ছবি: সংগৃহীত
আয়নার দিকে আমরা তাকাই। কমবেশি তাকাই। দিনের কোনো একটা সময় তাকাই। ঘরে আয়না থাকুক, আর না থাকুক, না থাকলে কোথাও আয়না দেখলে, গ্লাস দেখলে, রিফ্লেকশন দেখলে, আমরা সেদিকে তাকাই। নিজেদের আয়নায় দেখি। কিন্তু কী দেখি? আপনিও আয়নায় তাকালে কী দেখেন? উত্তরে হয়তো বলবেন-আমরা নিজেকে দেখি। কিন্তু আমরা আমাদের কী দেখি, অথবা যেটাই দেখি, কেন দেখি?
আয়না মানে রিফ্লেকশন বা প্রতিফলন। আয়নার প্রতিফলনে আমরা আমাদের কমবেশি দেখি। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমরা আমাদের কী কী দেখি, কিংবা আপনি কী দেখেন? এটা কি শুধু আমার চেহারা, আপনার চেহারা বা অন্য কিছু? এটা কী আমার-আপনার শারীরিক গঠন, মুখ, চোখ কিংবা চুল? নাকি আয়নায় নিজেকে দেখার এ সাধারণ দৈনন্দিন কাজটির মধ্যে আরও কিছু আছে? আয়না অবলম্বন হয়ে এলেও এর গভীরে কোথায় লুকিয়ে আছে তার আরেকটি অর্থ? আয়নায় দেখার মধ্যে আরও গভীর কিছু কি আছে? নিজেকে দেখার আড়ালে আয়নায় আমরা কী খুঁজি? চলুন, অনুসন্ধান করি।
এক.
প্রতিদিন সকালে আয়নায় নিজেকে একনজর দেখা দিয়ে দিন শুরু করি আমরা। হয়তো কখনো সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠে না। একটু পর হয়, ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার আগে হয়, ওয়াশ রুমে কিংবা দাঁত পরিষ্কার করতে গিয়ে হয়। এটি প্রায় একটি অভ্যাস বলেন, স্বভাব বলেন, রীতিমতো এক ধরনের লাইফলং মানসিক আচারের মতো তৈরি হয়ে যায়। আয়নায় তাকিয়ে আপনি নিজের দিকে তাকান, মুখের দিকে তাকান, আপনার চুল ঠিক আছে কিনা দেখেন, ঠিক না থাকলে চুল ঠিক করেন। সরাসরি ফোকাস না করলেও চোখে-মুখে ঘুমের কোনো লক্ষণ এখনো আছে কিনা, অনেক সময় প্রয়োজন না থাকলেও আপনি তা দেখেন, নিজের চোখে-মুখে তা পরীক্ষা করেন। ঘুম কমবেশি হলো কিনা সেটা মস্তিষ্কের চেয়ে মুখের লাইনগুলো পড়ে সিদ্ধান্ত নেন, নিজের মধ্যে তৃপ্তি-অতৃপ্তি খোঁজেন। কিন্তু আমরা যখন আয়নায় তাকাই, তখন আমরা সত্যিই কি এগুলো দেখি? আপনি যদি সত্যিই এগুলো নিয়ে চিন্তা করেন, এটি কি কেবল একটি মুখের প্রতিফলন, নাকি এটি গভীর কিছুর প্রতিফলন?
আসলে আমরা যখন আয়নায় নিজেদের দেখি, আমরা কেবল আমাদের মুখ দেখতে পাই না; আমরা আমাদের পরিচয় দেখি। লোকে আমাদের দিকে ফিরে তাকালে কেমন দেখে আমাদের, আমরা সেটা দেখি। এই দেখার, নিজেদের পরিচয় উদ্ধার, এসবের মধ্যে থাকে আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের আবেগ, আমাদের আত্ম-উপলব্ধির বিভিন্ন স্তর।
দুই
আয়নায় নিজেকে দেখার মনস্তত্ত্ব দিয়ে শুরু করা যাক। একটি আয়না শুধু আমাদের শারীরিক অস্তিত্বকে নয়, আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অস্তিত্বকেও প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। এ নিয়ে বিখ্যাত দার্শনিক এবং সাইকোলজিস্ট জ্যাক ল্যাকানের প্রস্তাবিত একটি দর্শন তত্ত্ব আছে, একে বলে-‘মিরর স্টেজ’। এটি জšে§র পর এমন একটি মুহূর্ত, যখন একটি শিশু প্রথম নিজেকে আয়নায় চিনতে পারে এবং ‘আমি’ বা নিজের ধারণাটি বুঝতে শুরু করে। এটাই আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্ম দেয়। এমন করে আমরা শিশুবেলায়ই পৃথিবী বুঝার আগে বুঝতে পারি আমি কে! আমি’র অস্তিত্বকে সে চিনতে পারে এ প্রতিফলনে, আয়নার প্রতিফলনে, নিজেকে আলাদা করতে পারে অন্যদের থেকে।
এ প্রক্রিয়া যৌবন পর্যন্ত চলতে থাকে। আমরা ক্রমাগত নিজেদের দিকে তাকাই, সময় পেলে তাকাই, পথ চলতে চলতে তাকিয়ে থাকি। এ তাকানোতে আমরা আমাদের আমিত্বকে অনুসন্ধান করি। কখনো কখনো আমরা নিজেদের আত্মবিশ্বাস দেখতে; অন্য সময়, আমরা সেখানে নিরাপত্তাহীনতা দেখতে পাই, নিজেদের ভেতর ভয় দেখতে পাই। আমরা দেখতে চাই-আমরা কী হতে চাই, কে হতে চাই, বা আমরা যা ভয় পাই, সেটাকে অলক্ষে আমরা দেখতে পাই। আয়নার প্রতিটি নজর আমাদের স্ব-ইমেজ চেক ইন করার একটি সুযোগ করে দেয়।
এখানে একটা মজার টুইস্ট আছে। আমরা আয়নায় যে উদ্দেশ্যে দেখি, সেটার প্রতিফলন কী আসলে আমরা দেখতে পাই? বরং পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, আয়নায় যে উদ্দেশ্যে যেটা দেখতে চাই, সেটার প্রতিফলন যেমনই থাকুক, যা দেখতে চাই সেটা আসলে আমাদের আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবেগটুকু এখানে দেখাকে বিকৃত করে, পরিবর্তন করে। যেমন, দিনটিতে আপনার মন খারাপ। তখন যেটাই দেখেন না কেন আয়নায়, এক ধরনের অসম্পূর্ণতার ওপর আপনি ফোকাস করবেন বেশি। আবার একটি ভালো দিন যাচ্ছে, আপনার মুড ভালো, আপনার দেখা এখানেও বিকৃত হতে পারে। প্রতিফলনের অনেক ত্রুটিও আপনার নজর এড়িয়ে যেতে পারে। আমরা যা কিছু দেখি, হোক সেটা আয়নায়, হোক সেটা আকাশ, আমাদের মন, আমাদের মেজাজ, আমাদের ওপর সামাজিক চাপ সেই দেখাকে প্রভাবিত করে। দেখাটুকু তখন রিয়েলিটির দেখা না হয়ে যেমনটা আমাদের মনগুলো ভাবছে, সেটাই আমরা দেখতে পাই।
তিন.
এবার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আয়নায় দেখার ব্যাপারটিকে চিন্তা করা যাক। আয়নায় আমরা যা কিছু দেখি, তা নিয়ে কেন আমরা এত চিন্তা করি?
সমাজ আমাদের প্রকাশ, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, কমিউনিকেশন, মুড, এমনকি আমাদের চেহারার স্ট্যান্ডার্ড কেমন, এসবের ওপরও প্রচুর চাপ দেয়। আমরা সেটা স্বীকার করি বা না করি। মিডিয়া, সিনেমা, টিভি, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থাপিত এবং অন্যদের দ্বারা প্রশংসিত আদর্শ সৌন্দর্যকে বা তার একটি স্কেলকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে নিই আমরা। সেই আরোপিত স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিয়ত আমাদের ওপর তেমন হওয়ার বোমাবর্ষণ করতে থাকে। সে স্ট্যান্ডার্ড বা স্কেলের আলোকে নিখুঁত মুখ এবং দেহের ছবির প্রতি একদিকে যেমন আকর্ষিত হয়ে উঠি, তেমনি নিজেদের আকর্ষণের যোগ্য করে তুলতে নিজেদের যোগ্যতা, মেধা, সময়, অর্থের অপচয় এবং বিনিয়োগ করি। যখন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই, আয়নায় তাকাই, তখন এ নিখুঁত খোঁজার খেলায় একটি নীরব তুলনা করি। নিজের ভেতর নিজেকে অজান্তে পরিমাপ করি। আমি কী যথেষ্ট ভালো? আমি কী যথেষ্ট আকর্ষণীয়? আমি কী যথেষ্ট সফল?
কিন্তু আমরা যদি একটি ভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি-আমি কী অন্যের চোখে দেখতে ভালো? এমনটির পরিবর্তে আমরা যদি জিজ্ঞেস করি-আমি নিজের কাছে নিজে কী ফিল করছি! আমার কাছে আমি কতটুকু সম্পূর্ণতায় ধরা দিয়েছি, আমার নিজের ভেতরকে আমি কতটুকু ছুঁতে পেরেছি। আয়না শুধু আমাদের চেহারাই প্রতিফলিত করে না; আয়না আমাদের ভেতরের ভালো লাগাটুকুকেও প্রতিফলিত করতে পারে। যখন আপনাকে ক্লান্ত দেখায়, তখন কি শুধু ঘুমের অভাব, নাকি আপনার মনে অন্য কিছু ভর করে আছে? আয়নায় আপনাকে যখন খুশি দেখায়, এটা কি আপনার মেকআপের কারণে নাকি গভীর অন্য কিছুর কারণে-হয়তো পরিপূর্ণতার একটা অনুভূতি আপনার ভেতর-বাহিরকে এক করেছে!
চার.
এবার চলুন দৈনন্দিন জীবনে আয়নার ব্যবহার নিয়ে। সারা দিনে আপনি কতবার নিজেকে আয়নায় দেখেন? বাথরুমে, ডাইনিং রুমে, সিঙ্কে হাত ধুতে গিয়ে, বেড রুমে আয়না থাকলে তার কথা না হয় বাদ দিলাম, পার্ক করা একটি গাড়ির কাচে, হেঁটে যেতে যেতে একটি দোকানের জানালায়, এমনকি আপনার ফোনে সেলফি ক্যামেরায়! আমরা আমাদের চারপাশে প্রতিবিম্ব দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু এ প্রতিবিম্ব, এ রিফ্লেকশন, আমাদের ভেতর কী দিচ্ছে?
‘মিরর অ্যাংজাইটি’ নামে একটি শব্দ আছে। টার্মটির অর্থ হলো-ছোট হোক, মাঝারি হোক প্রতিটি সামান্য বিষয়কেও নিখুঁত করার জন্য আপনার চেহারাটিকে আয়নায় বারবার দেখার, পরীক্ষা করার অবিরাম প্রয়োজন এবং চেষ্টা। সেলফি এবং ফিল্টারের যুগে আমরা আগের চেয়ে আমাদের ছবিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করতে প্রতিনিয়ত ছবিকে চোখ দিয়েই বারবার ফিল্টার করি। তারপর যন্ত্রের বা অ্যাপসের বিভিন্ন অপশন থেকে সেটির খুঁতগুলোকে সরাতে চেষ্টা করি। আমরা শুধু নিজেদের দেখার জন্য নয়, বরং আমরা যা দেখি, তার ক্রমাগত উন্নতি হোক, ফলস আকর্ষণীয় হোক, ফেইক কনফিডেন্স হোক, বারবার নিজেদের চাহিদার মতো পরিবর্তন করার জন্য আয়না খুঁজি। এ আয়না কখনো প্রকৃতি আয়না হয়ে আসে, কখনো ক্যামেরার লেন্স হয়ে আসে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো আয়না আপনাকে সংজ্ঞায়িত করে না। আয়নার জায়গায় আয়না থাকে, আপনার বাস্তবতার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয় না। আয়না হোক, ক্যামেরার লেন্স হোক, অ্যাপসের ফিল্টার হোক, এটি কেবল একটি হাতিয়ার। আয়না একটি পৃষ্ঠ, আয়না একটি ক্ষণিকের আভাস। এটি কখনোই আপনি আসলে কে, তার সম্পূর্ণ গল্প বলে না।
পাঁচ.
একটা মজার জিনিস কী জানেন-অন্যরা আমাদের যেভাবে দেখে, আমরা আমাদের সেভাবে কখনো দেখি না, দেখতে পারি না, এমনকি বেশির ভাগ সময় জানাও থাকে না।
আপনি যখন আয়নায় তাকান, আপনার প্রতিফলনটি বিপরীত হয়। বাম দিকটি ডানদিকে এবং ডান দিকটি বাম দিকে দেখায়। আপনি আপনার যে মুখটি প্রতিদিন আয়নায় দেখেন, তা আপনার বন্ধুবান্ধব, পরিবার, সহকর্মী, প্রতিবেশী কিংবা পথচারীরাও দেখেন না। মানুষ তাই কখনো কখনো এমন অদ্ভুত বোধ করে-যখন তারা ফটো বা ভিডিওতে নিজেদের দেখে, যেন একটি নতুন, অপরিচিত দৃষ্টিকোণ তাদের সামনে আসে। আয়নায় প্রতিফলন দেখতে গিয়ে মনকে দেখে, আবার ছবিতে নিজেকেই দেখে, নিজের আরেকটি প্রতিবিম্ব তাকে অবাক করে, এমনকি নিজের মধ্যে আরেকটি নতুন নিজেকে দেখতে পায়, যাকে সে চেনে না !
রূপকভাবে এটাও চিন্তা করা যায় যে-যদি আয়না সব সময় আমাদের একটি বিপরীত চিত্র দেখায়, তাহলে হয়তো আমাদের এটাও বিবেচনা করা উচিত, নিজেদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সব সময় কিছুটা সরাসরিভাবে আসে। হয়তো আমরা নিজেদের যতটা স্পষ্টভাবে ভাবি, ঠিক ততটা দেখতে পাই না। আবার এটাও হতে পারে, আমরা নিজেদের যতটা নেতিবাচক দেখি, তার চেয়ে বিশ্ব আমাদের আরও ইতিবাচক চোখে দেখে। আমরা কেবল সেটা জানি না।
পরেরবার যখন আপনি একটি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: আমি আসলে কী দেখছি? এটা কি শুধু আমার চেহারা, নাকি এটা আমার চিন্তা, আমার আবেগ এবং নিজের সম্পর্কে আমার বিশ্বাসের প্রতিফলন?
হতে পারে আয়না একটি আমন্ত্রণ-অবয়ব দেখার ছায়ায় গভীরভাবে দেখার নিমন্ত্রণ। মনে রাখতে হবে, আয়নায় আমরা যখন একটি প্রতিফলন দেখতে পাই, সেটা অবয়বের চেয়ে অনেক বেশি মনের অঙ্গন। সত্যিকারের আত্ম ছবি আয়না দেখতে পাওয়া ছবির চেয়ে অনেক বেশি অন্য রকম।