Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অমর একুশে বইমেলা

বাংলাদেশের প্রাণের মেলা

Icon

এস এম জাহাঙ্গীর কবীর

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে বইমেলার শুরুটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। বইমেলার চিন্তাটা এ দেশে প্রথমে সামনে আনেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদ্দীন। তিনি ‘Wonderful World of Books’ বইটি পড়তে গিয়ে বইয়ের যে মেলা হতে পারে সেটা তিনি বুঝতে পারেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ইউনেস্কোর প্রকল্পের শিশু-কিশোরদের কিছু বই নিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায় শুরু করেন ‘শিশু’ গ্রন্থমেলার।

শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করে সরদার জয়েনউদ্দীন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি একটি বইমেলা আয়োজনের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি বইমেলা আয়োজন করা হয়। সেখানে আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সেসব আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রথিতযশা অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, শহিদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ। এ মেলায় তিনি একটি মজার কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। মেলায় যেমন বইয়ের পসরা ছিল, দর্শকও ছিল প্রচুর। বইয়ের বেচাকেনাও ছিল ভালো। দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য মেলার মাঠের মধ্যে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল, ‘আমি বই পড়ি না’। তার এ রসিকতা দর্শনার্থীদের বই পড়ার প্রতি হয়তো আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনে বটতলায় চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। এ সময় স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও তাদের বই নিয়ে বসেন।

১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। সেসময় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই ঘটনার পর সেবছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রথম দিকে ১৫ দিন, ২০ দিন বইমেলা হলেও এখন এর ব্যাপ্তি ফেব্রুয়ারিজুড়ে। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে। মেলার পরিসর বৃদ্ধির কারণে বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সময় সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়।

৪১ বছরে বইমেলার বাঁকবদলে সংবাদপত্র, সাময়িকী, রেডিও ও টেলিভিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একুশের বইমেলার জনপ্রিয়তা সৃষ্টিতে দৈনিক সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। প্রতিবছর বইমেলার মাসজুড়ে দেশের সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বইমেলা সম্পর্কে এত প্রতিবেদন, ফিচার, সাক্ষাৎকার, সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে যে পাঠকের পক্ষে বই ও বইমেলা সম্পর্কে উদাসীন থাকা সম্ভব নয়। সংবাদ মাধ্যমের এই প্রচার শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়, সারা দেশের মানুষের কাছে বইমেলা সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। বইমেলা থেকে আগ্রহ সঞ্চারিত হয় বই সম্পর্কে। বছরের এই একটি মাস বই সম্পর্কে সংবাদপত্রে ব্যাপক লেখালেখি হয়। লেখক-প্রকাশকরা সচিত্র প্রচার পান। এ প্রচার অনেক পাঠকের মনে বই পড়ার ও লেখকের সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে। রেডিও-টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল তাদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বই, বইমেলা ও লেখকদের নিয়ে মেলার মাঠ থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এ ছাড়া অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। সংবাদ মাধ্যম, রেডিও-টেলিভিশনে বইমেলা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় বই সম্পর্কে নতুন পাঠকের মনে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয় তার মূল্য নেহাত এ প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু একুশের বইমেলা।

যে কোনো বইমেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রের বৈচিত্র্য। পাঠাগারে ও বইয়ের দোকানে সাধারণত বই সাজানো হয় বিষয়ভিত্তিক। কিন্তু মেলার স্টলে কত বিচিত্র রকমের পাশাপাশি জায়গা করে নেয়। লেখকদের মনের কথা, গবেষণার ফলাফল কতভাবে ও ভিন্নভিন্নভাবে প্রকাশিত হতে পারে, সেটা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই বইমেলায়। কত সহজেই বইমেলার স্টলে কবিতার পাশে স্থান করে নেয় উপন্যাস, গবেষণা, নাটক, অনুবাদ, গল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি কিংবা স্মৃতিকথা। সৃষ্টিশীলতার ও বৈচিত্র্যের বিবেচনায় বইমেলা হচ্ছে একটি সমাজের জানালা। যে সমাজের চিন্তার স্বাধীনতা যত বিস্তৃত, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তত বেশি ভিন্নমতের বই দেখতে পাওয়া যায়। এটা সংখ্যার বিষয় নয়, চিন্তার ব্যাপ্তি ও পার্থক্যের বিষয়।

অমর একুশে বইমেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত জাতীয় মেলা। এ মেলা উপলক্ষ্যে বইমেলা প্রাঙ্গণে যারা সমবেত হয়, তারা কেবল বই কিনতে আসেন না, আসেন সামাজিক যোগসূত্র রক্ষার দাবি থেকেও। মেলায় পাঠকদের সঙ্গে লেখক-প্রকাশকদের পরিচয় ঘটে।

বইমেলার প্রধান আকর্ষণটা বইয়ে। থরে থরে সাজানো বইগুলো বইপ্রেমীদের মানসিক তৃপ্তি দেয়। অনেক লেখকের যেমন নাম জানা যায় তেমনি অজস্র বইয়ের সঙ্গে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের পরিচয় ঘটে।

আনকোরা নতুন লেখকদের সঙ্গে অনেকের পরিচয় ঘটে এ বইমেলায়। হয়তো জীবনের প্রথম বই বেরিয়েছে, সে বই সন্তানের মতো বুকে চেপে ও মুখে থাকে অনাবিল আনন্দের দীপ্তি, অকৃত্রিম তৃপ্তির এবং এক ধরনের উৎকণ্ঠা। তার প্রথম বই কিংবা নতুন, পাঠক তার নাম জানবে কী জানবে না, লেখক হিসাবে সে গৃহীত হবে কী হবে না, সেই শঙ্কা মুখে ভেসে থাকা খুব স্বাভাবিক। প্রথম বা নতুন বই লেখককে কতখানি আচ্ছন্ন করে এবং সেই বইয়ের খবর মেলার দর্শনার্থীদের জানানোর সে কী আকুলিবিকুলি, যেন অন্য না জানলে তার লেখক জীবনই বৃথা। বইমেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন লেখকদের এ আকুলতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। তথ্যকেন্দ্রের দায়িত্বরতদের কাছে নবীন লেখকের নাম-পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করেন ভালোভাবে প্রচার করতে, অনেকে প্রচার না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে তথ্যকেন্দ্রের টেবিল ঘেঁষে অথবা আমি মাঠের ওইখানে দাঁড়িয়ে রইলাম শুনব বলে। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন লেখকদের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের প্রচারের একটা মোক্ষম জায়গা।

পরিশেষে বইমেলা এখন আমাদের জাতীয় উৎসব শুধু নয়, জাতীয় ঐতিহ্যেও পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের আত্ম-আবিষ্কার উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ সুগম করেছে। তাই এ ঐতিহাসিক আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে যে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় সেটা হয়ে উঠুক সুস্থ, মুক্তচিন্তা স্থান, কবি-সাহিত্যিক-গবেষকদের আশ্রয়স্থল এবং মানবকল্যাণের মূল কেন্দ্র। সহস্র ফুলের বাগান হোক আমাদের এ বইমেলা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম