মা কি শালিক পাখি?
হুসেইন ফজলুল বারী
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইস্টিশনে নেমে মিষ্টি গুড়ের পিঠা খেয়ে ট্যাক্সি চেপে গাঁয়ে পৌঁছে দেখি, চারপাশ বেশ নিঝুম-নিস্তব্ধ। শীতের দিন বলে ছন্নছাড়া অন্ধকার নেমেছে তরতরিয়ে। বাতাসে ভেসে এসে নাকে লাগল খড়ের পোড়া গন্ধ। রাখাল ছেলেরা বুঝি নাড়ার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। হিমেল বিষণ্নতায় গাঁয়ের পথ যেন নেতিয়ে পড়েছে। গাছপালার শিরে-লতায় পাতায় ঠিকরে পড়ছে মরা জ্যোৎস্না। চোখেমুখে লাগল কী মোলায়েম হিম? হ্যাঁ, জুঁই ফুলের পরাগের মতো ঝরছে মিহি শিশিরকণা।
বাতাসের ঝাপটায় নরম গুল্মের গা দুলে উঠছে এদিক সেদিক। হঠাৎ করেই খেজুরগাছ থেকে রসখেকো বাদুড় উড়ে গিয়ে পাঁচিলের দিকে ঝুপ করে বাড়ি খেল। কাচারির ওপাশে আতাগাছের ঝিরিঝিরি ছায়ায় একটা কুকুরছানা অতন্ত্র প্রহরীর মতো বসে থাকত না? ওই যে, খড়ের ওমে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পৃথুল কুকুরটি আড়মোড়া ভেঙে লেজ নাড়াল। আমাকে চিনতে পেরে জ্বলজ্বলে চোখের রাগী দৃষ্টি নিভিয়ে বুড়ো সারমেয় কুঁইকুঁই করে ঘুমিয়েও পড়ল।
ঠিক বুঝতে পারছি না, বাড়ির প্রবীণ কুকুরটি কী অসুস্থ হয়ে পড়েছে? ধীর পায়ে হাঁটতে থাকি। আগাছা, বাসি পাপড়ি, পাতা-কুটো জমে আমার প্রিয় উঠোন অচেনা হয়ে গেছে।
দূর থেকেই দেখা যায়, লতাপাতা শোভিত আমার মায়ের ঘরের দ্বার রুদ্ধ। লম্বা থামে একটা হলদেটে বাতি জ্বলছে নিষ্প্রভ তারকার মতো। কুয়াশার আলোয়ানে-ঢাকা বাগান, লতাগুল্ম আর গাছ-গাছালিতে নিষ্ঠুর রিক্ততার ছাপ। রজনীগন্ধার সূক্ষ্ম সৌরভে এদিকটা ম ম করছে। কোথাও কেউ নেই? নিঃশঙ্ক পাখিরাও হয়তো ঝিমিয়ে পড়েছে। পুকুর পাড় কে যেন গলা খাঁকারি দেয়। পগারের পাড়ে একটা বিশ্রী ছুঁচো চিহি চিহি করে দৌড়ে পালাল। বুনোফুল আর জলজ আঁশটে গন্ধ মিলে কেমন যেন মিশ্র গন্ধ তৈরি করেছে। হাহাকারের মতো শব্দ করে উত্তরে বাতাস এসে কলাপাতার বুকে থামে বা বাড়ি খেয়ে পাশ কাটে যায়। বাঁশঝাড়ের দিকে বিড়ালের গোঙানির শব্দ শুনি-অবিকল মানব শিশুর কান্না! কে বলবে এ নিঝুমপুরিতে আমাদের দিন কেটেছে সীমাহীন আনন্দে-উল্লাসে, আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে, হইচই করে। জীবনের টানে আমরা ভাইবোনেরা যে যার মতো ছিটকে পড়েছি। এখন আমরা কেউ থাকি বিলেতে, কেউবা ঢাকায়। অভিমানি অগ্রজ তো চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছে ঘাসে-ঢাকা গোরের জমিনে। চোখে জড়ো হলো উষ্ণ অশ্রুকণা। টুপ করে শিশির ঝরল শীতল মাটিতে।
শীতকাতর মা হয়তো আগে ভাগেই লেপের ওমে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি পা টিপে টিপে বাবার পড়ার ঘরের দিকে উঁকি দিলাম। হ্যাঁ, এ শীতের রাতেও তিনি বরাবরের মতোই বইপাঠে নিমগ্ন। পড়ার টেবিলে ঝুঁকে থাকা মানুষটিকে দেখে কে বলবে-আশিটা বছর কেটে গেছে তার এ মায়াপুরীতে। কোনোদিকে এ গ্রন্থকীটের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই-বইয়ের রাজ্যে হারিয়েই গেছেন বুঝি! শঙ্খশুভ্র চুল-দাঁড়িতে বাবাকে এখন দেখায় গুহাচারি সাধু-সন্ন্যাসীর মতো। আমি আলগোছে তার ছবি তুলতে ক্যামেরা ক্লিক করলাম। বাবা ধড়ফড় করে উঠে অবাক হয়ে বললেন, ওমা, কখন আসছ? এবার গলার স্বর উঁচু করে বললেন, দেখ, দেখ, কে আসছে! কইরে, তোরা কই গেলি? সন্ধ্যা না হতেই ঘুম! বাবার জলদ কণ্ঠস্বর পাষাণ-দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে। লাগোয়া গাছ থেকে পাখির ছানারা ডেকে উঠল খসখসে গলায়। এ কাকলির ছোঁয়াচ লাগল পেছনের বাগানে-এবার একটানা পাখির ডাকের তরঙ্গ বাজে এ স্বপ্নপুরীতে।
বলে রাখি, আমার বাবা শিক্ষকতা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে নিয়েছেন একুশ বছর আগে। তিনি বেশ বয়োবৃদ্ধ হয়েছেন। তবু সংসারের সব কিছুতে তার তীক্ষ্ণ নজর। এখনো প্রশস্ত বুক দিয়ে পরম মমতায় সব কিছু আগলে রাখেন। এখন বাবার দিন কাটে সামজিক ব্যস্ততায়, ধ্যানে, দানে। বাবা মিতবাক মানুষ। আগ বাড়িয়ে কথা বলা তার স্বভাববিরুদ্ধ। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই তবে তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে দেন সংক্ষিপ্ত উত্তর, পরামর্শ বা মতামত। ভোর না হতেই বিপন্ন মানুষজন এসে তাকে খুব জ্বালায়-কেউ হয়তো আসে মেয়ের বিয়ের সাহায্য চাইতে, কেউবা দোয়ার ভিখারি, কেউ আসে এমনিতেই-ভালোবেসে তাকে দেখতে। নিজ বাড়িতে দুদিনের জন্য বেড়াতে আসা আমি দুয়েকজন উদ্ভট আগন্তুক দেখে খানিকটা বিরক্তই হই। বিলেত প্রত্যাগত আমি বাবাকে কদমবুচি করে বললাম, বাবা, শরীর কেমন? সুশৃঙ্খল জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষটি ইদানীং কী কানে কিছুটা খাটো হয়েছেন। দিঘল আঙুলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’-এর মলাট বন্ধ করে পিতা হাঁকডাক শুরু করলে রাতের স্তব্ধতা ভেঙে চূর্ণ হয়ে যায়। ঘুম জড়ানো চোখেই মা হাজির হয়েছেন বাইরের ঘরে। বিলেতফেরত পুত্রকে দেখে মায়ের চোখে অবিশ্বাস-আনন্দমাখা অবসাদ! মা কী খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন? মা আমায় জড়িয়ে ধরে কিশোরীর উচ্ছ্বাসে হাউমাউ করে কাঁদেন। আবার হাসতে হাসতে বিষম খান। মায়ের শরীরের গন্ধে ভ্রমণক্লান্ত আমি চূড়ান্ত উজ্জীবিত হয়ে উঠি। আমি বলি, একটা ছড়া হবে না? লাজুক কিশোরীর উচ্ছ্বাসে আমার ছড়ার রানি ছড়া কাটেন এভাবে-
আমি সাগর পাড়ি দেব আমি সওদাগর
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে।
(কাজী নজরুল ইসলাম)
খানিকটা দম নিয়ে বৃদ্ধা জননী শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পুত্র, আসার আগে একটা সংবাদও দিতে হয় না?
গরম জলে স্নান করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হওয়া ছাড়া আমার উপায় থাকে না। পাড়া-গাঁয়ের মানুষ বলে আমরা সবাই কথা বলতাম খাঁটি কথ্যভাষায়। কিন্তু আমার মা বলেন অনেকটা শুদ্ধ ভাষার মিশেলে। তশতরি, পেয়ালা, কেদারা, পুস্তক, পত্র, পুত্র, কন্যা, পক্ষী, দধি, নক্ষত্র শব্দগুলো তার পাতলা ওষ্ঠে ঠিক মানিয়ে যায়। বুদ্ধিমান পড়শীদের অনেকে মায়ের ভাষাবিলাস নিয়ে হাসাহাসি করত। আমার মা হয় এগুলো বুঝতেন না, নয়তো গা করেন না। পাড়ার অন্য বউঝিরা বলত ‘ভালা তেল’ আর আমার মায়ের মাধুর্যময় মুখে তা-ই শর্ষের তৈল। ইলিশ ভাজতে গিয়ে তিনি গলদঘর্ম হতেন। তার গৌর মুখায়ব আগুনের আঁচে আরও স্বর্ণাভ হয়ে উঠত। মা যে নিপুণ গৃহিণী তা নয়। কিন্তু আমাদের সকাল সকাল খাইয়ে দেওয়ার দিকে ছিল তার নজর। খয়েরি ঘোমটা টেনে তিনি গম্ভীরমুখে তরকারির হলুদ ঝোল চেখে মিষ্টি করে হাসতেন। কেমন যেন একটা ঝাল-ঝাল গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। মায়ের ন্যাওটা ছেলে বলে সন্তর্পণে ঢোঁক গিলে ফেলতাম।
এখন হেঁসেল থেকে মাছভাজার ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ শব্দ শোনা যায়-সঙ্গে গৃহসহায়ক মুক্তার চাপা গলার আওয়াজ। মা অস্থির হয়ে মুক্তাকে বকা দেন, আর কত দেরি? কী করছিস? মাছ তো পুড়ে গেল। উঠোনে পায়চারি করতে থাকা বাবা বলেন, খেতে আসো। গায়ে ঠান্ডা লাগবে। বাবা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলেন একটা উলের চাদর। খুব একটা দরকার ছিল না, তবু অনেক বছর পর গায়ে জড়ালাম ন্যাপথলিনের গন্ধযুক্ত আলোয়ান। চিরায়ত ভালোবাসার চাদর।
খাবার সময় বাবা আমার পাতে মাছ বেড়ে দেন। মা আক্ষেপ করেন, কিছুই তো খেলি না। আমি হেসে বলি, বাবা, শরীর কেমন? বাবা আবার জিজ্ঞেস করে নেন, বাবজান, কী বলছিলা? উচ্চৈঃস্বরে বলি, শরীর কেমন? বাবা হেসে বললেন, আশিটা বছর কেটে গেছে কয়েক বছর আগে। অন্তত এক হাজার পূর্ণিমা চলে গেছে এ জীবদ্দশায়। আমি চমকে উঠে বলি, এক সহস্র পূর্ণিমা? বাবা হাসেন, আল্লাহর অসীম দয়া, শরীর ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।
এখনো খালি চোখে বইপত্র পড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চায়ের পেয়ালা হাতে পিতাপুত্র কথা বলতে থাকি মৃদু স্বরে। কিশোরী রাত বেড়ে যুবতী হয়। রাতের ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়।
বাবার জন্য এনেছি বিলেতি সুরভি। মায়ের জন্য স্বর্ণের চেইন ও গরম কাপড়। উপহার পেয়ে মায়ের চোখে-মুখে অপার্থিব হাসি ফোটে। শীতকাতর মা উবু হয়ে আবার খুক খুক করে কাশেন। অশ্রুময়ী জননী গায়ে জড়ালেন হলদে সোয়েটার-
মা কি শালিক পাখি?
তার খয়েরি শাড়িতে হলুদের ছোপ...
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)