কোলরিজ : দার্শনিক, রোমান্টিক এস্থেটিক কবি
ড. যাকিয়া সুমি সেতু
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, ১৭৭২ সালের ২১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারের অটারি সেন্ট মেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
অটারি সেন্ট মেরি হলো ইংল্যান্ডের ডেভন কাউন্টির একটি ঐতিহাসিক গ্রাম, যেখানে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের দুর্দান্ত শৈশব কেটেছিল। কোলরিজের নান্দনিক চেতনায়, মননে, শিল্পবোধে এ গ্রামের ‘সেন্ট মেরি’স চার্চ’, যা একটি অ্যাংলিকান গির্জা, ডেভনের ছোট ছোট পাহাড়, ‘ডার্টমুর’, ‘এক্সমুর’ ছিল আন্দোলিত। এখানে দাঁড়িয়ে কবি কোলরিজ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক সূর্যোদয় সূর্যাস্তের শতরূপ দেখেছিলেন। গ্রামের বনভূমি, বিশেষত ‘ওটার ভ্যালি’ বনাঞ্চল, কোলরিজের কল্পনাকে জাগিয়ে তুলেছিল বিস্মিতভাবে।
বন্যপ্রকৃতির ‘ব্লু বেলস’, ‘প্রাইমরোজ’, ‘ওয়াইল্ড রোজ’, যা গ্রামটির সীমানার হেজরোতে ফুটে কোলরিজের মধ্যে স্বপ্নের রং ছড়াত। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাস্তাগুলোর মধ্যে ‘ফেয়ার স্ট্রিট’, ‘ব্রোড স্ট্রিট’, এবং ‘চর্চ স্ট্রিট’ উল্লেখযোগ্য পথের সঙ্গে ছিল কোলরিজের গভীর ভালোবাসা। মনোলোভা পরিবেশের সান্নিধ্যে থেকে কোলরিজ প্রকৃতির প্রতি গভীর মুগ্ধতা অনুভব করেছিলেন, যা তার কবিতায় প্রতিফলিত। তার প্রাকৃতিক অনুভূতির প্রকাশ ‘Frost at Midnight’ কবিতায় এ অনুভূতির তাৎপর্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যেখানে তিনি শৈশবের স্মৃতিতে অস্তিত্বশীল প্রকৃতির নিবিষ্ট সংযোগকে তুলে ধরেছিলেন।
কোলরিজ তার বাবা রেভারেন্ড জন কোলরিজ এবং মা অ্যান বউডেন কোলরিজের ১৪ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন প্যারিসের ভিকার ও স্থানীয় গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি পাদ্রি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। বাবা থেকে কোলরিজ প্রাথমিক শিক্ষার উৎসাহ পেয়েছিলেন। তবে মাত্র নয় বছর বয়সে কোলরিজ তার বাবাকে হারান, যা তার জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাকে এক অন্তর্মুখী, কল্পনাপ্রবণ জগতে ঠেলে দেয়। বাবার মৃত্যুর পর কোলরিজকে লন্ডনের ক্রাইস্ট হসপিটাল স্কুলে পাঠানো হয়, যেখানে তার সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এখান থেকেই তার বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রা শুরু হয়। তবে বাবা হারানোর কষ্টগুলো তার শিল্পসত্তায় প্রতিফলিত হয়েছে গভীরভাবে।
ইংরেজি রোমান্টিক সাহিত্যধারার একজন আলোকিত গীতিকবি, সমালোচক ও দার্শনিক স্যামুয়েল টেলর কোলরিজকে রোমান্টিসিজম এবং লেকের কবি হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়। কোলরিজের সঙ্গে লেক অঞ্চলে থাকা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থসহ অন্য কবিরাও ‘লেকের কবি’ নামে পরিচিত। কারণ তাদের লেখায় ইংল্যান্ডের লেক জেলার অঞ্চলেরও প্রাকৃতিক দৃশ্য ও মানব আবেগের প্রতিফলন দেখা যায়। কোলরিজের অসাধারণ কল্পনা, গভীর চিন্তাধারা এবং আবেগ ইংরেজি সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গও তাকে ইংরেজি সাহিত্যিক ইতিহাসে এক অপরিহার্য স্থানে অধিষ্ঠিত করে। এ সময়ের রচিত তার কবিতা অনুমানমূলক, ধ্যানমূলক এবং অদ্ভুত বাচনিক রোমান্টিক ধারার ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠে। কোলরিজের কবিতা এবং তার সাহিত্যিক প্রতিভা সম্পর্কে ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম প্রধান কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেন : ‘Coleridge's lyrics, with their deep insight and perfect melodz, stand apart as timeless gems of English literature.’ অর্থাৎ ‘কোলরিজের গীতিকবিতা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং নিখুঁত সুরের জন্য, ইংরেজি সাহিত্যের কালজয়ী রত্ন হিসাবে তিনি আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।’
কোলরিজ ইংরেজি রোমান্টিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৭৯৮ সালে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত ‘Lyrical Ballads’ গ্রন্থটি রোমান্টিক ধারার সূচনা করে। এই গ্রন্থে কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা ‘The Rime of the Ancient Mariner’ স্থান পেয়েছে, যা প্রকৃতি, পাপ এবং মুক্তির প্রতীকী বর্ণনার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবিতাটিতে কোলরিজ অসাধারণভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানবীয় দুর্বলতা উভয়কেই তুলে ধরেছেন। কবিতাটির একটি অতি পরিচিত লাইন- ‘Water, water, everywhere,/Nor any drop to drink’ অত্যন্ত প্রভাবশালী, যা সংকটের চিত্রায়ণ করে যখন সমুদ্রের চারপাশে জল থাকার সত্ত্বেও পান করার জন্য এক ফোঁটা জলও পাওয়া যায় না। এটি শুধু একটি শারীরিক বিপদের চিত্র নয়, বরং মানব অস্তিত্বের অপরিহার্যতা ও বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। কোলরিজের কবিতা সমৃদ্ধ প্রতীকী চিত্রায়ণের মাধ্যমে মানব অস্তিত্বের গভীর দার্শনিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে, যা পাঠককে চিন্তার তীরে নিয়ে যায়। ‘The Rime of the Ancient Mariner’ মানবিক অন্তর্দৃষ্টির সমন্বয় ঘটায় এবং সেই সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি মানুষের সম্পর্কের বিভিন্ন মাত্রাকে অনুসন্ধান করে, যা কোলরিজের সাহিত্যিক গুণাবলির একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। ‘’
কোলরিজের ‘Kubla Khan’ তার সাহিত্যিক প্রতিভার আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা ‘In Xanadu did Kubla Khan/A stately pleasure-dome decree’ দিয়ে শুরু হয়। এ কবিতায় কোলরিজ কল্পনার এক রাজ্যে পাঠককে প্রবেশ করান, যেখানে তিনি একটি বৈভবময় এবং অলীক নির্মাণের চিত্র তুলে ধরেন। এখানে তিনি গঠন করেন একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জগৎ, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানবীয় স্বপ্নের মিলন ঘটে। কোলরিজের রূপক এবং স্বপ্নময় চিত্রায়ণ কবিতাটিকে একটি বিমূর্ত ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রদান করে, যা পাঠকদের মনোজাগতিকতার গভীরে পৌঁছে দেয়। অপরদিকে, ‘Christabel,’ একটি অসম্পূর্ণ গথিক কবিতা, ভয়ের ছায়া এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবের মধ্যে নিষ্পাপতাকে উপস্থাপন করে, যা তার কাব্যিক প্রতিভার বৈচিত্র্যময় দিককে উদ্ভাসিত করে। এখানে কোলরিজ মানব প্রকৃতির অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি নজর দেন এবং অতিপ্রাকৃত উপাদানের মাধ্যমে ভয় এবং রহস্যের অনুভূতি সৃষ্টি করেন। কোলরিজের কবিতাগুলো শুধু রোমান্টিক কাব্যের প্রসার ঘটায়নি; বরং তার শৈল্পিক ক্ষমতা ও গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে তিনি মানব প্রকৃতির গভীরতা ও রহস্যময়তাকে অসাধারণভাবে প্রকাশ করেছেন। কোলরিজ তার সাহিত্যিক কাজের মাধ্যমে মানব অস্তিত্বের জটিলতাকে এভাবেই অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, যা তাকে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অসাধারণ স্থান দিয়েছে। Christabel-এ কোলরিজের গভীর প্রত্যয় :
‘Tis the middle of night by the castle's top, And the owls are hooting, the night winds drop, But the moon is shining bright.’
স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের Biographia Literaria তার সাহিত্য সমালোচনার একটি যুগান্তকারী রচনা, যা কল্পনা, সৃজনশীলতা এবং কবিতার প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। এ গ্রন্থে তিনি কল্পনার ভূমিকা এবং কবির দায়িত্ব সম্পর্কিত তার চিন্তাধারার বিশদ বর্ণনা দেন, যা পরবর্তী কবি ও দার্শনিকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে ওঠে। কোলরিজের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহিত্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিফলন তার লেখার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যদিও তার জীবদ্দশায় যথাযথ স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন ছিল, তার মৃত্যুর পর তার সাহিত্যিক কৃতিত্ব ও প্রভাব বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়েছে। এ রচনা থেকেই নতুন ধারার কবিতা এবং সাহিত্য সমালোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছে। Biographia Literaria থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন: ‘It is the prime function of the imagination to create a world that stands outside of the ordinary experience. The poet is the man who speaks to the reader in his own voice, not the voice of the world.’
কোলরিজের এ চিন্তাধারা তার সমসাময়িক এবং পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের সাহিত্যিক প্রতিভা অসাধারণ হলেও তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল ভয়াবহ সংগ্রামের সাক্ষী। সারা ফ্রিকার সঙ্গে তার বিয়ের সম্পর্ক সুখকর ছিল না; পারস্পরিক অসন্তোষ এবং জটিলতা তাদের জীবনকে বিষময় করে তুলেছিল। এ ছাড়া সারা হাচিনসনের প্রতি কোলরিজের একতরফা ভালোবাসা তাকে গভীর দুঃখ ও হতাশায় ডুবিয়ে রেখেছিল। এর পাশাপাশি, লডানাম (আফিম) আসক্তি ছিল তার জীবনের একটি প্রধান সমস্যা, যা কেবল তার স্বাস্থ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং তার সৃষ্টিশীলতাকেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। কোলরিজের এসব চ্যালেঞ্জগুলো তার রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে তিনি মানব জীবনের অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদর্শন করেছেন। তার সাহিত্যকর্মগুলোতে আত্ম-অনুসন্ধান এবং আধ্যাত্মিক সংগ্রামের বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে, যা তাকে একজন জটিল এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কোলরিজ ১৮৩৪ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনের হাইগেটে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বিশ্ব এক অসাধারণ প্রতিভাকে হারিয়েছিল, কিন্তু তার সাহিত্যিক কীর্তি অম্লান হয়ে থাকে। কোলরিজের রোমান্টিক চিন্তাধারা, কল্পনাপ্রবণ কবিতা এবং দর্শনচিন্তা আজও সাহিত্যের অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তার কাজগুলো নতুন চিন্তাভাবনার পথপ্রদর্শক এবং কাব্যের রূপ ও স্বরূপের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কোলরিজকে হাইগেটের সেন্ট মাইকেল চার্চে সমাহিত করা হয়, যেখানে তার মৃত্যুপরবর্তী স্মৃতি চিহ্নিত হয়েছে। তার অবদান ও প্রভাব আজও সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস, এবং তার লেখা আমাদের ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে।