প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের চিন্তার দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণে
সাঈদ-ফুকো ও অন্যান্য তাত্ত্বিক
গাজী গিয়াস উদ্দিন
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডব্লিউ এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ওরিয়েন্টালিজম তত্ত্বে’ পাশ্চাত্যের প্রাচ্য চর্চায় ‘ক্ষমতা, আধিপত্য ও কর্তৃত্ব’ অনুশীলনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সম্পর্ক হচ্ছে ক্ষমতা, আধিপত্য ও কর্তৃত্বের। স্যামুয়েল পি হান্টিংটন পরবর্তী সময়ে The clash of civilization প্রবন্ধে সাঈদের ব্যাখ্যা ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। হান্টিংটন পাশ্চাত্যকে আলাদা না করে সমগ্র বিশ্ব সভ্যতাগুলোকে হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘কমপক্ষে প্রধান ছয়টি শক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, জাপান, রাশিয়া এবং সম্ভবত ভারত এবং সে সঙ্গে কিছু মধ্যম আকৃতির রাষ্ট্র হতে অনাগত ভবিষ্যতের মূল নিয়ন্তা।’
সাঈদ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাষা, সংস্কৃতি ও সংগীতের ভিন্নতা তুলে ধরেছেন। এমনকি চিন্তাচেতনার পার্থক্যের কথাও বলেছেন।
মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হলে তুলনা করতে শুরু করে। তুলনার ফল এই যে, সব ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্য নিকৃষ্ট। সাঈদ প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যায় বলেছেন-
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মানুষের মৌলিক পাঁচটি পার্থক্যের কথা-
১) প্রাচ্যের মানুষ আনুমানিক কথা বলে। পাশ্চাত্য নিখুঁত কথা বলে।
২) প্রাচ্য দাঙ্গা হাঙ্গামা ও খুন খারাবিতে লিপ্ত। পাশ্চাত্য সুশৃঙ্খল।
৩) প্রাচ্য অলস। পাশ্চাত্য কর্মঠ।
৪) প্রাচ্য কালো (খারাপ) । পাশ্চাত্য শাদা (ভালো)।
৫) প্রাচ্যের সংগীত দুর্বল। পাশ্চাত্যের সংগীত জীবনমুখী।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সাঈদ বলেছেন-
‘প্রাচ্যকে জানা, প্রাচ্যকে হীন হিসাবে উপস্থাপন করা, সেই হীনকে কব্জা করা, তাকে দখল করা এবং তাকে শাসন করার একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা হচ্ছে প্রাচ্যতত্ত্ব’।
আর তাই নিকৃষ্ট অঞ্চলকে উৎকৃষ্ট করার মনোবাসনা থেকেই পাশ্চাত্যের মধ্যে জন্ম নেয় কর্তৃত্ব, দখল ও ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা।
‘মনোবৃত্তি ও প্রয়োগ’ তত্ত্ব অনুযায়ী প্রাচ্যও আম্যাজনের আদিবাসীদের নিম্নশ্রণীয় ভাবে। ভালোমন্দ, পছন্দ-অপছন্দ, অনুসরণ বা বর্জনের দিক থেকে কেউ ভারতপন্থি, কেউ পাকিস্তান বা সৌদিপন্থি। কেউ সাম্যবাদী তাই মস্কো বা পিকিংপন্থি। পুঁজিবাদীদের কাছে মার্কিন, বামপন্থি বিপ্লবীদের কাছে কিউবা উত্তম।
অন্তর্দেশীয় আঞ্চলিক পার্থক্যও রয়েছে। যেমন: নোয়াখাইল্যা, বরিশাইল্যা। উত্তর বঙ্গের মানুষ একগুঁয়ে। কুমিল্লার মানুষ গোঁড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্ছৃঙ্খল, খুলনা আত্মকেন্দ্রিক। এভাবে পরস্পরে হেয় প্রতিপন্নের প্রবণতা। পেশাগত সিভিল সার্ভিস বনাম অন্যান্য চাকরি। ধর্মীয় দৃষ্টিতে হালাল হারামের প্রভেদ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তুলনার প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়।
এডওয়ার্ড ওয়ার্দি সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) মার্কিন ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক এবং রাজনৈতিক কর্মী। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে উত্তর ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। সাংস্কৃতিক সমালোচনা গবেষক হিসাবে তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’ ১৯৭৮ সাড়া জাগানো বই। এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত প্রাচ্য সম্পর্কিত পশ্চিমা মনগড়া মিথ ও প্রচলিত ধারার ভিত্তিতে পশ্চিমা ভাষ্য, মিডিয়া প্রতিনিধিত্ব ও শিক্ষাগত পাণ্ডিত্য সুদীর্ঘকাল যে আধিপত্য জারি রেখেছে, সেগুলো শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করার একটি পদ্ধতিগত কাঠামো সাঈদ ওই বইয়ে পরিবেশন করেছেন।
ফরাসি চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী মিশেল ফুকো ডিসকোর্স (দার্শনিক ভাষ্য)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে সাঈদ বুঝিয়েছেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের পার্থক্য জ্ঞান।
প্রাচ্যের মুসলিম নারীদের হিজাব বা পর্দা প্রথাকে ধর্মান্ধ অবমাননাকর হিসাবে এর বর্জন কামনা করে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি।
জেরুজালেম দখল বেদখল নিয়ে খ্রিষ্টান বনাম মুসলমান দ্বন্দ্বের উদাহরণ টেনে ফুকো বলতে চেয়েছেন, ডিসকোর্স কীভাবে সমাজে আদর্শের বিপরীতে দাঁড়ায়। ফলে ডিসকোর্স অনুযায়ী মানুষ জীবন বদলে নেয়। আদর্শ ও মূল্যবোধ তখন চিন্তায়ও আসে না। অর্থাৎ ডিসকোর্স বিশ্বাসে রূপ নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘জ্ঞানই শক্তি’-এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ফুকো বলেছেন, কেবল জ্ঞানই শক্তি নয়, বরং শক্তির মাধ্যমেও জ্ঞান উৎপাদন করা যায়। ক্ষমতার চর্চায় জ্ঞান ঠিক করে দিয়ে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞানগুলোকে বাতিল’ করে দিয়ে তথাকথিত সত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মধ্যযুগীয় কায়দায় শাস্তি প্রদান না করে, ডিসকোর্সের মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার আধুনিক রাষ্ট্র ক্ষমতার পদ্ধতি প্রতিহত করা যায় না। রাজনৈতিক প্রতিরোধ বা বিপ্লবের মাধ্যমেও নয়-এটি ফুকো দেখিয়েছেন। তবে তিনি ডিসকোর্সকে বদলে দেওয়ার পথ বাতলেছেন। তা হচ্ছে বিপরীত ডিসকোর্স তৈরি করা। ক্ষমতার বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রতিরোধ। অন্যান্য তাত্ত্বিকরা ফুকোর এ Power Relating and Discourse কে ‘অস্পষ্ট ও অনুমানপ্রসূত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও তার লেখা ও লেকচারগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে চাপিয়ে দেওয়া ধারণা কীভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কীভাবে ডিসকোর্সের বাইরেও চিন্তা করা যায়, তা ফুকোই প্রথম দেখিয়েছেন। আধুনিক নারীবাদ, কুইয়ার তত্ত্ব, সংস্কৃতিবিদ্যা ইত্যাদি ফুকো তত্ত্বের কাছে ঋণী।
মূলত : এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবাদী চিন্তার বিশ্লেষণ এবং পাশ্চাত্য মনীষীদের মধ্যে বিখ্যাত মার্কিন রাজনীতি বিজ্ঞানী এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পি হান্টিংটন, ফরাসি চিন্তানায়ক মিশেল ফুকো, ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্র প্রমুখের চিন্তার ঐক্য ও মৌলিক বিরোধ। সার্ত্র আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। অথচ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে থাকেননি। হান্টিংটন ইসলামি সংস্কৃতির উত্থানকে পাশ্চাত্যের জন্য বড় হুমকি বিবেচনা করেছিলেন।