Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

রাজবাউলের গল্পকথা

Icon

আকেল হায়দার

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজবাউলের গল্পকথা

‘লোকে বলে ও বলেরে, ঘর-বাড়ি ভালা না আমার

কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার

লোকে বলে ও বলেরে, ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।’

হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। তৎকালীন সিলেট জেলার অন্তর্বর্তী সুনামগঞ্জ শহরের নিকটস্থ সুরমা নদীর তীরবর্তী লক্ষ্মণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে। হাছন রাজা সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন ইংরেজ শাসন আমলের সিলেটের প্রভাবশালী জমিদার। সে সময় তাদের জমির পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ বিঘার বেশি। হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হিন্দু। অযোধ্যা থেকে তারা প্রথমে যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামে ও পরে সিলেটের বিশ্বনাথ থানার কোনাউরা গ্রামে বসতি শুরু করেন। তার প্রপিতামহ বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাবু খান নামে পরিচিতি পান।

১৮৬৯ সালে হাছন রাজার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর চল্লিশ দিনের মাথায় তার একমাত্র ভাই উবায়দুর রেজাও মারা যায়। ফলে মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাকে জমিদারি কাজকর্ম দেখভালের কাজে ন্যস্ত হতে হয়। হাছন রাজা ছিলেন স্বশিক্ষিত। সে সময় সিলেটে আরবি ও ফার্সি শিক্ষার বেশ প্রচলন ছিল। তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, হাছন রাজা অনেক দলিলপত্রে আরবিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন। উন্নত নাসিকা, উজ্জ্বল চেহারা, পিঙ্গল চোখ ও মাথাভর্তি চুলে তাকে দেখতে পারস্যের সুফি কবিদের মতো লাগত। তিনি এতটাই সৌম্য ও উঁচা-লম্বা ছিলেন যে অনেক লোকের মধ্য থেকেও তাকে খুব সহজে আলাদা করা যেত। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি অনেক ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। অল্প বয়সে এত ধনসম্পত্তি হাতের নাগালে পেয়ে প্রথম যৌবনে ভোগ বিলাস ও শৌখিন জীবনযাপনে মগ্ন হয়ে পড়েন। বর্ষাকাল এলে বজরা সাজিয়ে চলে যেতেন নৌ ভ্রমণে। সেখানে থাকত নাচগান খাওয়া দাওয়াসহ নানা আয়োজন। পাখি খুব পছন্দ করতেন তিনি। কুড়াপাখি ছিল তার বিশেষপ্রিয়। এটি মূলত এক শ্রেণির ঈগল। সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওড় অঞ্চল এদের মূল বিচরণভূমি। পাখি ছাড়াও ঘোড়ার প্রতি তার দুর্বলতা ছিল বেশ। হাছন রাজার সংগ্রহে ছিল ৭৭টি ঘোড়া। বিভিন্ন রকম শখ, নাচগান ও ভোগবিলাসী জীবনযাপনে তিনি এতটাই মত্ত হয়ে রইলেন যে, দিনে দিনে প্রজাদের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে লাগল এবং সবার কাছে তিনি নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী রাজা হিসাবে চিহ্নিত হলেন।

নারী সংসর্গে তিনি ছিলেন ভীষণ উৎসাহী। নারী সঙ্গ ও নারী সম্ভোগের ব্যাপারে তাকে নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। প্রচলিত আছে একদিন হাছন রাজা ঘোড়ায় চড়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক গ্রাম্য মেয়েকে দেখে ভীষণ রকম মুগ্ধ হন। কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে নিজের গলার মালা ছুড়ে দেন এবং পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েকে নিয়ে গান লিখেন-

‘না জানি কি মন্ত্র পড়ে জাদু করিল সোনা বন্দে

সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল

সোনা বন্দে আমারে পাগল করিল।’

নাচগানের জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাইজি আনাতেন হাছন। এসব আয়োজনের জন্য যথেচ্ছ টাকা-পয়সা খরচ করতেন। একবার লক্ষ্ণৌ থেকে পিয়ারী নামের এক বাইজিকে আনা হয়েছিল তার আসরে নৃত্যগীতের জন্য। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে হাছন লিখেছিলেন-

‘নিশা লাগিল রে

বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে

হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে।’

জমিদারি ও আয়েশি জীবনে দিন বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে বদলে গেলেন হাছন। তুমুল পালটে ফেললেন নিজেকে। ভোগবিলাস, শৌখিন জীবনযাপন থেকে সরিয়ে নিলেন নিজেকে। জমকালো পোশাক পরিচ্ছদ পরা ছেড়ে দিলেন। জাগতিক মোহ ও আসক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বিষয় সম্পত্তি ও ক্ষমতার প্রতি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলেন। তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া এবং ভালোমন্দ দেখভাল করা হয়ে উঠল তার নিত্যদিনের কাজ। তখন থেকে তিনি সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে মগ্ন হলেন এবং শুরু করলেন গান রচনা। তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গান-

‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা না আমার

কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যেরই মাঝার

লোকে বলে ও বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা না আমার।’

খোদাভক্তি ও মরমি ধারার গানে তিনি ছিলেন বেশ সাবলীল। এ জগৎ সংসার সবকিছুই সাময়িক। নশ্বর পৃথিবীতে সবাই ক্ষণকালের যাত্রী মাত্র। মায়া-মোহ, সহায়-সম্পদ সবকিছু ফেলে বাইকে একদিন চলে যেতে হবে অন্যলোকে। সমর্পণ করতে হবে নিজকে সৃষ্টিকর্তার দুয়ারে। যিনি এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সব কিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। সেসব কথা চিন্তা করে হাছন লিখেন-

‘গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি

হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি

মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা

জযেমনে ফিরায়, তেমনে ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।’

অন্য এক গানে তিনি পারিবারিক বন্ধনকে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির পথে অন্তরায় উল্লেখ করে লিখেন-

‘স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল

কেমনে করিবে হাছন বন্ধের সনে মিল।’

হাছন রাজা মোট কতটি গান লিখেছেন তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। ‘হাসন উদাস’গ্রন্থে ২০৬টি গানের সংকলন আছে। এছাড়া ‘সৌখিন বাহার’ ও ‘হাসন বাহার’ নামে তার লেখা আরও দুটি গ্রন্থের কথা জানা যায়। এখন পর্যন্ত তার ৫৫৩টি গানের সন্ধান পাওয়া যায়। অনেকের মতে তার লেখা গানের সংখ্যা এক হাজারের বেশি।

১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ৬৭ বছর বয়সে হাসন রাজা মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রীতে তার মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম