ডেথ অব দ্য অথর
একটি মেটাফিকশনাল পরীক্ষা

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাফল্য-ব্যর্থতার একটা সাধারণ সমীকরণ থাকে। লেখকের ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করেন পাঠক। আর পুরস্কারপ্রাপ্তিকেই যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ধরে নিই, তবে বলা যায়, এননেদি ওকোরাফোরকে পুঁজি হিসাবেই ধরে নিয়েছে প্রকাশনার পৃথিবী। আর তাই তো অনবরত সিঁড়ি ভেঙে চলছেন নাইজেরিয়ান-আমেরিকান এ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও ফ্যান্টাসি লেখক। তিনি প্রধানত তার বিনতি সিরিজ এবং উপন্যাস ‘হু ফিয়ার্স ডেথ’, ‘জাহরা দ্য উইন্ডসিকার’, ‘আকাটা উইচ’, ‘আকাটা ওয়ারিয়র’, ‘লেগুন’ এবং ‘রিমোট কন্ট্রোল’-এর জন্য বেশি পরিচিত। তিনি কমিক্স ও চলচ্চিত্রের জন্যও লেখালেখি করেছেন। তার লেখালেখি আফ্রিকানফিউচারিজম এবং আফ্রিকানজুজুইজম নামে পরিচিত, এ দুটি পরিভাষা তিনি নিজেই প্রচলিত করেছেন। তার লেখার ওপর তার নাইজেরিয়ান ও আমেরিকান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। তিনি হুগো অ্যাওয়ার্ড, নেবুলা অ্যাওয়ার্ড, আইজনার অ্যাওয়ার্ড এবং ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কারের বিজয়ী। তাকে নাইজেরিয়ার তৃতীয় প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে গণ্য করা হয়।
প্রায় সব প্রধান সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি পুরস্কার জেতার পর, এননেদি ওকোরাফোর তার অনেকটা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে নিজের জীবনের একটি ভয়াবহ ঘটনার অন্বেষণ করেছেন। ১৯ বছর বয়সে একদিন একটি হাসপাতালের কক্ষে বিভ্রান্ত হয়ে জেগে উঠলেন এননেদি। উজ্জ্বল গোলাপি এবং সবুজ রঙের ঘাসফড়িং তার হাসপাতালের বিছানার চারপাশে লাফাচ্ছিল এবং অদ্ভুত শব্দ করছিল। একটি বিশাল কাক জানালার সঙ্গে ধাক্কা মারছিল, যেন ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। এরপর, যখন তিনি ব্যথানাশক ওষুধের হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্ত হলেন, তখন আরও অদ্ভুত এবং ভীতিকর কিছু ঘটল : তিনি বিছানা থেকে উঠতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন-পা নাড়াতে পারছেন না। ওকোরাফোর শিগগিরই জানতে পারলেন যে, স্কোলিওসিসের জন্য পিঠের অস্ত্রোপচারের সময় স্নায়ুর ক্ষতির কারণে তিনি কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন।
একজন তারকা ক্রীড়াবিদ এবং প্রি-মেড কলেজের ছাত্র, ওকোরাফোর চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং নিজের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে লাগলেন। পক্ষাঘাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি যা হতে চাচ্ছিলাম এটি ছিল সেই সম্ভাবনার মৃত্যু।’ তবে এটি এক ধরনের নতুন জন্মও ছিল। তিনি নিজেকে কল্পনার মধ্যে নিমজ্জিত করলেন এবং হাসপাতালের বিছানায় থেকেই একটি গল্পের রূপরেখা তৈরি করতে শুরু করলেন, যেখানে একজন নাইজেরিয়ান নারী হাঁটতে পারতেন না, তবে উড়তে পারতেন। পরে যখন এননেদি তার পায়ের অনুভূতি ফিরে পেলেন, আবার হাঁটতে পারলেন, তখন তিনি কলেজে ফিরে গিয়ে লেখালেখির ক্লাসে ভর্তি হন। ত্রিশ বছর এবং ২০টিরও বেশি বই উপহার দেওয়া ওকোরাফোর এখন একজন স্বনামধন্য সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি লেখক। তার সেই ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা এবং এর ফলে হওয়া পরিবর্তনকে অন্বেষণ করেছেন তার নতুন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ডেথ অব দ্য অথর’-এ।
‘ডেথ অব দ্য অথর’ একটি ঘরানাভেদী মেটাফিকশনাল পরীক্ষা, গল্পটি শিকাগোর নাইজেরিয়ান-আমেরিকান লেখিকা জেলুকে কেন্দ্র করে। জেলু শৈশবে একটি দুর্ঘটনার পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন। তিনি একজন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু তার ভালোবাসাপূর্ণ অতিরক্ষণশীল বাবা-মা এবং ভাইবোনরা সন্দেহ করেন যে-তিনি কখনো নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন না। বহু বছর সংগ্রাম করার পর, জেলু একটি বেস্ট-সেলার পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক উপন্যাস লেখেন, যা ভবিষ্যতের নাইজেরিয়ায় সংবেদনশীল রোবটদের নিয়ে, যার কারণে তিনি সাত-অঙ্কের অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করেন এবং একটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হন। তার হঠাৎ খ্যাতি যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি বিভ্রান্তিকর। কারণ জেলু দেখতে পান যে, তার সাফল্য তার পরিবারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং হলিউডের নির্বাহীরা তার উপন্যাস থেকে আফ্রিকান উপাদান বাদ দিয়ে সেটিকে সাদা সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করছে।
ওকোরাফোরের আগের কাজগুলোর তুলনায়, আত্মজীবনীমূলক কাঠামোর সঙ্গে ‘ডেথ অফ দ্য অথর’ একটি আলাদা ধরনের রচনা। তার আগের কাজগুলো সাধারণত অন্য জগতীয় গল্প ছিল, যা প্রায়ই নাইজেরিয়ায় তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, যেখানে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস, বিশাল মাকড়সা দেবতা, জলের আত্মা, রূপান্তরশীল চিতা-মানুষ ছিল স্বাভাবিক বিষয়।
তবে এ উপন্যাসটিও মস্তিষ্ক ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো, সম্ভবত তিনি যত কিছু লিখেছেন তার চেয়ে বেশি। ওকোরাফোর জেলুর গল্পের সঙ্গে জেলুর উপন্যাস ‘রাস্টেড রোবটস’-এর অধ্যায়গুলোকে বুনে দিয়েছেন, যা একটি রোবট দ্বারা বর্ণিত হয়েছে; যে লেগোসের (নাইজেরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর) ধ্বংসাবশেষে ভ্রমণ করে এবং পৃথিবীর শেষ মানবের সঙ্গে দেখা করে। যখন এ দুই গল্প একসঙ্গে এগোয়, আত্মজীবনী এবং কল্পকাহিনি, বাস্তবতা এবং ফ্যান্টাসির সীমানা মুছে যেতে থাকে এবং এটি নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে ওঠে যে, জেলুর গল্প নাকি তার রোবটের কাহিনি; কোনটি এগিয়ে থাকবে।
ওকোরাফোরের জন্য ঘরানার সীমা অতিক্রম করা স্বাভাবিক ছিল। ‘আমার লেখক জীবনে যদি কোনো একটি বিষয় আমাকে হতাশ করে, তা হলো বক্স এবং লেবেল; এটা যে, ‘ওহ, আপনি সায়েন্স ফিকশন লেখক, আপনি আর কিছু করতে পারবেন না।’ ‘এই উপন্যাসের অনেক অংশই শ্রেণিবদ্ধ করা যায় না-এটি প্রত্যাশার সঙ্গে খেলা করেছে।’
প্রায় ২০ বছর আগে ওকোরাফোরের প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে তিনি ঘরানার অন্যতম উদ্ভাবনী এবং প্ররোচনামূলক লেখক হয়ে উঠেছেন। সাহিত্য জগতের এমন একটি অংশে, যা ঐতিহ্যগতভাবে শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ লেখক এবং পশ্চিমা পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত; ওকোরাফোর তার বিপুল কল্পনাপ্রসূত ফ্যান্টাসি গল্পগুলোর মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন, যা পশ্চিম আফ্রিকান বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।
তার কল্পকাহিনি, যা তিনি আফ্রিকানফিউচারিজম বলে অভিহিত করেন, প্রায়ই শক্তিশালী তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান নায়িকাদের বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে, যারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা নিয়ে আসে এবং তাদের ওপর আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলোকে ভেঙে দেয়। যদিও তার গল্পগুলো কখনো কখনো দূর ভবিষ্যতে বা আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশযানে স্থান পায়, তবে এগুলো বিভ্রান্তিকর ফ্যান্টাসি নয়; রূপান্তরকারী, জাদুকর, এলিয়েন এবং রোবটের পাশাপাশি, ওকোরাফোর বর্ণবৈষম্য, রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণহত্যা, লিঙ্গবৈষম্য এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের ধ্বংস সম্পর্কে সোজাসাপটা লেখেন।
তার কাজ জনপ্রিয় হতে সময় লেগেছিল। তিনি প্রথম উপন্যাস বিক্রি করার আগে পাঁচটি বই লিখেছিলেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘জারাহ দ্য উইন্ডসিকার’ ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটি খুব বেশি বিক্রি হয়নি। কিন্তু এরপরের কয়েক দশকে তিনি সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি জগতের প্রায় সব বড় পুরস্কার জিতেছেন, যার মধ্যে রয়েছে হুগো, নেবুলা এবং ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড।
তার ভক্তদের মধ্যে রয়েছেন ব্লকবাস্টার ফ্যান্টাসি লেখক লেই বার্ডুগো, রিক রিওর্ডান এবং আইকনিক উরসুলা কে.লে.গুইন। উরসুলা একবার বলেছিলেন, ‘ওকোরাফোরের একটি পৃষ্ঠায় যে পরিমাণ কল্পনা থাকে, তা সাধারণ ফ্যান্টাসি মহাকাব্যের পুরো খণ্ডে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ বেস্ট-সেলিং ফ্যান্টাসি লেখক জর্জ আর. আর. মার্টিন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ওকোরাফোরের কাজের ভক্ত; তার উপন্যাস ‘ডেথ অফ দ্য অথর’ সম্পর্কে বলেছেন এটি তার সবচেয়ে ভালো এবং আকৃতিগতভাবে উদ্ভাবনী কাজগুলোর একটি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ‘ওকোরাফোরের কাজের যেটা আমার ভালো লাগে, তা হলো আমি জানি না পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে চলেছে,’। ‘এটি এক ধরনের সাহসিকতার কথা বলে এবং নতুন ও ভিন্ন কিছু করার জন্য তার ইচ্ছার প্রমাণ দেয়।’
‘ডেথ অফ দ্য অথর’ (লেখকের মৃত্যু) গল্পে, ওকোরাফোর দুটি জায়গার মানুষ হওয়ার এবং কোনো স্থানেই পুরোপুরি নিজের মতো অনুভব করতে না পারার অদ্ভুত একাকিত্বের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ওকোরাফোরের মতে, গল্পের চরিত্র জেলুও তার পরিচয় বারবার ব্যাখ্যা ও ডিফেন্ড করতে বাধ্য হওয়ায় বিরক্ত। সে ক্ষোভ প্রকাশ করে যখন তাকে ‘আমেরিকান, ‘ডায়াসপোরিক,’ আফ্রিকানফিউচারিস্ট বা আফ্রিকান লেখক’ হিসাবে একের পর এক তর্ক করতে হয়।
ওকোরাফোর ভাবছিলেন, পাঠকেরা কি প্রতারিত মনে করবেন, যখন বুঝবেন ‘ডেথ অফ দ্য অথর’ ঠিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি নয়, বরং এটি এক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকের সম্পর্কে মেটাফিকশনাল উপন্যাস। তার কথায়-‘আমি দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছি, আর এখন ভাবছিলাম, এবার তারা সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।’ ওকোরাফোর পাঠকদের ওপর ছেড়ে দেন সিদ্ধান্ত নিতে যে, ‘ডেথ অফ দ্য অথর’ বাস্তবতা নাকি কল্পনা। যদিও তার কাছে এ পার্থক্যের কোনো গুরুত্ব নেই। তিনি বলেন, ‘আমি পৃথিবীকে একটি জাদুকরি স্থান হিসাবে দেখি।’
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস