বইপড়া বিষয়ে একদল মানুষ মনে করেন, বইপত্র পড়ে কোনো লাভ নেই। ছাপা বইপত্র মানুষকে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ফেলে দেয়। মানুষ অন্যের চিন্তার দাসে পরিণত হয়। কারণ, ছাপা বইয়ে যে-উপলব্ধি খোদাই করা থাকে তা অন্যের উপলব্ধি। অন্যের ধার করা উপলব্ধির ভারবাহক হওয়ার কোনো মানে হয় না। এতে শিক্ষাও পূর্ণ হয় না। এর চেয়ে বরং চারপাশের প্রকৃতি বা চলমান জীবন প্রবাহ পড়াই ভালো। এ পাঠ, শিক্ষা বা জ্ঞান যা-ই বলি না কেন, এটা একান্তই নিজের হয়। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক রুশো এ মতবাদের লোক ছিলেন। আমাদের আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে সরদার ফজলুল করিম অনেকটা এ মতবাদের মানুষ ছিলেন।
অন্য মতের মানুষও আছেন। তারা মনে করেন, ব্যক্তি-মানুষের জানা ও বোঝার জগৎ ছোট। এ জানা-বোঝার জগৎকে বড় করার প্রধানতম উপায় হচ্ছে বইপড়া। বিচিত্র মানুষ বিচিত্র বইয়ে তাদের নানাবিধ চিন্তার জগৎকে মেলে ধরেছেন। এ বহুবিধ চিন্তার জগতের সঙ্গে বইপড়ার মাধ্যমে যুক্ত হয়ে নিজের ছোট জগৎকে বড় করা যায়। বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রমথ চৌধুরী এ মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশে এ মতের জীবন্ত উদাহরণ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি তার জীবনের প্রায় বারো আনাই ব্যয় করেছেন মানুষকে পড়ানোর ব্রত পালন করে। বই পড়ানোর মাধ্যমে তিনি মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছেন। এ বই পড়া-দরকার-মতাদর্শীদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা এমনকি মনে করেন যে, জ্ঞানার্জনের জন্য শুধু বই পড়লেই যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়েও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওখানে যাওয়া সময়ের অপচয়মাত্র। বিশেষত মুদ্রণশিল্পের এ চরমোৎকর্ষের যুগে টাকা ও শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুর বচন শোনার কোনো মানে হয় না। এজন্য বই এবং বইয়ের আড়ত লাইব্রেরি হলেই যথেষ্ট। এর সঙ্গে বড়জোর বিশেষ আগ্রহের দরকার হতে পারে।
একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আসলে মুদ্রিত বই পড়া ও না-পড়া এই দুই মতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুই পক্ষই মূলত পড়ার কথাই বলেন। পার্থক্য এই যে, লিখিত বই পড়া আর অলিখিত বই পড়া। দুটিই শেষ পর্যন্ত সেই পড়াই। আসল কথা হচ্ছে, মানুষকে পড়তেই হয়। কারণ ব্যক্তি মানুষের জানা-বোঝার পরিসর সীমিত। ছোট পৃথিবী থেকে মানুষ ক্রমাগত বড় পৃথিবীতে পা রাখে; রাখতে হয়। ‘তারপর কী!’ মানুষের এই চিরন্তন ক্ষুধাকে মেটাতে, নিজের পরিসরকে বাড়াতে এবং নিজেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে, জীবন-জগৎকে বুঝতে মানুষকে পড়তেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও বলেছেন, নিজের জ্ঞানের দীনতা ‘ভিক্ষালব্ধ ধন’ দিয়ে অর্থাৎ অন্যের লেখা বই পড়ে দূর করি। তার ভাষায়, ‘বিশাল বিশ্বের আয়োজন;/মন মোর পড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।/সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে/অক্ষয় উৎসাহে-/... জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে/পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।’ মোদ্দা কথা, প্রকৃতি পাঠ করাই বলি আর কারও লেখা বই পড়াই বলি আমাদের পড়তেই হয়।
নিজেকে ও জীবন-জগৎকে বোঝার বাসনা জীবজগতে একমাত্র মানুষেরই তো আছে। এ জানা-বোঝার ভেতর দিয়েই মানুষ ঠিক করে যে, পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্য তার নিজের এবং বৃহত্তর মানব সম্প্রদায়ের কিছু করণীয় আছে। শুধু উদরপূর্তির জন্যই সে পৃথিবীতে আসেনি। কেবল উদরপূর্তিভিত্তিক যে-জীবন তা মানুষের নয়, পশুর।
তবে কি বই পড়ার প্রধান উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বোঝা আর একে সুন্দর করতে নিজের করণীয় সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে আসা! অবশ্যই বইপড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য এটা নয়। বইপড়ার আরও হাজারটি কারণ দেখানো যায়। কিন্তু এখানে শুধু এতটুকু বলা দরকার যে, বই মানুষ আনন্দের জন্যেও পড়ে। কী সেই আনন্দ!
মানুষ মূলত বাস করে খুবই একঘেয়ে এক পরিপার্শ্বের মধ্যে। বনের পশুর এ একঘেয়েমি নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কারণ, জীবনের মানে তো তার কাছে শুধু ওই উদরপূর্তি। কিন্তু মানুষের ‘আরও কিছু’ লাগে। বলা যায়, এই ‘আরও কিছু’টাই মানুষের বেশি লাগে। এজন্য দেখা যায়, মানুষের থাকতে লাগে সাড়ে তিন হাত জায়গা। কিন্তু সে ঘর বানায় অধিকাংশ জায়গা ফাঁকা রেখে। সে বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় খাবার জন্য প্রয়োজনীয় ফসল না-ফলিয়ে ফুলের গাছ লাগায়। এক অর্থে সময়ের আর অর্থের অপচয় বটে! কিন্তু মানুষ এসব করে। কারণ, তার মুক্তির দরকার হয়। বই তার এক ধরনের মুক্তি। চেনা এবং প্রয়োজনের জগৎ থেকে মুক্তি। এ মুক্তিতে তার আনন্দ। এ আনন্দের জন্য মানুষকে বই পড়তে হয়, সেটা লিখিত বই-ই হোক আর অলিখিত বই-ই হোক।
কিন্তু প্রাইভেট আনন্দের ব্যাপারটার চেয়ে বই পড়ার অন্য গুরুতর দরকারি দিকও আছে। বর্তমান পৃথিবী একমাত্রিকতার জঞ্জালে পরিণত হচ্ছে। মানে, যে কোনো বিষয়কে একদিক থেকে দেখে সিদ্ধান্তের প্রবণতা বাড়ছে। একেই বোধ করি বলা হয় ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ। বই মানুষকে বহু চোখ দেয়। গ্রহিষ্ণুতা বাড়ায়। বইপড়া-মানুষ একটা বিষয়কে নানাদিক থেকে দেখার বহুমাত্রিক চোখের অধিকারী হয়; ‘ক্রিটিক্যাল’ হয়। সংলাপপ্রবণ হয়। বহুবিচিত্রের কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে বই পড়া মানুষ নিজেকে খাঁটি সোনা বানিয়ে তোলে। এই ‘ক্রিটিক্যাল’ হওয়ার জন্য, বহুমাত্রিক হওয়ার জন্য, শ্রেয়তরকে প্রতিষ্ঠার তাগিদে বইপড়া দরকার।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বই কম পড়ে বলে একটা আফসোস পড়ুয়া সমাজে চালু আছে। এদিক বিবেচনা করে প্রশ্ন তোলা দরকার, বাংলাদেশের মানুষ বই পড়ে না কেন? কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। এত ভিন্ন যে, এখানে বরং উলটো প্রশ্ন তোলা দরকার, বাংলাদেশের মানুষ বই পড়বে কেন। কারণ বই না-পড়ার জন্য একটা সমাজে ও রাষ্ট্রে যে-যে শর্ত বিরাজ করতে হয় তার প্রায় সবই এখানে বেশ তবিয়তে বহাল আছে।
প্রথমত পড়াশোনা করার জন্য একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ লাগে। মানে হলো, বই পড়ার চল সমাজে থাকার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের বিচিত্র কাজকর্ম-চিন্তাভাবনার ভিত্তি হতে হয় জ্ঞান। অর্থাৎ সমাজে অজ্ঞানতা কখনো জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করবে না; দাবায়ে রাখবে না; রাজ করবে না। জ্ঞান কখনো অজ্ঞানতার নফরি করবে না। আমাদের সমাজটা কি জ্ঞানভিত্তিক!
গভীরভাবে লক্ষ করলে খালি চোখেই বেশ দেখতে পাওয়া যায়, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রটা ভেতরগত খাসলতের দিক থেকে একটা সামন্ত বা আধা-সামন্ত সমাজ ও রাষ্ট্র। কারণ এর প্রায় প্রতিটি স্তরে জ্ঞান নয়, যুক্তি নয় বরং একক বা কিছু ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ঈশ্বরের মতো রাজ করে; সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যক্তির মর্জির ওপরই ন্যায্যতা-অন্যায্যতার পারদ ওঠানামা করে। ব্যক্তির এমন ঐশ্বরিক, খামখেয়ালিপূর্ণ এবং আসুরিক আধিপত্য খুব কম সমাজেই দেখতে পাওয়া যাবে। যে কোনো পরিসরে আপনার যৌক্তিক প্রাপ্যতা ঈশ্বরপ্রতিম একজন বা গুটিকয়েক ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতাবান হওয়া ব্যক্তি বা ব্যক্তিগুচ্ছ চাইলেই আপনার ন্যায্যতার প্রশ্নকে মুহূর্তেই এক ফুৎকারে উড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। আপনাকে আপনার অধিকারের চৌহদ্দি থেকে করতে পারে চিরনির্বাসিত। ঠিক যেন সেই মধ্যযুগের কোনো জমিদার-তালুকদার ভূস্বামী কেউ। অথচ যুগটা কত আগেই না গত হয়েছে!
ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যে সমাজ-রাষ্ট্রে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতিনিয়ত ভূলণ্ঠিত হয়, মানবিক মর্যাদা যেখানে শুধু বইয়ের বুলি, ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারটা যেখানে কাগুজে ফুলের মতো দেখতে-শুনতে বাহারি কিন্তু কোনো বাসনা ছড়ায় না, সেখানে মানুষ পড়বে কেন! পড়াশোনা বা জ্ঞানের চর্চা তো শুধু একটা যৌক্তিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্রেই দানাদার হয়ে উঠতে পারে। ন্যায্যতার মানদণ্ড দ্বারা সুনির্দিষ্ট কাঠামোবাদী কোনো সমাজের পরিসরেই তো জ্ঞানচর্চা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায্যতার কাঠামো-নির্দিষ্ট-সমাজ ও রাষ্ট্র ছাড়া বই পড়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠতেই পারে না। যেখানে জ্ঞানের ব্যাপারটা মূল্যহীন সেখানে কেন জ্ঞানের চর্চা থাকবে! অথবা বলা যায় যেখানে জ্ঞান-অজ্ঞানের ভেদ রেখা কাজ করে না, সেখানে একটা বই পড়া জাতি কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও গড়ে ওঠেনি, বাংলাদেশেও গড়ে উঠতে পারে না।
বাংলাদেশ নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এতদূর এসেছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পরিবর্তনের সময়ে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন খুব কমই এসেছে। একটা জ্ঞানভিত্তিক, বহুস্বরিক রাষ্ট্রগঠনের আন্তরিক প্রচেষ্টা খুব কমই দেখা গিয়েছে। বরং ওই সামন্তরোগের সংক্রমণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। ফলে মানুষ হতাশ হয়েছে। হয়তো এভাবেই আমাদের ক্রমমুক্তি হবে। এ কথা ছাড়া আর কী-ইবা বলা যেতে পারে।