চলে গেলেন কবি ও কথাশিল্পী আবু বকর সিদ্দিক
সরকার মাসুদ
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, রশীদ করীম প্রমুখ লেখক চল্লিশের দশকেই কথাসাহিত্যে যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রীতির পরিচয় রেখেছিলেন তা আরও পুষ্টি লাভ করেছিল সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দীন আল আজাদ, মাহমুদুল হক প্রমুখের হাতে। জীবন জিজ্ঞাসা ও বৈচিত্র্য এদের লেখায়ও কম ছিল না। কিন্তু ষাটের প্রজন্মের কতিপয় বলিষ্ঠ কথাকার ওই শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের অর্জনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা। মধ্যবিত্তের ছকের বাইরে সাহিত্যকে নিয়ে যাওয়া ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা, অনেক রকম বিষয়বস্তু সন্ধান, সৃজনশীল নিরীক্ষা-এ তিনটি দিক ভালো করে লক্ষ করলে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় যে, ষাটের অগ্রণী কথাশিল্পীরা অন্য কিছুর বিচারে, না হলেও অন্তত গভীরতা অন্বেষী বহুমাত্রিকতার প্রশ্নে চল্লিশ ও পঞ্চাশের লেখকদের থেকে এগিয়ে আছেন।
ষাটের ওই অগ্রসর লেখকদেরই একজন আবু বকর সিদ্দিক। তার গল্পগ্রন্থের সংখ্যা দশ। উপন্যাস চরটি। উপন্যাসগুলো নাম : জলরাক্ষস, খরাদাহ, একাত্তরের হৃদয়ভস্ম, বারুদ পোড়া প্রহর। ‘জলরাক্ষস’-এর প্রকাশ সাল ১৯৮৫। ‘বারুদ পোড়া প্রহর’ বেরিয়েছে ১৯৯৬-এ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বঞ্চিত-নির্যাতিত জীবন ব্যতিক্রমী দক্ষতায় চিত্রিত হয়েছে সিদ্দিকের হাত দিয়ে। বস্তুত এ লেখক দেশবাস্তবতার এক অনন্য রূপকার। কট্টর বস্তুবাদী এ শিল্পীর রাজনৈতিক দৃষ্টি ও অবস্থান খুব স্বচ্ছ। বামধারার রাজনীতি থেকে উৎসারিত জীবনচেতনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রযুক্ত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাসে। আর ওই পথ ধরেই সম্পন্ন হয়েছে তার অনবদ্য জীবনবীক্ষা।
আবু বকর সিদ্দিকের বহুমুখী লেখালেখির পেছনে সর্বদাই সক্রিয় ছিল বাম চিন্তাদর্শন এটা যেনম সত্য, তেমনি এও সত্য যে, লেখকের প্রযুক্ত তত্ত্ব কখনো তার শিল্পমেধা ও সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠেনি। তার কারণ তিনি প্রধান শিল্পী; প্রথমত কবি। সিদ্দিকের কথাসাহিত্যে মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি লক্ষণীয়ভাবে কম। নিম্নবর্গের টানাপোড়েনছিন্ন চরিত্রগুলোই তাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। বিশাল গ্রাম-বাংলার মানুষের বিচিত্র জীবন তিনি দেখেছেন স্বচক্ষে। সুতরাং প্রত্যক্ষ জীবনবিজ্ঞতার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষ-জনদের নিয়ে লেখার আগ্রহ যুক্ত হওয়ায় আমরা পেয়েছি উঁচু দরের সৃষ্টি-এক অনন্য সাহিত্য ফল।
মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে বা রোমান্টিক প্রেমানুভূতি নিয়ে (যেমনটা তার কবিতায় দেখা যায়) রচিত দু-চারটি গল্প তার আছে। কিন্তু আমার ধারণা, নিসর্গের পটভূমিতে গরিব মানুষের জীবনকেন্দ্রিক যেসব গল্প উপন্যাস তিনি লিখেছেন সেখানেই তার প্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে। আর এ ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে সপ্রতিভ ও স্বচ্ছন্দ। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে ‘চরবিনাশকাল’, ‘নানা মাংসের গন্ধে’, ‘বাইচ’, ‘খরার দুপুর’, ‘দোররা’ প্রভৃতি।
ছোট গল্প এবং উপন্যাস ‘জলরাক্ষস’ ও ‘খরাদাহ’র কথা। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির সমস্যাগুলো পুরোপুরি মাথায় রেখেই নিরীক্ষাপ্রবণ গদ্যরীতির আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। সাধারণত আমরা দেখি, বামপন্থি কথাসাহিত্যিকরা এক ধরনের সরল-সুগম গদ্য ব্যবহার করেন। আবু বকর সিদ্দিক এক্ষেত্রে স্পষ্ট ব্যতিক্রম। তার স্বোপার্জিত ভাষা-ভঙিতে রচিত গল্পগুলোয় ভিন্ন মাত্রার শিল্প সার্থকতা লক্ষণীয়। তিনি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ব্যঙ্গ প্রয়োগ করেন যার সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখতে পাই ‘জলরাক্ষস’ ও ‘খরাদাহ’ নামের রচনা দুটিতে। সামাজিক-রাষ্ট্রিক ভণ্ডামিগুলো ভীষণভাবে বিদ্ধ হয়েছে তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শরে।
ছোটগল্পে ব্যক্তি ভাষা ও শিল্প দক্ষতার বলিষ্ঠ পরিচয় থাকলেও আবু বকর সিদ্দিককে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে তার প্রথম উপন্যাস ‘জলরাক্ষস’। আর ‘খরাদাহ’ উপন্যাসটি লেখকের কথাসাহিত্যিক পরিচায়কে দেয় সুদৃঢ় ভিত্তি। ‘খরাদহ’ উপজীব্য হিসাবে নিয়েছে খরা-পীড়িত ও দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের জনজীবন। আর খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের নিম্ন ভূমিতে বসবাসকারী মানুষজনের লড়াকু জীবন ও সংশ্লিষ্ট পরিবেশ উঠে এসেছে ‘জলরাক্ষস’-এ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও সংগ্রামশীলতা এখানে বড় ক্যানভাসে এঁকেছেন সিদ্দিক। এর সঙ্গে প্রতীকের ব্যবহার এবং নিরীক্ষা প্রয়াস যুক্ত হওয়ায় অসামান্য হয়ে উঠেছে গ্রন্থটি।
‘ভূমিহীন দেশ’ এ লেখকের প্রথম গল্পগ্রহন্থ। এতে আছে সাতটি গল্প। তার মধ্যে পাঁচটিই লেখা হয়েছে নির্বাচন নিয়ে। বাংলাদেশে যাদের জন্য এবং যেভাবে নির্বাচন হয়ে আসছে দীর্ঘকাল তাতে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। এ ভোট জনস্বাার্থবর্জিত ও অন্তঃসারশূন্য। এ গ্রল্পগুলোতে তাই ব্যঙ্গ ও রূপকের উপস্থিতি খুবই প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী। লেখকের অন্য তিনটি গল্পের বই হচ্ছে ‘ছায়া প্রধান অঘ্রাণ’, ‘চরবিনাশ কাল’ ও ‘কুয়ো থেকে বেরিয়ে’। এগুলোতেও লেখক তার গল্প সামর্থ্যরে জোরালো প্রমাণ রেখেছেন। ‘ছায়া প্রধান অঘ্রাণ’ গ্রন্থের ‘নোনা মাংসের গন্ধে’ গল্পটির কথা বলি। সুন্দরবনের পটভূমিতে রচিত এ লেখায় দক্ষিণ বঙ্গের জনজীবনের বস্তুনিষ্ঠ রূপায়ণ দেখি আমরা। হরিণ শিকার ও তার মাংস বিক্রি আইনত বড় অপরাধ। সেই দোষে অপরাধী ওবেদুর নামের এক বন-কর্মচারী এক স্বৈরিণীর পাল্লায় পড়ে। ওই মেয়ে তীক্ষ্ন ধারসম্পন্ন গুলের আঘাতে মারা গেলে ওবেদুর বাদাবনের রহস্যজটিল পরিবেশে বিভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে পড়ে। ওই দুর্ঘনা ওবেদুরকে বিরাট ধাঁধায় ফেলে দেয়। মৃত্যু যেন অবয়ব নিয়ে হাজির হয় তার সামনে। এখানে বাঘের, রূপকে উপস্থি হয়েছে মৃত্যু। পেছনে সমুদ্র, ওপরে নিঃসীম আকাশ ও প্রভাদীপ্ত সূর্য। বাঘের চোখের জ্যোতি যেন মৃত্যুর ইজ্জ্বল অমোঘ তারই স্মারক। এ পটভূমি আর এই চিত্রকল্প গল্পটিকে দিয়েছে উচ্চ আসন যার স্বাদ একান্তই সিদ্দিকীয়।
‘চরবিনাশকাল’ গ্রন্থের নাম গল্পটি আবু বকর সিদ্দিকের একটি শ্রেষ্ঠ রচনা। সর্বগ্রাসী সময়ের ক্রর থাবার নিচে মানুষের বাঁচার আশা ও উদ্যম এ গল্পের মূল কথা। এখানে দেখতে পাচ্ছি, চাঁদবিবি ও তার প্রেমিক পুরুষ। দুজন মিলে ভালোবাসার সংসার পাততে উদ্যমী হয় ও তার আয়োজন সম্পন্ন করে। তারা বুঝতে পারে না, মৃত্যুর হা-য়ের ভেতর বসে সেই ঘর বাঁধার স্বল্প দেখছে তারা। শেষ পর্যন্ত এ দুজন মানব-মানবী চরবিনাশকাল নামের মৃত্যুদ্বীপের দিকে যাত্রা করে চিরদিনের জন্য। এখানেও সেই মৃত্যুর রূপক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশায়াদি স্বতন্ত্র জীবনদৃষ্টি ও ভাষার গুণে আলাদা মহিমায় ভাস্বর।
‘খরার দুপুর’ সিদ্দিকের ‘কুয়ো থেকে বেরিয়ে’ গ্রন্থের এক প্রধান গল্প। আয়তনে ছোট এ গল্পে মৃত্যুর আকস্মিক প্রকাশ ঘটেছে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে। গল্পের নায়ক তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে যায়, এক বয়স্ক কমরেডের বাড়িতে। উদ্দেশ্য, বন্ধুর বোনকে বিয়ে করা। তারপর বারান্দায় বসে থাকা বরকে আমরা দেখি। দেখি খরাগ্রস্ত এলাকায় দুপুরের দাবদাহ। বিয়ে বাড়ি কিন্তু কোথাও উৎসবের চিহ্ন নেই। কমরেডকে বর হিসাবে এ জায়গায় এনেছে যে বন্ধুটি সে নিখোঁজ। নববধূ শালীমারও কোনো সাড়া নেই। কলেরা থাবা বসিয়েছে গ্রামে। কাফনপরা লাশ নিয়ে টুপিপরা লোকজন চলেছে সামনের রাস্তা দিয়ে। এরই মধ্যে দূরে রাস্তার ধুলা উড়িয়ে শহরে ফেরার শেষ বাস চলে যেতে দেখি আমরা। এ গল্পের পটভূমি অকিঞ্চিৎ। তবু ওই সামান্য পরিসরেই লেখক মৃত্যুর আবহ তৈরি করতে পেরেছেন চকৎকারভাবে। নানা সূক্ষ্ম রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন আর সেগুলো কাক্সিক্ষত ব্যঞ্জনাও ফলিয়েছে।
আবার উপন্যাসের প্রসঙ্গে আসি। ‘জলরাক্ষস’-এর দক্ষিণাঞ্চলের প্রলয়ঙ্করী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পটভূমিতে বিত্তবেসাতহীন এক সাহসী মানুষের অসাধারণ জীবন সংগ্রামের ছবি এঁকেছেন আবু বকর সিদ্দিক। সেই সাহসী মানুষটির নাম গোনজোরালি। এ ব্যক্তি জমিদার চৌধুরীর পোষা লেঠেল এবং শুধু সাহসী নয় ভীষণ শক্তিশালীও বটে। তার চরিত্রে বীর হয়ে ওঠার মতো গুণপনা থাকা সত্ত্বেও সে দুর্দশাগ্রস্ত। চৌধুরীদের পক্ষে ভালো-মন্দ নানা কাজে লিপ্ত থাকার পরও গোনজোরালি সারা বর্ষাকালজুড়ে সিঁদ কেটে চুরি করে। অভাব-অনটনে থেকেও সে স্ত্রী জরিনকে খুব ভালোবাসে। আবার অভাবের তাড়নায় টাকার জন্য সেই জরিনকেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে হেল্থ সেন্টারে নিয়ে আসে বন্ধ্য করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি। চারপাশে মৃত্যুর মিছিল। গোনজোর-জরিন বেঁচে যায়। তারা আশ্রয় নেয় বাঁধের ওপর। কিন্তু শিশু ছেলেটি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ে। ছেলের লাশের সামনে বসে গোনজোরালি কাঁদে। অন্যদিকে রিলিপ অফিসারের কাছে ইজ্জত খুইয়ে আসে জরিন; কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পায় না। এ অধ্যায়ে লেখক জরিনের ভয়ংকর অভিজ্ঞাত বর্ণনা করেছেন স্বপ্ন ও বাস্তবকে মিশিয়ে দিয়ে। শৈল্পিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির গরজে তিনি এটা সচেতনভাবেই করেছেন। আমরা দেখি, বর্নার্তদের আশ্রয়স্থলেও মৃত্যু ছোবল বসায়। রিলিফ দেওয়ার নামে হাজির হয় সব ধান্ধাবাজ সরকারি কর্মচারী, সাংবাদিক, পুলিশ এলাকার চেয়ারম্যানসহ নানা ধরনের লোকজন। তাঁবু খাটানো হয়। হ্যাজাক জ্বালানো হয়। সাহায্য প্রার্থীদের টিপসই নেওয়ার কাজ চলে। আর এ সবের আড়ালে পাচার হয়ে যায় রিলিফের মাল। নির্যাতিত-অপমানিত হয় দুস্থ নারীরা। ইজ্জত হারানো, ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ জরিন প্রতিহিংসায় ফেটে পড়ে এবং চৌধুরীর ঘরে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে যখন আবার আবহাওয়া খুব খারাপ হয়, অশনিসংকেত নিয়ে আসে মেঘ এবং ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দেয়, সেই অসময় লেখকের কলমে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-‘সেই ভৌতিক শব্দ মেলাতে না মেলাতেই তীক্ষ্ন টানা ধ্বনিতে আজানের ডাক ওঠে। আর তার ভয়াবহ প্রতিধ্বনি বাতাসের দাপে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তখন সরু সরু প্যাঁচে এগিয়ে আসে ক্যাপা কুকুরের টানা বিজাতীয় ডাক। অসহ্য অদৃশ্য অশরীরী কারবার।’
এবার এক অবিস্মরণীয় দৃশ্যের কথা বলতেই হয়। সারি সারি ভাসমান লাশের ভেতর দিয়ে নৌকা চালানোর সময় পচা গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য গোনজোরালি তার নাক-মুখ-কান-থুতনি গামছা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। শুধু চোখ দুটো খোলা আছে। তাকে কিম্ভূতকিমাকার রাক্ষসের মতো দেখাচ্ছে। তারপর সে দেখতে পায় জমিদার চৌধুরীর ফুলে ওঠা লাশ। ছিপের সুতার মাথায় বড়শি গেঁথে সে ছুড়ে মারে। ডিঙির কাছে নিয়ে আসে ওই মৃতদেহ। দায়ের চাড় দিয়ে খুলে নেয় সোনার চেন। মূল্যবান পাথর-বসানো আংটি খুলে নিতে পারে না বলে চৌধুরীর চারটা আঙুল কেটে নিতে হয় তাকে।
কাহিনির শেষাংশ লক্ষ করুন। একটা ডিঙিতে উঠে পড়েছে গোনজোরালি ও জরিন। ঝড়ো হাওয়া ও বন্যা উপেক্ষা করে তারা ভেসে চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। ডিঙির এক প্রান্তে বসে শক্ত হাতে বৈঠা ধরে দুলছে গোনজোরালি। আগ্রাসী তুফানের ছোবলে জরিন কোলার মতো উড়ে যায়। ক্লান্তিহীন যুদ্ধ চলতে থাকে প্রকৃত ও মানুষের মধ্যে। নির্বিকার দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকে বৈরী সময়।
‘খরাদাহ’ উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের খরাগ্রস্ত অঞ্চলের পটভূমিতে। ঘটক নান্টু মিয়া মাতবর বাহাউদ্দিনকে উত্তরাঞ্চলের এক বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। বাহাউদ্দিন খুব দুষ্টু লোক। শহরে তার চামড়ার কারখানা। সে হিজড়া দলিল উদ্দিনকে ছেলে সাজিয়ে নানা জায়গায় বিয়ে করায়। পরে সেই মেয়েকে নিজে ভোগ করে। শেষে বেশ্যাবৃত্তিতে নিযুক্ত করে। বরযাত্রীরা শূন্য প্রান্তরের মধ্য দিয়ে আলপথ ধরে চলেছে ঝাঁ ঝাঁ বোদের ভেতর। আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই, একটা গাছও নেই। বরযাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া করে আনা বাজানাদাররাও আছে। গা জুড়ানোর মতো এক পশলা বাতাস নেই। কোথাও একটু ছায়া নেই। এর মধ্যেই দেখা যায় টুপিপরা অসংখ্য মানুষ। তারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছে। ‘ইল্লা : হুক হুক! ইল্লা : হুক হুক’ শব্দে জিকির তুলছে ওই জনসমাজ। উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে ফেরত যাত্রার বর্ণনা আছে। আরও দেখি খরার দেশ ছেড়ে মানুষ দলে দলে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায় শ্রমজীবী জনতার সঙ্গে মসিদ খাঁর লোকজনের। মসিদ হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু জোতদার, সামন্ত যুগের প্রতিনিধি। লম্পট অত্যাচারী ও শোষক এ ব্যক্তির এলাকায় এসে পড়েছে বরযাত্রীরা। শোষিত জনগণের পক্ষে নেতৃত্ব দেয় ভল্লা নামের এক লেঠেল সর্দার। ভল্লা একদিন মসিদের বড় শক্তি ছিল। আজ সে কৃষিজীবী লোকজনদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারই সামন্ত প্রভুর ওপর। গল্পের শেষে মসিদ মারা পড়ে। মারা যায় বাহাউদ্দিনও। কিন্তু ভল্লাও রক্ষা পায়নি। তার বাহন ছিল কালোবাউশ নামের এক মহাশক্তিমান মহিষ। মারাত্মক আহত হয়ে বিশালদেহী ওই মহিষ ভল্লার শরীরের ওপর পড়ে যায়। ভাঙা পা নিয়ে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। কালোবাউশ তার ভরাট চাহনি দিয়ে যেন বলে, ‘দুঃখটা কী বা ই মরণ-ট্যাত! হামরা তো জিতাই গেলছি।’
বিষয়বস্তু নয় সাহিত্যকে টেকইস করে তার অনন্য ভাষারীতি ও আঙ্গিকের ইতিবাচক প্রয়োগ। আবু বকর সিদ্দিকের কথাসাহিত্যের বেলায় এ কথা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। নিরীক্ষাধর্মীয় গদ্যরীতির সার্থক ব্যবহার তার বড় অর্জন বলে মনে করি। বাম রাজনীতি ও তৃণমূল সংলগ্নতার অভিজ্ঞতা ওই নিরীক্ষাকে সুফলপ্রসূ করে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও নকশাল আন্দোলনের ওপর রচিত্র ‘ছায়া প্রধান অঘ্রাণ’, ‘বাইচ’, ‘দোররা’ প্রভৃত ছোটগল্প নিরীক্ষাধর্মিতার অসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যেমন এসব গল্পে তেমনি উপন্যাস ‘জলরাক্ষস’ ও বিশেষভাবে ‘খরাদাহ’তে সিদ্দিক নানা কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে বড় মাপের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তার লেখা পুনরাবৃত্তিজনিত একঘেয়েমি থেকে মুক্ত। তার চারটি উপন্যাস চার রকম বিষয়কে উপজীব্য করেছে। সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক থিম নিয়ে তিনি যখন লিখেছেন, আমার ধারণা, স্টাইল বিষয়টি মাথায় রাখতে ভোলেননি। আর মূলত কবি বলেই পরিবেশ-পরিস্থিতি বয়ানের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত, প্রতীক ও চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে তার পক্ষে। আবু বকর সিদ্দিক এখনো স্বল্পপঠিত। কিন্তু নানা মাত্রায় গুণান্বিত তার গল্প-উন্যাসগুলো বাংলাসাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসাবে থেকে যাবে আমার এমনটাই মনে হয়।