুন জ্বালাতে পারি।’ (আহা জুলাই)
কারফিউ দিনের কবিতা : তরুন ইউসুফ। প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। প্রকাশক : সংযোগ। পৃষ্ঠা : ৬৪। মূল্য: ২৫০ টাকা।
রিগ্যান এসকান্দার