Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আবদুল হাই শিকদারের কবিতা ও

আমরা মানুষ আমরা এসেছি

Icon

জাকির আবু জাফর

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা মানুষ আমরা এসেছি

আবদুল হাই শিকদার।

কোনো বই পড়তে গেলেই আমি বইয়ের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিই। হোক সেটি কবিতার, হোক প্রবন্ধ নিবন্ধ বা অন্য কোনো বই। তর্কটি হলো-বইয়ের পৃষ্ঠায় যা লেখা হয়েছে তা কি যথার্থ? যৌক্তিক? নানন্দিক? এবং সময়ের নিরিখে কতটা উপযুক্ত? কবিতা বইয়ের ক্ষেত্রে থাকে আরও বাড়তি কিছুর পিপাসা।

কবিতা হৃদয়গ্রাহী? মনকে টোকা দিতে পারল তো! কোনো পঙ্ক্তি রেখে দিতে চায় মন! চিত্রকল্প, উপমা, উপস্থাপনার ঢঙ আধুনিক এবং আকর্ষণীয় কি? এরকম আরও আরও বিষয়ের পক্ষ নিয়ে তর্কে জড়াই বইয়ের সঙ্গে। এতে লাভ আছে বেশ। লাভটি হলো-যে বইটি বা যে অধ্যায় অথবা যে কবিতাটিই পড়ি, সহসা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তার ভেতর বাহির। কেউ কেউ একে কু-তর্কও বলতে পারেন! কু হলেও তর্ক তো বটে। যদিও যুক্তিতর্কেই আমার আনন্দ! অবশ্য কবিতার ক্ষেত্রে যুক্তিতর্ক খাটে না।

যেহেতু কবিতা কল্পনাবিলাসী এক মহাজীবনের শিল্প, তাই এর সঙ্গে নন্দন-তর্কের বন্ধুত্ব বেশ দৃঢ়। এ কথাগুলো বাচ্চা ফোটানোর আগে ডিম পাড়ার মতো। প্রসঙ্গটি কবি আবদুল হাই শিকদারের এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ কবিতাবই-‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’র বিষয়ে। ওপরে যত তর্কের কথা বললাম, সব তর্ক তুলেই পাঠ করলাম বইটি। আমি অভিভূত, মুগ্ধ এবং একইসঙ্গে উদ্বেলিত, এজন্য, বইয়ের কাছে আমি দারুণভাবে হেরে গেছি। বইয়ের কাছে হেরে যাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। তখন মনটি ফুরফুরে হয়ে ওঠে। নেচে ওঠে নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দে। হ্যাঁ, সত্যি হলো-বইয়ের কাছে পরাজিত হওয়ার মতো বই খুব কমই পাই। হাল আমলে তো নেহায়েতই কম।

কালেভদ্রে দেখা মেলে তেমন বইয়ের। ঠিক তেমন কবিতাবইয়ের সাক্ষাৎ পাওয়া তো আরও দূর!

কিন্তু কবি আবদুল হাই শিকদারের ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’ বইটি দিওয়ানা হয়ে পড়ার মতো।

আবদুল হাই শিকদার এখন আর কোনো দশকের সীমানায় সীমাবদ্ধ নন। তিনি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান কবি। একজন অকুতোভয় সাহসী কবি। তার অনেক পরিচয়-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সব অঙ্গনে তার রয়েছে সমৃদ্ধ বিচরণ। তবে কবি হিসাবেই তার প্রধান পরিচিতি।

তার কবিতার প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য মানবতা, স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদবোধ। আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার এক অনন্য উচ্চারণ তার কবিতা।

নর-নারীর প্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম, প্রকৃতি, বিশ্বমানবতা এবং শোষণমুক্ত সমাজের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আপসহীন। তিনি একজন মুক্তচিন্তার মানুষ। তার কবিতার শরীরেও এর ছায়া ছড়ানো। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুসন্ধানে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি কবি এবং কবি।

কবিতায় তার কণ্ঠ দুঃসাহসী! দ্বিধাহীন! উচ্চারণ সোজাসাপটা। আনন্দময়, স্বচ্ছন্দ এবং সুস্পষ্ট। হিপোক্রেসি নেই। যা বলেন তো মুক্তকণ্ঠে বলেন! যা লেখেন তো হৃদয় খুলে লেখেন। লুকিয়ে চুবিয়ে আপসকামিতার ধ্বজভঙ্গ শব্দের লুকোচুরিতে বিশ্বাসী নন কবি আবদুল হাই শিকদার। তার কবিতার বাণী ক্ষুরধার! ভাষা সচ্ছল! চিত্রকল্প হৃদয়গ্রাহী।

আমি আবদুল হাই শিকদারের কবিতার প্রথম বইটি পড়েই তার কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম।

বইটির নাম-‘আশি লক্ষ ভোর।’ বইটি আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করল। এ বইয়ের প্রথম কবিতাতেই মজে গেলাম। কবিতাটির নাম-‘সন্ধ্যার ছাদ।’ তারপর একে একে কবিতাগুলো গিলতে থাকলাম গোগ্রাসে।

কবিতা আমাকে দোলাতে থাকল। আমিও দুলতে থাকলাম। দুলতে দুলতে আমাকে নানা রকম আশ্চর্য জগতের ভেতর ঢুকিয়ে দিল কবিতা। একেকটি কবিতা একেক জগতের দৃশ্যছবি। একেকটি কবিতা একেক রহস্যের দরজা। আমি প্রবেশ করি দেখি, দেখে বিস্মিত হই! আনন্দিত হই! কখনো কখনো থ হয়ে ভাবি-হ্যাঁ কবিতা তবে এমনও হতে পারে। আবার নতুন কবিতা, আবার নতুন জগৎ। আমি তার কবিতার বিচিত্র জগতের বিস্ময় আনন্দে অভিভূত হই! সালটি কত, এখন আর মনে নেই। কিন্তু এটি মনে আছে, তার প্রথম বইটি পড়ে পরের বইগুলো পাঠের এক তীব্র তৃষ্ণা জেগে উঠল। শুরু হলো বই সংগ্রহ। উল্লেখযোগ্য কটির নাম করা যায়-

আগুন আমার ভাই, রেলিঙ ধরা নদী, যুগলবন্দী ভূগোলময়, মানব বিজয় কাব্য, এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো, লোডশেডিং নামিয়াছে, দুধ কুমারের জানালাগুলো, অতি মুরগী হইলো, কসম, তারাউজিয়াল গ্রামে বৃষ্টি নামলো, নদীর মেয়ে বাংলাদেশ, ইশক আবাদ ইত্যাদি।

সেইসঙ্গে পাঠের আনন্দ! আহা একেকটি বই একেক স্বাদের! একেকটি বইয়ের কবিতার একেক ধরন। সবকিছু মিলিয়ে আবদুল হাই শিকদার উঠে এলেন আমার পছন্দের প্রথম সারির কবির তালিকায়। অর্থাৎ তিনিও আমার একজন প্রিয় কবি!

একজন কবি প্রিয় হয়ে ওঠা খুব কি সহজ! না, একদমই না। বরং এটি সাংঘাতিক কঠিন একটি বিষয়! সে কঠিন বিষয়টি কীভাবে যেন দারুণ সহজ হয়ে উঠল কবি আবদুল হাই শিকদারের ক্ষেত্রে।

কবির সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ-‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি।’ এটি বইয়ের নাম কবিতা। বইটি প্রিয় কবির হাত থেকেই উপহার পেয়েছি। এক বসায় পড়ে ফেললাম বইটি। পড়ার পর থেকেই ভেতর থেকে কিছু লেখার তাগাদা অনুভব করলাম। সেই তাগাদা থেকেই লেখাটি।

বইয়ের নাম কবিতাটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ! দীর্ঘ বটে কিন্তু পড়তে কোথাও নিচু হতে হয় না। কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। থামতে হয় না কোথাও। স্বাচ্ছন্দ্য সাবলীল গতি, বহমান নদীর মতো। এ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তির একেকটি অনন্য সাধারণ গূঢ় রহস্য রয়েছে। প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তির পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো ইতিহাস! লুকিয়ে আছে ঐতিহ্যের কোনো মিনার। অথবা আমাদের উর্বর কোনো সভ্যতার ঘ্রাণ! পাঠ করা যাক এ কবিতারই কটি পঙ্ক্তি-

আমরা মানুষ আমরা এসেছি পলাশীর গোঙরানী

আমরা এসেছি মজনু শাহের দহন

আমরা এসেছি শ্রীরঙ্গপত্তম

আমরা এসেছি ১৮৫৭’র বজ্রের গর্জন

আমরা এসেছি গালিবের ক্রন্দন

আমরা মানুষ আমরা এসেছি আন্দামানের কারাগারগুলো ভেঙে।

উল্লিখিত প্রতিটি পঙ্ক্তির শরীরে জুড়ে আছে আমাদের জাতির ইতিহাস। আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসের পথচিত্র! একেকটি পঙ্ক্তি ঠোঁটে তুলে নিলেই বেজে ওঠে ইতিহাসের ঘটনার ঘনঘটা।

আরও কটি পঙ্ক্তি পড়ে আসি-

আমরা মানুষ আমরা এসেছি কোটি তিতুমীর ছেলে

আমরা এসেছি জালিয়ানঅলা থেকে

আমরা এসেছি বীর শমসের গাজী

আমরা মানুষ আমরা এসেছি চুরুলিয়া থেকে আগুনের ফুল হয়ে!

অসাধারণ চিত্রকল্প! অসাধারণ উচ্চারণ! সেই সঙ্গে বাণীর গাম্ভীর্যতা এবং স্বচ্ছতা কবিতাকে করেছে ক্লাসিক। এ কবিতার শেষ কটি পঙ্ক্তি পাঠ করা যাক-

আমরা এসেছি শঙ্কাবিহীন শান্তির বরাভয়

আমরা এসেছি ছাড়ো উদ্বেগ বিজয় সুনিশ্চয়

আমরা এসেছি পায়ে পিষে পিষে দীনতা ও হীনতাকে

আমরা মানুষ আমরা এসেছি হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা উদ্ধারে।

এ কটি পঙ্ক্তিতে বীরত্বের আওয়াজ ধ্বনিত।

জুলাই বিপ্লবের পক্ষে দুঃসাহসী উচ্চারণ! হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা উদ্ধারের এ দ্বিধাহীন সংকল্প, সুদৃঢ় উচ্চারণ।

এ বইটির প্রায় সব কবিতাই জুলাই বিপ্লবের রক্তাক্ত সময়ের আগুনঝরা দিনে রচিত। প্রতিটি কবিতায় সাহস, স্বপ্ন এবং আশার আকাশ চিত্রিত হয়েছে। কবিতা হয়ে উঠেছে সাহসের উত্তরাধিকার। একটি কবিতার নাম-‘প্রত্যয়’। কবিতার শেষ চারটি লাইন এমন-

‘হয়তো আগুনে ঝলসে গিয়েছে তোমার চৈত্র ফাগুন

তবুও প্রকৃতি আপন নিয়মে জাগাবেই নবারুণ

দৃঢ় পদক্ষেপ দ্বিধাহীন মন খুব দরকার আজ

পত্রবিহীন বৃক্ষের ব্যথা আনবেই ঋতুরাজ।’

আশা জাগিয়ে দেওয়া একজন কবির কাজ। কবি তার জাতিকে স্বপ্ন দেখাবেন। সাহস জোগাবেন। সংকটে বুক টানটান করে দাঁড়াবেন। পেরিয়ে যাবেন আগুনের নদী। সব ঝড়-ঝঞ্ঝায় অবিচল থাকার উদ্যমতা জাগাবেন। কবি আবদুল হাই শিকদার এসব বিষয়ে তার জাতিকে স্বপ্ন ও আশার কথা বলেছেন। বলেছেন স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে দ্বিধাহীন।

‘কারাবন্দি সহযোদ্ধাদের প্রতি’ আরেকটি কবিতা। এ কবিতায় ফ্যাসিবাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করার চিত্র ছড়ানো। একটি পঙ্ক্তি-ভোরের দোয়েল/ তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে/ প্রতিদিন গালি দেয়/ ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক।

আমাদের/ জাতীয় স্মৃতিসৌধ/ গর্জন করে/ সমুদ্রের জন্য/ ফ্যাসিবাদ ধ্বংস হোক।

...

-ফ্যাসিবাদের বরকন্দাজরা/ বাতাসকে/ কারারুদ্ধ করতে পারে না/ তাদের তাড়া করছে/ পাপাতঙ্কের বিভীষিকা!

এই তো সাহস ও আশার এক যুগলবন্দি স্বপ্ন এখানে ডানা বিস্তার করে আছে।

এমনিতেই সমকালীন বাংলা আধুনিক কবিতার একটি দুর্নাম-বাংলা আধুনিক কবিতা বড় বেশি নেতানো। শিরদাঁড়া খাড়া রাখার মতো আওয়াজ নেই বাংলা আধুনিক কবিতায়। মিনমিনে চোরা প্রেমের কণ্ঠে কবিতা অনেকাংশে হারিয়েছে বীরত্বের ঢেউ। এখানে কবি আবদুল হাই শিকদার সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি তার কবিতা বীররসে ভিজিয়ে রেখেছেন বরাবর। ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’ এ বইটিও বীররসে টইটম্বুর! এমন দুঃসাহসী মায়াবী কবিতার বই খুব নিকট অতীতে পাঠ করিনি আর।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম