শিশুসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু
শিশুসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে বুদ্ধদেব বইয়ের প্রতি তীব্র অনুরাগের পরিচয়। দিয়েছেন, কখনো গদ্যে কখনো বা পদ্যে এ পরিচয় দৃশ্যমান। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘বই কেন ভালোবাসি’। প্রখর যুক্তি ও তীক্ষ্ণ রসবোধের মধ্য দিয়ে তিনি বইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। এ প্রবন্ধটি পড়ামাত্রই মনে হবে গান শুনে, সিনেমা দেখে সময় ব্যয় না করে বই পড়া উচিত
রাজীব সরকার
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বহুমাত্রিক প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ ও সম্পাদনা মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতো অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভা সমকালে আর আবির্ভূত হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যসম্ভার নিঃসন্দেহে প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য লিখিত, যদিও অগ্রসর কিশোর পাঠক তার বহু রচনার স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম। এমন বহুদর্শী প্রতিভার শ্যেনচক্ষু এড়িয়ে যায়নি শিশুসাহিত্য। এটি বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্য যে বুদ্ধদেব বসু তার বিশাল প্রতিভার একাংশ শিশুসাহিত্যের জন্য ব্যয় করেছিলেন।
শুধু শিশুসাহিত্য রচনা করেননি, শিশুসাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন বুদ্ধদেব বসু। তার ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শিশুসাহিত্য সম্পর্কে সম্ভবত বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ এটি। শিশুসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব লিখেছেন-
‘এমন মত পোষণ করা সম্ভব যে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ নয়, কেননা তা সত্যিকার সাহিত্য হলে বড়রাও তাতে আনন্দ পান, আর সাবালক-এমনকি আবহমান সাহিত্যের একটি অনতিক্ষুদ্র বিচিত্র অংশের ছোটরাও উত্তরাধিকারী। যেসব গ্রন্থ চিরকালের আনন্দভান্ডার, ছোটদের প্রথম দাবি সেখানেই-সেই মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল, আরব্যোপন্যাস, বিশ্বের পুরাণ, বিশ্বের রূপকথা, আর সেই সঙ্গে আধুনিককালের ভাস্কর চিত্রাবলি-ডন কিহোটে, রবিনসন ক্রুসো, গালিভার। শিশুসাহিত্যের বড় একটি অংশজুড়ে এরাই আছে; এ অমর সাহিত্যের প্রবেশিকা পাঠ শিশুদের আদ্যকৃত্য। পক্ষান্তরে, মৌলিক শিশুগ্রন্থ তখনই উৎকৃষ্ট হয়, যখন তাতে সার্বজনীনতার স্বাদ থাকে। অতএব, অন্তত তর্কস্থলে, সাহিত্যে এই ‘ছোট-বড়’ ভেদজ্ঞানকে অস্বীকার করা সম্ভব।’
শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন বুদ্ধদেব বসু প্রতিপালিত হয়েছিলেন মাতামহ ও মাতামহীর সান্নিধ্যে। মাতামহের উৎসাহে শৈশবেই বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে বুদ্ধদেবের। শারীরিক প্রতিকূলতার কারণে তিনি খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলেন না, সমবয়সি বালকদের হইচই-আড্ডা তাকে কখনো আকর্ষণ করেনি। বই ছিল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু। যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুকুমার রায়, মানকুমারী বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বর্ণিল সাহিত্য জগৎ তাকে মুগ্ধ করেছিল। একটু বড় হওয়ার পর পরিচিত হন রবীন্দ্রনাথের অতুলনীয় সৃষ্টি সম্ভারের সঙ্গে। পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য মন্থন করতে শুরু করেন। সাহিত্যের বিস্তৃত জগতে বিচরণ করতে করতেই বুদ্ধদেবের লেখালেখির সূত্রপাত ঘটে। বিপুল সাহিত্যিক প্রস্তুতি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে দীপ্র আবির্ভাব ঘটে বুদ্ধদেব বসুর।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধদেব উপলব্ধি করেছিলেন শিশুসাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে শিশুর অন্ত্যজগৎ সমৃদ্ধি হয়। ধীরে ধীরে বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল ভুবনের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে তার। শিশুর দৈহিক পুষ্টির জন্য যেমন সুষম খাবারের প্রয়োজন, তেমনি মানসিক বিকাশের জন্য মানসম্পন্ন শিশুসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রয়োজনীয়তা দক্ষতার সঙ্গে মিটিয়েছেন বুদ্ধদেব।
বুদ্ধদেব বসুর শিশুসাহিত্য বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। ছড়া, কবিতা, গল্প, রূপকথা, উপন্যাস, নাটিকা ও প্রবন্ধ লিখেছেন শিশুদের জন্য। শিশু মনস্তত্ত্বের গভীর পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনি। নিজের তিন সন্তান মিমি, রুমি ও পাপ্পার মধ্য দিয়ে শিশুর জগতকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তিনি। শিশুর স্বপ্ন, কল্পনা, চঞ্চলতা, আবেগ, দুষ্টুমি, প্রকৃতিপ্রেম সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন তার সাহিত্যে। তিন সন্তানকে নিয়ে কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। কৃতী শিশুসাহিত্যিকের পাশাপাশি একজন স্নেহ বৎসল পিতার পরিচয়ও এ কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে। শিশুরা কেন তার বই পড়বে, শিশুদের কাছে তার বই-ই বা কী আশা করে তা মনোহর ভঙ্গিতে লিখেছেন ‘আমার এ-বই’ কবিতায়-
‘সব বয়সের সব শিশুদের তরে/আমার এ-বই,
মনে যাদের আনন্দ না ধরে,/মুখে যাদের অঝোর হাসি ঝরে,
চোখের কোণে স্বপ্ন খেলা করে,/তাদের তরে আদর ধরে রাখে,
আমার এ-বই।
আকাশ যারা দেখতে ভালোবাসে/তাদের তরে-
পথ চলতে তাকায় আশপাশে/হলদে পাখি, হালকা-ছোঁওয়া ঘাসে,
খেলার টানে ভেলার মতো ভাসে;/তাদের ভালোবাসার আশা করে
আমার এ-বই।’
পৌরাণিক দেব-দেবী সম্পর্কে শিশুদের অন্তহীন কৌতূহলকে কবিতার পঙ্ক্তিতে সাজিয়েছেন বুদ্ধদেব। বিভিন্ন দেব-দেবীর মধ্যে সরস্বতীর মর্যাদা কেন ব্যতিক্রমী তা ছন্দের তুলিতে এঁকেছেন তিনি। অধ্যয়নই যে ছাত্রদের তপস্যা-এ প্রবাদ প্রতিম কথাটি শিশুদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘বিদ্যাসুন্দর’ কবিতায়-
‘বলতে পারো, সরস্বতীর/মস্ত কেন সম্মান?
বিদ্যে যদি বল, তবে/গণেশ কেন কম যান?
সরস্বতী কী করেছেন?/মহাভারত লেখেননি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,/তর্ক করাও শেখেননি।
তিন ভুবনে গণেশ দাদার/নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই/ভক্তি কেন চিত্তে?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে/এই পেয়েছি উত্তর-
বিদ্যা যাকে বলি, তারই/আর একটি নাম সুন্দর।’
শিশুদের জন্য শুধু ছড়া-কবিতা নয়; গল্প, উপন্যাস, নাটিকা, রূপকথাও লিখেছেন বুদ্ধদেব। প্রতিটি রচনায় একটি চমৎকার গল্প রয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর শিরোনাম এ লেখাগুলোর-‘ইউরেকা’, ‘মিস্? টম্যাটো’, ‘জলে থাকা মাছ’, ‘বাড়ি চাই, বাড়ি!’, ‘অন্য কোনোখানে’, ‘দেশলাইয়ের বাঘ’, ‘তারা থেকে ঝরা’, ‘স্বার্থপর দৈত্য’ ইত্যাদি।
‘স্বার্থপর দৈত্য’ বাংলা শিশুসাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপকথার অন্যতম। এ কাহিনির মধ্য দিয়ে বুদ্ধদেব বসু একটি অসাধারণ শিক্ষণীয় বার্তা দিয়ে গেছেন। এক দৈত্য তার সুন্দর বাগান থেকে ক্রীড়ারত শিশুদের তাড়িয়ে দেয়। উঁচু দেওয়াল তৈরি করে যেন শিশুরা বাগানে আবার আসতে না পারে। শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে প্রকৃতিতে, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম। কিন্তু দৈত্যের বাগান থেকে শীত ঋতু বিদায় হয় না। বরফের স্তূপে সাদা হয়ে যায় বাগান। বসন্ত আসে না, ফুল ফোটে না, পাখি ডাকে না। বাগানের এমন বিবর্ণ দশা দেখে দৈত্য বিস্মিত। একদিন দৈত্য খেয়াল করে দেওয়ালের গর্ত পেরিয়ে ছোট ছোট শিশুরা বাগানে ঢুকছে। বাগানে তখন ফুল ফোটে, পাখিরা গান গায়। বসন্তের আগমনে রঙিন হয়ে ওঠে দৈত্যের বাগান। দৈত্য বুঝতে পারে তার স্বার্থপর আচরণের জন্য এতদিন বসন্ত আসেনি বাগানে। শিশুদের আদর করে কাছে ডেকে নেয় দৈত্য। শিশুরা পরম আনন্দে সে বাগানে খেলা করে।
মননশীল সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম প্রবন্ধ। প্রবন্ধ-নিবন্ধ সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্য লিখিত হয়। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু শিশুদের জন্যও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার গদ্যভাষা অপূর্ব। গল্প বলার ভঙ্গিতে তিনি প্রবন্ধগুলো লিখেছেন যেন শিশুরা সহজেই একাত্ম হতে পারে। ‘টাইগার হিল-এ সূর্যোদয়’ প্রবন্ধটি ভ্রমণ কাহিনির আদলে লেখা হয়েছে। প্রকৃতি, ভূগোল, ইতিহাস, মানুষ-সব কিছুর হৃদয়গ্রাহী বর্ণনায় সমৃদ্ধ এ প্রবন্ধটি। প্রকৃতির সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন অপরূপ ভঙ্গিতে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক-
‘বাইরে এসে দেখি, প্রায় পূর্ণিমার চাঁদ পশ্চিমে আকাশে প্রকাণ্ড হীরকখণ্ডের মতো জ্বলছে। শহর ঘুমন্ত, হোটেল চুপচাপ। ধাপে ধাপে দারজিলিং উঠে গেছে জলাপাহাড় পর্যন্ত। ওই উঁচুতে ইলেকট্রিক আলোকে হঠাৎ তারা বলে ভুল হয়। চাঁদের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার পেখম তোলা শাদা ময়ূরের মতো। মেঘহীন ম্লান নীল আকাশে অল্প কয়েকটি তারা ছিটানো। প্যাঁচানো কার্ট রোড দিয়ে এরই মধ্যে দু-একখানা করে গাড়ি ছুটছে সূর্যোদয়ের দিকে।’
‘একটি বালক ও কয়েকটি বই’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব নিজের বড় হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। তার বিকাশের ক্ষেত্রে বই কী অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে তা প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন তিনি। বাল্যকালে বুদ্ধদেব ছিলেন রোগা, দুর্বল ও তোতলা। ছাত্র হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সমবয়সিদের তুলনায় অগ্রসর পাঠক বুদ্ধদেব বইকে নিত্য সহচর হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি পরিচিত মহলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইয়ের সংস্পর্শে তিনি ক্রমাগত নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এ বইগুলোর মধ্যে তিনি এক অলৌকিক স্বর্গের সন্ধান পেয়েছিলেন। বই পড়ে তিনি হাসতেন, আনন্দ পেতেন, কখনো কাঁদতেন। বই ছিল তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বুদ্ধদেব তার জীবনে বইয়ের অপরিসীম ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন-
‘... আমার ছেলেবেলাকার কথা যখন ভাবি, তখন পরপর কতগুলো বইয়ের কথাই আমার মনে পড়ে। বাল্যজীবনের এক-একটা অধ্যায় যেন বিশেষ কতগুলো বইয়ের স্বাদে সৌরভে চিহ্নিত হয়ে আছে। সবার আগে মনে পড়ে উপেন্দ্রকিশোরের পদ্য ‘ছোট্ট রামায়ণ’ আর গদ্য ‘ছেলেদের মহাভারত’। ... এর কয়েক বছর বাদ দিয়ে, আমার জীবনে এলো ‘সন্দেশে’র যুগ। মাসে-মাসে ‘আবোল তাবোল’-এর কবিতা, চালিয়াৎগুলোর জব্দ হওয়ার গল্প। তার ওপর সুখলতার, কুলদারঞ্জনের বই।’ ‘রবিন হুড’ পড়ে এতই রোমাঞ্চিত হলাম যে লম্বা-চওড়া গদ্য লিখে ফেলতে হলো। ... তখন আমি অনেকটা বড় হয়ে উঠেছি, রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা হাতে পড়েছে। আর চয়নিকা হাতে পাওয়া মানেই নতুন একটা পৃথিবী পাওয়া, আর তারই সঙ্গে পেলাম ইংরেজি গল্পের স্বাদ। জুল ভের্নের বইগুলো একের পর এক শেষ হতে লাগল এবং এক-একখানা শেষ হবে ভাবতে কান্না পায়-শার্লক হোমসের গল্প পড়ে অবাক হলাম।’ ‘ল্যা মিজারেবল’ পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। ... আমার হৃদয়কে আনন্দে, ক্রন্দনে, উল্লাসে, সংগীতে, সৌন্দর্যে অশান্ত বিচূর্ণ উন্মথিত করলেন ডিকেন্স, ব্রন্টি বোনেরা, ডুমা, টলস্টয়, কবিদের মধ্যে শেক্সপীয়র, শেলি-এদিকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। দেখতে দেখতে জীবনে এলেন গলজও আর্দি, অস্কার ওয়াইল্ড, টুর্গেনিভ ... কিন্তু আর না, আর তো আমি ছোট নই, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি, রীতিমতো যুবক হওয়ার চেষ্টা করছি। আজকের দিনে এ-কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে যে, আমার বাল্যজীবনে আমি যেন ঠিক সময়ে ঠিক বইটিকে হাতের কাছে পেয়েছিলাম: দশ বছর বয়সে জুল ভের্ন, চৌদ্দতে ডিকেন্স, ষোলোতে টুর্গেনিভ। এ যে কত বড় ভাগ্যের কথা আর সে-ভাগ্য যে আমারই হয়েছিল এখন সে-কথা ভাবতে অবাকই লাগে। আমার ছেলেবেলায় সিনেমা ছিল না। এত রকমের এত বাংলা বই ছিল না। চকোলেট চোখে দেখিনি, আইসক্রিমের নাম শুনিনি-তবু তোমাদের কারও সঙ্গেই আমার ছেলেবেলার বদল করতে আমি রাজি নই।’
নিজের রচিত শিশুসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে বুদ্ধদেব বইয়ের প্রতি তীব্র অনুরাগের পরিচয় দিয়েছেন কখনো গদ্যে কখনো বা পদ্যে এ পরিচয় দৃশ্যমান। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘বই কেন ভালোবাসি’। প্রখর যুক্তি ও তীক্ষ্ণ রসবোধের মধ্য দিয়ে তিনি বইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। এ প্রবন্ধটি পড়া মাত্রই মনে হবে গান শুনে, সিনেমা দেখে সময় ব্যয় না করে বই পড়া উচিত। শুধু পড়ার জন্য নয়, গৃহসজ্জা, অপ্রিয় ব্যক্তির কাছ থেকে আত্মরক্ষা এমনকি চোর তাড়াতেও বইয়ের মোক্ষম ভূমিকার কথা সরস ভঙ্গিতে বুদ্ধদেব বলেছেন। সুন্দর করে বুঝিয়েছেন, বই নিঃশব্দে শোনা যায় না, কিন্তু নিঃশব্দে পড়া যায়। তিনি নতুন বইয়ের গন্ধের প্রশংসা করেছেন, এর চেয়ে বেশি প্রশংসা করেছেন পুরোনো বইয়ের গন্ধের। বইয়ের খুব লোভনীয় বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন-
‘শরীরটাকে সবচেয়ে নিরাপদে, সবচেয়ে আরামে রেখে মনটাকে আকাশ-পাতাল ভ্রমণ করানো যায়; সেজন্য বই ভালোবাসি। দুঃখের জ্বালা-যন্ত্রণা সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে দুঃখের মন-কেমন-করা কান্না কান্না ভাবটাকে সম্পূর্ণ ভোগ করতে পারি। আবার সুখের ঝকমারি বাদ দিয়ে সুখের সুরটুকু, বুকের মধ্যে গুনগুন করে সারা দিন। সেই জন্য বই ভালোবাসি। বই থাকলে কখনো একা-একা লাগে না, রাত্তিরে ঘুম না এলে মাথা খুঁড়ে মরতে হয় না। এমনকি মিনমিনে আলো জ্বেলে রোগীর শিয়রে যদি রাত জাগতে হয়, তাও রাত কেটে যায়।’
যে কোনো শিশু এ প্রবন্ধটি পড়ে বই সম্পর্কে কৌতূহলী হবে। বুদ্ধদেবের শিশুসাহিত্য নিছক সাহিত্যের আনন্দভোজ নয়। শিশুর সৃজনশীলতার পাশাপাশি তার মনন অর্থাৎ চিন্তাজগৎ যেন সমৃদ্ধ হয় সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল তার। এখানেই অন্য শিশুসাহিত্যিকদের সঙ্গে বুদ্ধদেবের মৌলিক পার্থক্য। তার রচিত শিশুসাহিত্য শুধু শিশুপাঠ্য হয়নি, সর্বজনীন হয়েছে। তার শিশুসাহিত্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও প্রাসঙ্গিক। এটি বাংলা সাহিত্যেরই দুর্ভাগ্য যে, সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমে বুদ্ধদেব যত খ্যাতিমান ও আলোচিত, শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে তা নন। শিশুসাহিত্যের জন্য যে তিনি অসাধরণ সম্ভার রেখে গেছেন তা অনেকেরই অজানা। শিশুসাহিত্যের প্রতি এ কালজয়ী সাহিত্যস্রষ্টার গভীর মনোযোগ শিশুসাহিত্যের গুরুত্বকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। বাংলা শিশুসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বুদ্ধদেব বসুর শিশুসাহিত্য নিয়ে অধিকতর চর্চা হওয়া জরুরি।