Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

দাওয়াই

Icon

মোহাম্মদ কাজী মামুন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘দেখ্, দেখ্, হাসতাছে কেমন ... একখান ফেরেশতা পাডাইয়া দিছে আল্লা আমাগো ঘরে’

মা যখন অলো-বলো করতে থাকে তার নতুন এই নাতিটাকে নিয়ে, তখন রুবি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তা দেখতে থাকে। ‘কিন্তু কী দুর্ভাগা ও! জন্মের সময়ই...!’ কথাটা শেষ করতে পারে না রুবি, তার আগেই ঠোঁটে আঙুল চেপে লাগোয়া ড্রইয়িং রুমের দিকে ইঙ্গিত করেন মা। ইতোমধ্যে যে রুমটা ভরে উঠেছে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীতে। ছেলেকে নিয়ে ঘরে প্রবেশের পর থেকেই মায়ের এ ঢাক্ ঢাক্ গুড় গুড়টা শুরু হয়েছে-কিসের যেন একটা শঙ্কা!

চারদিক মানুষে গিজগিজ করলেও কোথাও নেই রুবির ছোট বোন ববি। পুরো নাম ববিতা। রুপালি পর্দার ববিতার মতো নাকি দেখতে তাকে, পাশের বাড়ির বউঝিরা যখন এমন মত প্রকাশ করত, তখন ভ্রু কুঁচকে যেত মায়ের, ‘হের মতো হইতে যাইব ক্যান? হের থিকাও ফর্সা আমার ববির গায়ের রং, চোখ আরও টানা, নাক আরও খাড়া!’ হ্যাঁ, আগুনে রূপ ছিল ববির, আর সেজন্য ছোট থেকেই সমাদর পেয়ে আসছে সবার কাছে। সে যখন মুখ ফুটে কিছু বলেছে, তখন আর না করেনি কেউ, সবাই তার ইচ্ছেপূরণে মেতে উঠেছে।

এদিকে বয়স যতই গড়িয়েছে, ববির ইচ্ছেগুলো আরও ডানা মেলেছে, আরও বিচিত্র হয়েছে, দূর আকাশ ছাড়িয়ে ঝাপ্টে পড়েছে গহিন কোনো বন্দরে, অচেনা কোনো নক্ষত্রের আলোয়। কিন্তু বড়দেরও তো বয়স থেমে থাকেনি! ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছে তারা, আর হাঁপাতে হাঁপাতে একটুখানি দম নেওয়ার চেষ্টা করেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল রুবি। সেও বড়দের দলে পড়ে, তারও রয়েছে ক্লান্তি; কিন্তু সে তার একমাত্র ছোট বোনটিকে যেভাবে আগলে রাখত, তাতে বাইরের কেউ মনে করতেই পারত যে, ববিতার সুরক্ষার জন্যই তার জন্ম, তাকে বড় করাতেই তার জীবনের সার্থকতা!

সেই রুবির যখন শেষমেশ বিয়ে হয়েই গেল, সে শুধু কেঁদেই বুক ভাসাল না, ববির জন্য অষ্টপ্রহর টেনশনে প্রথম দিকে তো অসুখই বাঁধিয়ে বসল! চাকরিটা পাওয়ার পর ববির পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে হাতখরচ রুবিই সামলেছে। আর বিয়ের পর খরচটা রুবি চালিয়েই গেল না শুধু, দৈর্ঘ্য ও পরিধি বাড়িয়ে দিল। আর এসব সে তার বরকে সামনে রেখেই করত...

তো এক সময় সেই বোন ববির বিয়ের বয়সও হয়ে গেল, পাত্র খোঁজা চলতে লাগল। কিন্তু পাত্র আর পাওয়া গেল না! সবার পছন্দ হলেও রুবির হয় না! রুবি যে বোনের জন্য মনের মতো পাত্র পাচ্ছিল না, তা না। আসলে বোনকে পাত্রস্থ করতেই তার ভয় ছিল-ববি যে একেবারেই অবুঝ! যদি কোনো অঘটন ঘটে! পত্রপত্রিকায় কত কিছু আসে! শেষমেশ ববি নিজেই যখন একটা পাত্রকে পছন্দ করে বাড়িতে নিয়ে এলো, তখন রুবি উপায়ন্তর না দেখে পাত্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বৈঠকে বসল এবং কী কী করণীয় তার বিশাল লিস্ট মুখস্থ করাতে লাগল।

এরপর বিয়ের এক বছর বাদেই যখন ববির পেটে বাচ্চা এলো, তখনো রুবি দিন নেই রাত নেই পাশে রইল বোনের। আর মেয়েটা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে বোধহয় রুবির কোলেই রইল বেশির ভাগ সময়। এমনটা ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না যে, বাচ্চাটা রুবিকেই মা বলে বুঝত! একে তো ববির ব্রেস্ট ফিডিংয়ে ঝামেলা হচ্ছিল; তার ওপর, খাওয়া-পরানো-ঘুমানো সব কিছু রুবির হাতেই ছিল। বোন আর তার বাচ্চাকে যেন অহর্নিশি দেখেশুনে রাখতে পারে সেজন্য রুবি তার বাসাটাও রেখেছিল হাতের কাছেই। আর এর অমোঘ ফলশ্রুতিতে অফিসটা তার গিয়েছিল দূরে সরে! প্রতিদিন কী কষ্টই না হয় জ্যাম, ধুলো আর রোদ ঠেলে অফিস ধরতে! তবে জার্নির কষ্ট মেনে নিতে পারলেও ববি ও তার মেয়ের এতটুকু অযত্ন আর অনাদর সহ্য করা সম্ভব ছিল না রুবির পক্ষে!

অথচ এ রুবিই ববির মেয়ের বয়স ছ’মাস না পুরাতেই ঘোষণা দিয়ে বসল, বাসায় একটি বাবু নিয়ে আসবে! রুবিদের মাঝারি আকারের বাসাগুলোতে এতটা শক্তিশালী ভূমিকম্প আগে অনুভূত হয়নি! রুবির মা তো তার ভাইবোন-দেওর-ননদদের ঘটনাটা এমন করে জানাতে লাগলেন, যেন তিনি একটা বিচারালয়ে এসেছেন, আর সুবিচার প্রার্থনা করছেন! ‘ক্যান, রুবির এমুন কী বয়স হইছে! আর কয়ডা দিন সবুর করতে পারত না! গাজীপুর হুজুরের ঠিকানাডা তো জোগাড় কইরা ফেলছিলাম!’ এইটুকু বলে গলার স্বরটা একটু নামিয়ে ফিসফিস করেন তিনি, ‘দোষ তো আমার মাইয়ার না, জামাইয়ের টেস্ট রিপোর্ট সুবিধার না!’

রুবির বাবা অবশ্য মেয়ের পক্ষে। তার বড় মেয়ে ও জামাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে একে তো নাক গলানোর অধিকার নেই বলে মনে করেন তিনি, তার ওপর বড় মেয়েটার ওপর চিরকালই অন্য রকম আস্থা রয়েছে তার। রুবি যা-ই করবে তা-ই যেন উত্তম! বউকে বোঝান তিনি, ‘এমনও তো হইতে পারে, একটা অনাথ শিশুকে আশ্রয় দেওয়ায় আল্লাহ রাজি-খুশি হইয়া তোমার মাইয়ার গর্ভে বাচ্চা দিতেও পারে! ‘কিন্তু রুবির মায়ের বুঝ তার নিজের কাছেই-দুনিয়ায় কার সাধ্যি আছে যে, তাকে বোঝায়! ঠোঁট উলটে সে ঘোষণা দেয়, ‘যা-ই কও তোমরা, এ বাচ্চারে আমি পালতে পারুম না!’

এদিকে পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য ববির কোনো মতামতই জানতে পারা যায় না বিষয়টি নিয়ে। নার্গিস বানু ফাঁক-ফোকরে তাকে কথাটা পাড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা ঝিলিক মারছিল-ববির একটা অসাধারণ প্রভাব আছে তার বড় বোনের ওপর, যদি সে ভেটো দেয়, তাহলে হয়তো রুবি পিছিয়ে এলেও আসতে পারে! কিন্তু এ বেলা তার ছোট মেয়ে ববিও অচেনা গ্রহের মতো আচরণ করল। শুধু ‘তাই নাকি, ও আচ্ছা, বেশ ভালো তো’ বলে দায়িত্ব সারল, যেন পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে এটুকু মত প্রদান জাস্ট কর্তব্যের খাতিরেই তাকে করতে হলো!

এরপর যেদিন বাচ্চাটিকে আনার দিনটি চলে এলো, সকাল থেকেই বড় মেয়ের বাসায় জায়নামাজ আর তসবিহ নিয়ে বসে পড়লেন নার্গিস বানু। গত কদিন ধরে যে গুমোট হাওয়াটা তাতিয়ে বেড়াচ্ছিল, আজ যেন তা হঠাৎ করেই উধাও হয়েছে! সব কিছু ভয়ানক রকমের শান্ত আর স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। তার পরও যতই সময় গড়াচ্ছিল, অজানা শঙ্কা ঘূর্ণিবায়ুর মতো পাকিয়ে ধরছিল নার্গিস বানুকে! রুবিকে বারবার করে জিজ্ঞেস করছিলেন বাচ্চাটা সম্পর্কে। প্রথমদিকে চুপচাপ ছিল রুবি; কিন্তু পরে যখন প্রশ্নগুলো সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ছিল, আর তড়িৎ প্রবাহের মতো উদ্বাহু নৃত্য করা শুরু করে দিয়েছিল, তখন ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করেছিল রুবি, ‘আমি কিছু জানি না এ ব্যাপারে... আর তোমারই জানার দরকার কী! ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাদের!’

কিন্তু নার্গিস বানু ভেবেই যাচ্ছিলেন তার পরও। মানত করেছিলেন, অন্তত ১২০০ বার দোয়া ইউনুসটা পড়ে ফেলবেন নামাজের এক বৈঠকেই। কিন্তু খেয়াল করলেন এ পর্যন্ত একটা রাউন্ডও কমপ্লিট করতে পারেননি। তার খালি মনে হচ্ছিল যে, কিছু পুঁতি বাদ রেখেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য গোড়ার পুঁতিতে ফিরে যাচ্ছিলেন বারবার! একটি করে পুঁতি ধরেন তিনি, আর কেউ যেন তার হৃৎপিণ্ডে একবার করে হাতুড়ি পেটাতে থাকে! দুদিন আগে চারতলার ভাবি কথায় কথায় বলছিলেন, কতিপয় বিদেশি মহল নাকি মানুষকে বিধর্মী করতে কিছু মিশন বানিয়েছে এ দেশে; নিঃসন্তান দম্পতিরা তাদের প্রাইম টার্গেট! আবার অন্য সম্ভাবনার কথাও উঠে আসছিল কোনো কোনো শুভাকাক্সক্ষীর বরাতে; যেমন : কিছু অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের কাজ বাচ্চা চুরি করা আর চড়া দামে বিক্রি করা-এখানেও পুঁজি সন্তানপ্রত্যাশী বাবা-মায়ের আবেগ! আরও কথা ভেসে আসছিল একে একে পাখা বিস্তার করে... কিন্তু এতটাই উৎকট ও বেপরোয়া হয়ে উঠছিল বাতাস যে, নার্গিস বানু আর ভাবতে পারছিলেন না! দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিল তার!

সকাল সকালই বেরিয়েছিল রুবি। দুপুরের মধেই বাবু নিয়ে ঘরে ঢোকার কথা; কিন্তু দুপুর গড়িয়ে যখন বিকালও অতিক্রান্ত হতে শুরু করল, নার্গিস বানু একদিকে উদ্বিগ্ন হলেন, অন্যদিকে একটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত তাকে কিছুটা উল্লসিত করে তুলল। হয়তো কোনো ঝামেলা, হয়তো ওদের চুক্তিতেই গোলমাল, আর তা শেষ মুহূর্তে ধরে ফেলেছে রুবিরা... শুধুই একটা সম্ভাবনা, তাও নার্গিস বানু তসবিহ গোনার গতি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই তারও থেকে দ্রুতগতিতে স্টেপ ফেলে যখন রুবি ঘরে ফিরে এলো আপাদমস্তক তোয়ালে জড়ানো একটি শিশুকে নিয়ে, বাসাতে হইচই পড়ে গেল। আগে থেকে খবর পেয়ে বাসায় ভিড় করা আত্মীয়দের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল বাবুটিকে একটিবার ছুঁয়ে দেখতে। পাশের ঘর থেকে সবই শুনতে পেলেন নার্গিস বানু, কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। কে যেন তার পায়ের সবটুকু শক্তি কেড়ে নিয়েছে!

এক সময় বাসার ভিড় সামান্য হালকা হলে নার্গিস বানুও যেন কিছুটা হালকা হলেন, আর গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলেন রুবির কক্ষে। প্রথমেই চোখ চলে গেল মেয়ের পাশে শুয়ে থাকা বাবুটির দিকে; আর নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন তিনি, কে যেন তার চোখ ফেরানোর সবটুকু ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে! একটা সময় অবশ্য সম্বিৎ ফিরে এলো, আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ঘোরালেন মেয়ের দিকে। এখন যে কথাগুলো তিনি বলবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করা আছে; তবু একটিবার মনে মনে রিহার্সাল করে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। আর সে অবসরে যখন আচমকাই চিৎকার করে উঠল শিশুটি, মেয়ের আগে মায়ের হাতই এগিয়ে গেল তাকে থামাতে। এরপর নার্গিস বানু কিছু কাজ করলেন, যা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না। যেমন, শিশুটিকে বুকের ওপর ধরে দোলাতে লাগলেন, আর সোনা, রুপা, হিরা ইত্যাদি পৃথিবীর যা কিছু মূল্যবান তার নাম ধরে এমন করে জপ করতে লাগলেন, একটু আগে তসবিহ হাতে করা জপের সঙ্গেই শুধু তার তুলনা চলতে পারে!

রুবি বসেছিল ছেলের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়; কিন্তু জেগে উঠে নানুর সঙ্গে সে এমন খেলা জুড়েছে যে, কখন শেষ হবে তার কোনো ঠিক নেই। সারাটা দিন কী সব ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে, ভাবনাটা আসতেই ক্লান্তিটা আরও বেশি করে জাঁকিয়ে ধরল তাকে।

ঘটনাগুলোর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল মায়ের ব্যাপারটা, যা তার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। যখন রুবির স্বামী রাকিব সতর্ক করেছিল, ‘আরও একবার ভেবে দেখ। পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারবে না ওকে। একটা ভালোবাসাহীন পরিবেশে বড় হবে ও, যা ওর মানসিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’ তখন রুবিই তো রাকিবের চুলগুলো সোজা করে দিতে দিতে বলেছিল, ‘দেখ, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রুবিদের চাইল্ড অ্যাডোপশনের সিদ্ধান্তটা যে সবার মধ্যে ভাবনার থেকেও বেশি বিস্ময় এনে দেবে, সে তা জানতই। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেই ভেঙে পড়বে, তাও তার অজানা ছিল না। কিন্তু রুবির সিদ্ধান্তটা আকস্মিক ছিল না; অনেক দিন ধরে, অনেক ভেবেচিন্তে সে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। যখন ডাক্তার তাকে নিশ্চিত করেছিল যে, তার পক্ষে আর গর্ভধারণ করা সম্ভব নয়, তার টিউবটি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে, তখন থেকেই বিষয়টা তার মাথায় উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছিল।

দিন রাত সে নেট সার্চ করে বেরিয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বসাম্প্রতিক আবিষ্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে-যদি কোথাও একটা কিছু পাওয়া যায়! ডাক্তারদের কথার ওপর সে পুরো ভরসা করতে পারেনি! কোনো একটি পেশেন্টের দিকে তারা আলাদা করে কোনো মনোযোগ দিয়েছে, এমন কোনো নজির তো নেই! নেটের এ দিবস-রজনি যাপন থেকেই একদিন তার কাছে চলে আসে মাদার তেরেসার একটি লেকচার। মনে আছে, তার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গিয়েছিল! পৃথিবীটাকে খুব অন্য রকম মনে হয়েছিল সেদিন! এরপর তো মাস কয়েক আগে রাকিবের এক বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ মেলে অ-লাভজনক সংগঠনটির।

শিশুর যে অভাব ছিল, তা নয়। কিন্তু রুবিদের কিছু বিশেষ চাহিদা ছিল, যা তারা দুজনে মিলে ঠিক করে নিয়েছিল। তারা সন্তানের জন্য অকাতরে ব্যয় করতে রাজি ছিল; কিন্তু শিশুর আসল বাবা-মা যেন কিছুতেই পালক পিতা-মাতার সম্পর্কে কিছু না জানতে পারে! সন্তানকে একেবারে স্বত্ব ত্যাগ করেই তাদের দান করে দিতে হবে! এসব আইনি বা অধিকারকেন্দ্রিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একটি মেইল চাইল্ডের আকাঙ্ক্ষা। এর পেছনে কোনো ভেদনীতি কাজ করছিল কিনা তা জানার উপায় নেই; তবে রুবি মা-বাবাকে অ্যাডোপশানের সিদ্ধান্তটি জানানোর সময় বলেছিল, ‘ববির একটি মেয়ে আছে। এখন এ পরিবারে একটি ছেলে এলে ভালো হবে।’

ববির কথা ভাবতে ভাবতে চোখ মুঁদে এসেছিল রুবির, হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে দেখতে পেল, ববি দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। রুবি শোয়া থেকে উঠে বসতে গেলে ববি থামিয়ে দেয় তাকে, ‘না, না শুয়ে পড়, আপা। তোমার দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না! খুব দৌড়ের উপর ছিলা, না!’ এরপর মায়ের কোলের শিশুটির দিকে তাকিয়ে, ‘বাহ! খুব সুন্দর তো বাবুটা’ বলেই বিদায় নিতে দেখা গেল তাকে।

রুবি এতটাই ক্লান্ত ছিল যে, ববিকে আটকাতে চাইলেও শরীরে কুলোলো না! এর আগেও দেখেছে, যখনই কোনো বড় কিছু ঘটেছে, যার জন্য অনেক সাধনা বা সংগ্রাম করতে হয়েছে, তা যখন শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে, তখনই যেন তার সব শক্তি উধাও হয়েছে; উপভোগের এতটুকু অবসর মেলেনি!

রুবির ছেলেটির ছিল একটা অতি জাগ্রত চোখ আর হাসিতে টইটুম্বুর মুখ। এ বয়সেই যেন সেসব বুঝতে পারত, আর কথা কইত চোখের তারায়। সবার মুখে মুখে বাজছিল, ‘নাহ, মাইয়াডার ওপর নজর আছে আল্লাহর! এই পোলারে দিয়া অনেক সুখ হইব রুবির!’ কিন্তু সে যে সত্যি ছিল না, তা একদিন সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

একদিন ববির মেয়েটা, যে কিনা রুবির ছেলের এক বছর আগে ধরাধামে এসে পৌঁছেছিল এবং ছিল তার খেলার সব থেকে বড় সাথি, বড় ধরনের অসুখে পড়ে গেল; আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেও তা ঠিক হলো না। প্রাণপ্রিয় ভাগ্নিকে না সারিয়ে আর ঘরে ফিরবে না এমন মহাপরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ছুটে গিয়েছিল রুবি। কিন্তু অনেক ডাকাডাকির পরও ববির বাসার দরজাটা খুলল না!

ভাঙা হৃদয়ে বাড়ি ফেরার পর বিষয়টা নিয়ে যতই ভাবছিল, ততই অবাক হচ্ছিল রুবি! এ যুগে এমন কেউ বিশ্বাস করে! রুবির ছেলে কুড়িয়ে পাওয়া বলেই তার মধ্যে অশুভ আত্মা ভর করেছে? ‘মাথাটা গেছে ববি ও ওর স্বামীর!’-এমন ভাবতে ভাবতে সে এক সময় নিজের ছেলেকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কদিন বাদেই বিষয়টা ঠিক হয়ে যাবে বলে যে ধারণাটা সে মনে মনে পুষেছিল, তা ফলল না। ববির মেয়েটা সুস্থ হলো, আর দুবছর বয়সও বাড়ল, কিন্তু আলাদা ইনকিউবেটরে রেখে দিল তাকে ববি! রুবি বা তার ছেলের ত্রিসীমাতেই ঘেঁষতে দিল না!

মা নার্গিস বানু অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন ববিকে বোঝানোর, ‘আমিও যে পরথম পরথম ভয় পাই নাই, তা না! কিন্তু হুজুরের সাথে কথা হইল হেইদিন! কইল, এতিম বাচ্চারে লালন-পালন করায় কোনো ক্ষতি নাই, এইডা না কি অনেক সওয়াবের কাজ!’

শুনে শান্ত হওয়া তো দূরের কথা, উলটো ফুঁসে উঠেছিল ববি, ‘এতিম, না? তুমি কেমনে জান? কে জানে, কোন পাপের ফসল!... এ বয়সেই যেই ট্যাটনা! কে জানে, আমার মেয়ের কোনো ক্ষতিও করতে পারে!’

‘তর আফার কতাডা ভাইবা দেখ, তর জন্য এত করল! আর তার পোলারে তুই এমনে নিন্দলে কি কষ্টডাই না পায়! ’-নার্গিস বানুর কণ্ঠ একই সঙ্গে কাতর ও অভিমানী হয়ে ওঠে!

‘হ, করছে, আর সেজন্যই তো তার কোলে আমার প্যাটের সন্তানরে তুইলা দিছিলাম। কিন্তু রক্তের সম্পর্করে ফালায় দিয়া তারে বাজার থেকে টাকা-পয়সা দিয়া বাচ্চা কিইনা আনতে হইল!... বাচ্চাডা অলুক্ষইনা! তোমার বড় মাইয়ার কষ্টের তো কেবল শুরু!’ রাগে ছ্যানছ্যান করতে করতে যখন ববির মুখ দিয়ে কথাগুলো বের হয়, তখন তার শিরাগুলো ভয়ানক ফুলে ওঠে, আর তীব্র গতিতে তড়পাতে থাকে!

এরপর আরও কয়েকটা মাস গড়িয়ে যায়, আর ববির মেয়েটা দিন দিন আরও শুকিয়ে যেতে থাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে এক ধরনের অন্তিম দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিল ববি ও তার স্বামী সাগর! এ সময়টা ববি সময় পেলেই হাত দুটি ওপরে তোলে, আর যে রাহুর জন্য আজ তার বাচ্চা মরতে বসেছে, তাকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানায়!

ডাক্তাররা যখন কোনো কূলকিনারা করতে পারে না, তখন সব জায়গায়ই ফকিরি ট্রিটম্যান্ট শুরু হয়ে যায়। ববির হাজবেন্ড একদিন এক জিন-তাড়ানি পিরের কাছ থেকে একটা দাওয়াই নিয়ে আসে- মেয়েটাকে রুবির ছেলের পাশাপাশি রাখলে দুটো দিন, বদ জিনটা তাদের মেয়ের মধ্যে থেকে ছেলেটার মাঝে চালান হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। অবশ্য কিছু দোয়া অনর্গল পাঠ করে যেতে হবে ববি আর তার হাজবেন্ডকে সে সময়টায়!

কিছু দিন পরের ঘটনা। দিন শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিধ্বস্ত ববি মায়ের বাসায় আসে বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে। সারাটা দিন কাজের পাশাপাশি অনেক দোয়া-দরুদও পাঠ করতে হয়েছে। তাই আর পা চলছিল না। মেয়ের খোঁজে ড্রইং রুমে উঁকি মারে সে, আর চোখটা কপালে উঠে যায় তার! একটা তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে সেখানে একটা দুই বছরের বাচ্চা ছেলেকে সামনে বসিয়ে রেখে ঘুরে ঘুরে নাচছিল; মেয়েটিকে দেখে বোঝার সাধ্য নেই যে, মাত্রই কিছু দিন আগে অসুখে মরে যেতে বসেছিল ডাক্তারদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে! ছেলেমেয়ে দুটো খিলখিল করে হাসছিল, আর সে আলোতেই যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল একটি উজ্জ্বল জ্যোতি-কোথা থেকে উড়ে এসে মেঘের মতো করে ভেসে রয়েছে ওদের ওপর!

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম