খোয়াবনামা বইটির নামকরণ আমার বাবাই করেছিলেন: হাইকেল হাশমী
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হাইকেল হাশমী বিখ্যাত প্রগতিশীল উর্দু কবি নওশাদ নূরীর একমাত্র পুত্র। জন্ম ১৯৬০ সালে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ইতালির বোকোনি ইউনিভার্সিটি, মিলান থেকে ‘মাস্টার ইন ব্যাংকিং অ্যান্ড ফিন্যান্স’-এর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯১ সালে। পেশায় ব্যাংকার, বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আর বহুজাতিক বিদেশি ব্যাংকে কাজ করেছেন। দুবাই, সিঙ্গাপুর, বেহরেন আর চেন্নাইতে কর্মরত ছিলেন। বাংলা, উর্দু আর ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখেন। বাংলায় ছোটগল্পও লেখেন। অনুবাদ করেন। তার তিনটি কবিতার সংকলন রয়েছে, ‘শেষ নিশ্বাসের প্রথম গান’, ‘কবিতার ক্যানভাস’ আর ‘শব্দের রক্তক্ষরণ’। তা ছাড়া একাধিক অনুবাদের বই প্রকাশ পেয়েছে।
আপনার পড়া প্রিয় বই?
: এটি খুবই কঠিন প্রশ্ন যে, কোন একটি বই আমার প্রিয়। বিভিন্ন বিষয়ে আমার প্রিয় বই রয়েছে। কিন্তু আমি যদি গল্প বা উপন্যাসের কথা বলি, তাহলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ আমার প্রিয় বই।
বইটি কখন কীভাবে সংগ্রহ করেছেন?
: আমার বাবা কবি নওশাদ নূরীর কাছ থেকে পেয়েছিলাম, মনে হয় ১৯৯৬ সালে। লেখক আমার বাবার বন্ধু ছিলেন এবং আমাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন। এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, খোয়াবনামা বইটির নামকরণ আমার বাবাই করেছিলেন। এ কথাটি আমার বাবা বলতেন, পরে কবি আসাদ চৌধুরীর কাছ থেকেও শুনেছি এবং তিনি তার এক সাক্ষাৎকারেও এ কথা বলেছেন।
কী কারণে বইটি আপনার প্রিয়?
: আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে আমি যখন এ বইটি প্রথম পড়ি, তখন সত্যি কথা বলতে অনেক কিছুই বুঝিনি। এমন বই পড়তে হলে ইতিহাস, নৃবিদ্যা, দর্শন, রাজনীতি আর সামাজিক প্রেক্ষাপট জানা খুবই প্রয়োজন। কয়েকবার পড়ার পরও সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি তা বলব না। এ বইয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে বইয়ের প্রেক্ষাপট। এমন একটি বিষয় যেটা আমাদের সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিগত দুই শতকের ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের অদূর অতীত আর বর্তমানকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছে। এ উপন্যাসের ক্যানভাসটা প্রায় দুই শতাব্দীজুড়ে বিস্তৃত। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু বগুড়ার একটি ছোট প্রত্যন্ত জনপদ। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা, আন্দোলন, সমাজব্যবস্থা, সিপাহী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ, দেশ বিভাজন, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ও সংকট এ উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু। এত জটিল আর কয়েককালে বিস্তৃত ঘটনাবলিকে একটি বইয়ের মধ্যে বন্দি করা নিশ্চয় একটি প্রশংসনীয় বিষয়। এসব কারণেই এ উপন্যাসটি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়।
পাঠকরা এ বইটি কেন পড়বে?
: যে কোনো পাঠক যদি এ বইটি মনোযোগসহকারে পড়েন তবে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, বইটি একেবারে আলাদা, একেবারে ভিন্ন, এক কথায় অনন্য। এ উপন্যাসে কী নেই, যেটা একজন পাঠককে প্রভাবিত করবে না। মানুষের কথা আছে, প্রকৃতির কথা আছে, মাটি, খাল, নদী, ঝিল, জীবন, ভালোবাসা, প্রেম, মৃত্যু, লোভ, ঘৃণা, অতীত, বর্তমানের সংমিশ্রণে এ উপন্যাসের নির্মাণ। যে কোনো পাঠক এটা পাঠ করে বিস্মিত হবেন যে, গল্প এভাবেও নির্মাণ করা যায়? বইয়ের শিল্পগুণ বলে শেষ করা যাবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে যে, গল্পে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। পাতায় উঠে এসেছে বিভিন্ন আন্দোলনের কথা, দুর্ভিক্ষের কথা, বিভাজনের কথা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এসব ঘটনার সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কথা। যদিও গল্পের চরিত্রদের অবস্থান কাল হচ্ছে দেশভাগের সময়ে কিন্তু এটি ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস। কিন্তু চরিত্ররা সময় আর স্থান ছাড়িয়ে পলাশী পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, উপন্যাসের চরিত্রগুলো তাদের গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহাসিক উপাদানগুলো মিশ্রিত করা হয়। কিন্তু এ উপন্যাসে সামাজিক ও রাজনৈতিক উপাদানের ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুলো স্থাপন করা হয়েছে। আমি অনেক দিন আগে উর্দু ভাষার লেখিকা ক্বুরাতুল আইন হায়দারের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম, নাম ছিল ‘আগ কা দারিয়া’ বা আগুনের নদী, ওই উপন্যাসে লেখিকা তার গল্পকে নির্মাণ করেছিলেন ইতিহাসের পটভূমিতে। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের গল্প শুরু হয়েছিল ৩২৪ খ্রিষ্টপূর্ব চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আমলে। তারপর বিভিন্ন যুগ অতিক্রম করে যেমন লোদির আমল, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির আমল আর শেষ হয়েছিল দেশ বিভাগের পরে।
এমন বই এখন সচরাচর লেখা হয়?
: আমি এ ধরনের বই আর পড়িনি। হয়তো বা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার জানা নেই, তবুও আমি মনে করি-এমন বই যুগে যুগে একটাই লেখা হয় এবং ওটা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকে। এ ধরনের বই কেন লেখা হচ্ছে না, এটার উত্তর সোজা নয়। প্রথমত এমন বই লিখতে হলে লেখকের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত এগুলো গবেষণাধর্মী উপন্যাস, কয়েক বছর ধরে লিখতে হয়। এখন আমাদের এ ডিজিটাল যুগে মানুষের ধৈর্যের সীমা অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেছে আর পাঠকও মনে হয় খুব গুরুগম্ভীর বিষয়ে পড়াশোনা করতে চান না। এখন যুগ এসেছে ক্লিক আর রিলের, যত দ্রুত শেষ করা যায়। আপনার নিজের লেখা সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটি?
: যদি কবিতার কথা বলি তাহলে আমার কাব্যগ্রন্থ, ‘সত্তার কাছে চিরকুট’ আমার প্রিয় বই। এ বইতে আমি নিজেকে চিরকুট লিখেছি এবং বিষয়বস্তু হচ্ছে বিভিন্ন আবেগ আর অনুভূতি-যেটা প্রত্যেক মানুষেরই মনের কথা।
বইটি লেখা শুরু করে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত জার্নিটা
: আসলে বই প্রকাশ করব এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কবিতা লিখতাম, মাঝে মধ্যে কোনো পত্রিকায় ছাপা হতো। একদিন স্বনামধন্য চিত্রকর সৈয়দ ইকবাল আমাকে বললেন যে, আমি আপনার বাবার বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি এখন আপনার বইয়েরও প্রচ্ছদ করতে চাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। যেহেতু এটা আমি কোনো দিন চিন্তাই করিনি। আমি বললাম, আমি তো কোনো প্রকাশককে চিনি না। উনি বললেন আমি সব করব। আমার প্রথম কবিতার সংকলন, ‘শেষ নিঃশ্বাসের প্রথম গান’, রয়াল পাবলিশার ছেপে ছিল এবং আমি কিছুই করিনি। সব কিছু ইকবাল ভাই করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।
ভালো বই নির্বাচনে পাঠকরা কোন বিষয়টি বিবেচনা করবে?
: সর্বপ্রথম বিষয় বাছাই করতে হবে যে, আমি কোন বিষয়ে পড়তে চাই। যদি কোনো পছন্দের লেখক হয় যার বই আগে পড়া হয়েছে, তার বই বেছে নেওয়া যেতে পারে। পুরস্কারপ্রাপ্ত বই থেকে বেছে নেওয়া যায়। বই রিভিউ থেকে ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। মাঝে মাঝে বইটি উলটে-পালটে দেখলে অথবা প্রথম অধ্যায় থেকে পড়লেও ভালো বইয়ের সন্ধান মেলে।
নতুনদের লেখালেখির ব্যাপারে আপনার পরামর্শ
: প্রচুর পড়তে হবে, বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে হবে। লেখার সময় যদি গল্পের আউট-লাইন করে নিয়ে গবেষণা করা যায়, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। লেখার জন্য সময় দিতে হবে এবং নিয়ম করে লিখতে হবে।