রুশ ইতিহাস আবার নিজের লেজে কামড় দেবে

ওয়াহিদ কায়সার
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসাবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে নির্বাসিত বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসাবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘রুশ বুকার’, ‘বিগ বুগ প্রাইজ’। ৩০টি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক এ লেখকের ‘বই ইন মাই রাশিয়া : ওয়ার অর পিস?’ সাম্প্রতিক সময়ে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। দ্যা গার্ডিয়ানে নিজের বই, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন অ্যান্ড্রু অ্যান্থনির সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন ওয়াহিদ কায়সার
রুশ সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী এবং উদারপন্থিদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের কথা আপনি অতীতেও বলেছেন। ইউক্রেনে আক্রমণের পর থেকে সেটা কী আরও গভীর হয়েছে?
: বিশ বছর আগে কিয়েভে এক সাহিত্য উৎসবে আমরা সবাই-লেখক এবং কবিরা যারা ইউক্রেনে রুশ ভাষায় লিখত-একসঙ্গে বসে কথা বলছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল অবশেষে আমরা ভবিষ্যতের রুশ সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, যেখানে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ক্রাইমিয়া সংযুক্তির প্রসঙ্গ সামনে চলে এলো আর দেখলাম যাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে গল্প করছিলাম তারা চিৎকার করছে : ‘ক্রাইমিয়া আমাদের! ক্রাইমিয়া আমাদের!’ এটি ছিল (ইউজিন) আয়োনেস্কোর বিখ্যাত গ্লার নাটকটার মতো, যেখানে মানুষ গণ্ডারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আর কথা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মস্কোয় বাস করা আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলাটাও অসম্ভব। আমরা অচেনা হয়ে পড়েছি। রুশ সংস্কৃতিতে সভ্যতার ব্যবধানের মতো কিছু একটা আমাদের ভেতরও আছে। যারা বই পড়ে না তারা কেন এ যুদ্ধকে সমর্থন করে সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সংস্কৃতিবানরা কেন সমর্থন করে তা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
আপনার বইতে বলেছেন যেসব রুশ লেখক এবং শিল্পীদের লক্ষ্য এটাই দেখানো যে সব রুশ এ যুদ্ধকে সমর্থন করে না। কিন্তু যেমনটা আপনি বলেছেন, অনেক শিল্পী এবং লেখক কিন্তু মনে করে না যে এটা তাদের লক্ষ্য
: আমার জন্য এখন এটা একটা লক্ষ্য। সারা জীবন আমি টের পেয়েছি আমার পায়ের নিচের মাটি খুব শক্ত। রুশ সংস্কৃতিই ছিল সেটা। আর এখন এটা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একশ বছর আগে রুশ অভিবাসীরা বার্লিন বা প্যারিসের রাস্তায় রুশ ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পেত না। কিন্তু এখন তারা নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। রুশ ভাষার মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সবকিছু করাই আমার লক্ষ্য এখন। আর এটা এ যুদ্ধে আমাদের সাধারণ শত্রু, রুশ রেজিমের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয়ের মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিমই।
আপনি লিখেছেন যে রুশ ভবিষ্যৎ কেবল তখনই থাকবে যদি এটি সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যায়। একটা পারমাণবিক শক্তিধর দেশের জন্য এটা কি কোনো কার্যকর বিকল্প?
: পুতিনের মধ্যে সব স্বৈরশাসকের মনস্তত্ত্ব মজুত আছে; ‘আমি যদি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, তাহলে পুরো পৃথিবীকেই আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ মানুষের প্রতি এদের কোনো সহানুভূতি নেই। মানুষকে এরা ভালোবাসে না। ঘৃণা করে। আর তাই আমি নিশ্চিত যে, সে লাল বোতামটা টিপে দেবে। কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস করার আদেশটা কেউ পালন করবে না। কেউ না। আর সেটা কেন জানেন? কারণ রাশিয়ায় মূল প্রশ্নটা উনিশ শতকের চিরায়ত রুশ সাহিত্যের মতো না; কে দায়ী? কী করা যেতে পারে? না, প্রধান প্রশ্নটা হলো; জার কি আসল নাকি নকল? একটা যুদ্ধ জিতে প্রমাণ করতে পারেন যে আপনি আসল। স্ট্যালিন লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, তবে সাধারণের কাছে কিন্তু তিনি জনপ্রিয়। গর্বাচেভ পশ্চিমে জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু আফগানিস্তান যুদ্ধ এবং পশ্চিমের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধে তিনি পেরে ওঠেননি। (তাই) তিনি ঘৃণিত। পুতিনের জেনারেলরা তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিন দিনের মধ্যে তারা কিয়েভ দখলে নেবে, আর হিসাব করতে গিয়ে এটাতেই সে ভুল করল। সে ব্যর্থ, আর এখন সে একজন নকল জার হয়ে পড়েছে। নকল জারের আদেশ কেউ পালন করবে না।
আপনার বইটি ভাষার দুর্নীতি, মিথ্যার স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে একটি সতর্কতাবাণী। কিন্তু মিথ্যা যদি সত্যের চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তবে তাকে চ্যালেঞ্জ করে কারাবাস বা মৃত্যুর ঝুঁকি কি কেউ নেবে? শেষবার কবে আপনি রাশিয়ায় গিয়েছিলেন?
: শেষবার আমি রাশিয়ায় গিয়েছিলাম ২০১৪ সালের অক্টোবরে। ক্রাসনোয়ারস্ক বইমেলায়। মঞ্চে আমি একাই যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। এ নীরবতাটা এতটাই অপমানজনক ছিল যে, সেটাই ছিল রাশিয়ায় আমার শেষ সফর। এখন কোনোভাবেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছি, কিন্তু করবটা কী? আমার কি চুপ থাকা উচিত? আমার কি কথা বলা বা লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? সেটা করলে আমার জীবনের আর কোনো মানে থাকে না। আমি হাল ছাড়ব না।
আপনি রাশিয়ার ‘বর্বর ৯০ দশক’ সম্পর্কে লিখেছেন যখন অলিগার্করা প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি করেছিল আর ক্ষমতা অপরাধীদের হাতে চলে গিয়েছিল। দারুণ একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। রুশ গণতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিমারা তখন কী করতে পারত?
: এটা বলতে আমার খারাপ লাগছে যে রুশ জনগণের কাছে অপরাধীদের এ শাসনকে পরিচয় করিয়ে দিতে পশ্চিমারাই সাহায্য করেছিল। ৯০-এর দশকে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তাদের কোনো ধারণা ছিল না যে, এটা কীভাবে কাজ করে। পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো নতুন রুশ গণতন্ত্রকে কী দেখিয়েছিল? সুইজারল্যান্ডে আমি একজন দোভাষী হিসাবে কাজ করেছি এবং দেখেছি কীভাবে বিশাল এ লন্ড্রি মেশিনটা কাজ করে। রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা চুরির টাকা মানুষ জুরিখে নিয়ে আসত অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে দেওয়ার জন্য। আর আইনজীবী, ব্যাংকের লোকজন, সবাই এ অবৈধ টাকা পেয়ে খুশি হয়েছিল। তারা পুরোপুরি সচেতন ছিল যে এগুলো অবৈধ টাকা। লন্ডনেও একই ঘটনা ঘটেছে, আরও খারাপ আমার মনে হয়। প্রধান দায়িত্ব রুশদেরই ছিল, কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থন ছাড়া রাশিয়ায় এ নতুন একনায়কত্ব তৈরি করা অসম্ভব ছিল।
রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আশা কি আপনি দেখতে পান?
: আমি ইউক্রেন নিয়ে খুব আশাবাদী। আমি নিশ্চিত এ যুদ্ধে তারা বিজয়ী হবে। আর অন্যদিকে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব হতাশায়। আমি মনে করি না এটা একটা গণতান্ত্রিক, চমৎকার, সুন্দর দেশ হবে। পুতিন একদিন এ দেশে থাকবে না, আর তারপর আমরা ক্ষমতা পাওয়ার জন্য বিশাল এক লড়াই দেখতে পাব। রুশ সাম্রাজ্যের পতন অব্যাহত থাকবে; সব জাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলো রুশ ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যাবে। সাইবেরিয়াও যাবে। আমার মনে হয় নতুন একনায়কেরা আসবে আর পশ্চিমারা তাদের সমর্থন করবে, কারণ তারা নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দেবে, আর রুশ ইতিহাস আবার নিজের লেজে কামড় দেবে।
আপনি বইতে বলেছেন যে ঘৃণাই রোগ, আর সংস্কৃতিই নিরাময়। সংস্কৃতি কি সে-অন্ধকার ভবিষ্যৎ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে?
: এ যুদ্ধ শেষ হলে ইউক্রেনীয় এবং রুশদের মধ্যে বিশাল বড় ঘৃণা তৈরি হবে। সেতু তৈরি করা হয়তো সহজ হবে না। কিন্তু আমাদের সেতু তৈরি করতেই হবে। আর এ সেতুগুলো গড়ে উঠতে পারে শুধু সংস্কৃতি, সভ্যতা, সাহিত্য ও সংগীত দিয়ে। বিশাল লক্ষ্যটা হবে এটাই।