জীবনানন্দ দাশ: তার সাহিত্য, তার জীবন
লীনা দিলরুবা
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত শতকের শেষ আর বিংশ শতাব্দীর শুরুর সন্ধিক্ষণে এক অলোকসামান্য পরিবারে জন্মে ছিলেন তিনি। সালটি ১৮৯৯ এবং দিনটি ১৭ ফেব্রুয়ারি। আজ তার জন্মদিন। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৯৯ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের কারণেও স্মরণযোগ্য। জীবনানন্দ দাশ পেয়েছিলেন ‘নির্জনতম কবি’, ‘শুদ্ধতম কবি’ খেতাব, নজরুল বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী কবি’ রূপে।
কেমন মানুষ ছিলেন জীবনানন্দ দাশ? তার চরিত্রটা বোধকরি সবচেয়ে ভালো ধরতে পেরেছেন বুদ্ধদেব বসু-জীবনানন্দের কবিতার সবচেয়ে বড় প্রচারক।
‘জীবনানন্দকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ঢাকায়, তার বিবাহ-সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলাম ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজে, যুক্ত ছিলাম ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায় থেকে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তার কবি জীবনের সঙ্গে। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্বন্ধ আমি স্থাপন করতে পারিনি, অন্য কেউ পেরেছিলেন বলেও জানি না।’
হ্যাঁ। এমনই ছিল তার স্বভাব। ধ্যান এবং নিমগ্নতাকে জীবনানন্দ দাশ নিছক সাহিত্যচর্চার উপাদান বিবেচনা করেননি, তার জীবনচর্যার মধ্যে বিষয়গুলো ঢুকে পড়েছিল। নির্জন-একাকী, কিছুটা কুয়াশাঘেরা জীবনযাপন। খুব কম লোকের সঙ্গে তিনি মিশেছেন। তাই তার সৃষ্টিমূলক লেখা থেকে প্রত্নখনন করেই ব্যক্তি জীবনানন্দকে খুঁজে নিতে হয়।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় দেখি-
‘নির্জন নিঃসঙ্গ বিষণ্ন স্তিমিত অবসন্ন-এমনি ধারা বিশেষণে সাজিয়ে এ-ই এতদিন বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে জীবনানন্দ মিশুক নয়, ঠোঁটে আঁকা মৃদু হাসির বাইরে সে হাসতে জানে না, গা ঢেলে আড্ডা দিতে জানে না, রাস্তায় পরিচিত লোক দেখলেই পাশ কাটিয়ে সরে পড়ে। একদল লেখককে বলতে শুনেছি জীবনানন্দ জীবন থেকে পালিয়েছে, আরেক দল বন্ধুদের মুখে কথা, মানুষ থেকে যেন তৃণতরু শূন্য বালির চরের ধারে জনশূন্য নৌকা বাঁধা। অবিশ্যি সূর্যের খাড়া আলোর কাছে এসে সে দাঁড়াতে চায়নি, কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসা দূরের কথা। ডিঙি মেরেও দাঁড়ায়নি গলা বাড়িয়ে।’
এমন নির্বিবাদী ব্যক্তিটিকে নিয়ে গল্পের ডালপালা কম ছড়ায়নি। তাই সত্য-মিথ্যার আবছায়া আবরণে আবৃত সেসব গল্প ছাপিয়ে প্রামাণিক তথ্যনির্ভর লেখা যত বেশি প্রকাশিত হবে, এ-শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রচণ্ড প্রভাবশালী এ কবির জীবন নিয়ে বিভ্রান্তির জটাজালও তত ছিন্ন হতে থাকবে। এ-লেখার উদ্দেশ্যও মূলত এ প্রচেষ্টায় সলতে পাকানো। ইতি-নেতি মিলিয়েই মনুষ্য চরিত্র। আর নির্জনতা প্রিয় জীবনানন্দ একজন রক্ত মাংসের মানুষই ছিলেন। তার চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উন্মোচিত হয় বহু বছর পর।
‘প্রগতি’তে ৬২টি, ‘কবিতা’ পত্রিকায় ৯৭টি, কবিতা-ভবন বার্ষিকী ‘বৈশাখী’তে ৩টি মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকাগুলোতেই জীবনানন্দের মোট ১১৪টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এর জেরে তাদের দুজনার সম্পর্কটা আপাতদৃষ্টিতে আন্তরিকই ছিল।
কিন্তু জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত এক উপন্যাসে (সফলতা-নিষ্ফলতা) দেখা যায় পরম উপকারী বন্ধুটির প্রতি জীবনানন্দ বড় রকমের অবিচার করে বসে আছেন! বুদ্ধদেব বসুকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে বেশ খানিকটা বিদ্বেষ নিয়ে এ উপন্যাসে একটি খল চরিত্র নির্মাণ করা হয়, চরিত্রটির নাম বাণেশ্বর (বুদ্ধদেব বসু)। জীবনানন্দের অন্তর্জগতের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এ উপন্যাস ভিন্ন মাত্রিকতা যোগ করেছে।
অসংখ্য কবিতা লিখে বেশিরভাগই ট্রাঙ্কে তুলে রেখে দিয়েছিলেন। প্রেম হারিয়ে বেদনাক্লিষ্ট ছিল মনের অভ্যন্তর। অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য আর দাম্পত্য-সম্পর্ক নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চারদিকে সমস্যার পাহাড় তৈরি করে তার জীবনটাকে থিতু হতে দেয়নি। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে ট্রামের নিচে পড়ে মারাত্মক আহত অবস্থায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের নির্জন কক্ষে জীবনাবসান হয়েছিল কবির। যিনি জানতেন,-‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের-মানুষের সঙ্গে তার হয় নাকো দেখা।’
বরিশালের বগুড়া রোডের পৈতৃক বাড়িতে যে-একান্নবর্তী পরিবারটিতে তার জন্ম-বেড়ে ওঠা, সেখানে শিল্পের জল-হাওয়া আসা-যাওয়া করার সুযোগ ছিল। মা ছিলেন কবি, মাতামহও তাই।
পিতা সত্যানন্দ দাশ অল্প বয়সে সন্তানদের স্কুলে দেওয়ার বিরোধী ছিলেন তাই সরাসরি পঞ্চম শ্রেণিতেই বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে প্রবেশের মাধ্যমে জীবনানন্দের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু। এ বিদ্যালয় থেকেই জীবনানন্দ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯১৫)এবং দুবছর পর বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই এ পাশ করে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া শুরু করার জন্য কলকাতাবাসী হন। ভর্তি হন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি কলেজে। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ ক্লাসের ছাত্রটি অক্সফোর্ড মিশন ছাত্রাবাসে থাকতেন। ‘বর্ষ-আবাহন’ নামের কবিতাটি তখনই মুদ্রিত হয়। এটিই ছাপার অক্ষরে তার প্রথম কবিতা।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র জীবনানন্দের লেখালেখির শুরুটা ইংরেজিতেই, কবিতা দিয়ে। জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত তার আরও লেখার মতো ইংরেজি কবিতাগুলোও পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়নি, খাতার কালো অক্ষরে বাক্সবন্দি হয়ে কেবল তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেছে। তার মৃত্যুর পর ট্রাঙ্কের গহ্বর থেকে একে একে সেগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে।
I did not know
The earth was so soft
Before a woman came to me
And stopt.
(সূত্র-অপ্রকাশিত জীবনানন্দ, অমিতানন্দ দাশ)
প্রেমের অকপট উচ্চারণ।
প্রেমের কবিতা তিনি প্রচুর লিখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তার একটি প্রেমের সম্পর্কের কথাও এত দিনে পাঠকের জানা হয়ে গেছে। বেবি বা শোভনা কলকাতার ডায়োসেসান কলেজে পড়েছিলেন। এর আগে ডিব্রুগড় গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। বিশের দশকের মাঝামাঝিতে জীবনানন্দ চার-পাঁচ মাস শোভনাদের ডিব্রুগড়ের বাড়িতে থেকে ছিলেন। সে সময়ই শোভনার সঙ্গে কাকাতো ভাই মিলুর (জীবনানন্দের ডাকনাম) এক ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শোভনা জীবনানন্দকে ‘মিলুদা’ বলে সম্বোধন করতেন। এ চার-পাঁচ মাসের সময়টায় ডিব্রুগড়ে জীবনানন্দের তেমন কিছু করার থাকত না, ঘরের ভেতর অলস সময় কাটানো আর কবিতা লেখা ছাড়া। কবিতাগুলোর পাঠক ছিলেন শোভনা। কখনো কখনো দরজা বন্ধ করে শোভনাকে প্রথম লেখা পড়ে শোনানো হতো। শোভনার মা দুজনার স্পর্শকাতর এ যোগাযোগটি নিয়ে সতর্ক ছিলেন।
কবি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) শোভনাকে উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গের পাতায় লেখা ছিল-‘কল্যাণীয়াসু’। প্রসঙ্গত, জীবনানন্দ তার কোনো কাব্যগ্রন্থ স্ত্রী লাবণ্য দাশকে উৎসর্গ করেননি। স্ত্রীকে বইপত্র উৎসর্গ না-করার কারণ তলিয়ে দেখলে তাদের অসুখী দাম্পত্য-সম্পর্কের কথাই সামনে আসে।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর গোপন ট্রাঙ্কের অন্ধকার গহ্বর থেকে অন্যান্য লেখার সঙ্গে তার বেশকিছু খাতা উদ্ধার করা হয়েছিল, এর বেশিরভাগ লেখাই কোডেড ভাষায় লিখিত। বোঝাই যায়, লেখাগুলো উন্মোচিত হোক তিনি তা চাননি। তবে বলতেই হয়, জীবনাবসানের পর মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপন পরিধিটা আর অলঙ্ঘ্য থাকে না, এটা হয়তো প্রকৃতিরই অমোঘ সত্য। খাতাগুলোরও কৌমার্য রক্ষা হয়নি।
জীবনানন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ লিখেছেন-
‘কখনও একই দিনে দুটি খাতায় লিখেছেন ‘personal’ ও ‘general’ বক্তব্য। কয়েকটি খাতার নাম ‘literary notes’, যদিও গল্পের প্লট ও সাহিত্যের কথার ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ে চিন্তা বক্তব্য আছে তার মধ্যে। অনেক সময়ে তারিখ আছে, আবার মাঝে মাঝে নেই।’
পরবর্তী সময়ে খাতার বিষয়কে আশ্রয় করে ভূমেন্দ্র গুহের উদ্ধার ও বিশ্লেষণে এবং গৌতম মিত্রের সহযোগিতায় চার খণ্ডে ‘জীবনানন্দ দাশ, দিনলিপি, লিটারারি নোটস’ প্রকাশিত হয়েছে।
তার ডায়েরির ১৯৩৩ সালের একটি ভুক্তি-
Our marriage is scarp...সারা রাত কাঁদে...উঠে পড়ি...কি করব? আত্মহত্যা? হার্টফেল? শীতের রাতে অন্ধকার পুকুরে ডুবে মরব?...আগে এ রকম করার পর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইত...।
‘হঠাৎ চিন্তা হল বর্তমানের পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে দূর ভবিষ্যতে তার কীভাবে মূল্যায়ন হবে।’
জীবনানন্দকে বহুবছর বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিল, এর জেরে পরিবারটির আর্থিক দুরবস্থার অন্ত ছিল না। হয়তো এসব কারণেই লাবণ্যের খিটিমিটি আর জীবনানন্দের হতাশাবোধ। আর এ ভাবুক কবির সঙ্গে লাবণ্য হয়তো তল খুঁজতে খুঁজতেই দিশাহারা থাকতেন। তাই কাঁদতেন। কে বলতে পারে!
এদিকে জীবনানন্দ সম্পর্কের এতসব জটিলতায় হার্টফেল করে বসেন কি না তা ভাবছেন, এমনকি আত্মহত্যা করার চিন্তাও রয়েছে। ভুক্তির শেষের ফুটনোটটি করুন আলো বিকীরণ করে বলছে, ভবিষ্যতের পৃথিবী এ অনভিপ্রেত বিষয়গুলোর মীমাংসা কীভাবে করবে!
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’কে জীবনানন্দ এক প্রকার নাকচ করে দিয়েছিলেন, পরের বইয়ের ভূমিকায় সেটি স্পষ্ট করে লিখেও দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুুলিপি’ থেকেই মূলত তার কবিতার স্বতন্ত্র ধারা সবার চোখে পড়ে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘সহজ’ ইত্যাদি কবিতায় তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে বেশি করে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন-
তুমি তা জান না কিছু,- না জানিলে,-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে!
এ প্রেমটা নিয়ে তিনি যে কত ঝামেলায় ছিলেন, সেটি তার জীবন এবং সাহিত্য নিয়ে যিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন, সেই ভূমেন্দ্র গুহের জবানীতে শোনা যাক।
‘এই প্রেমটারও যে অসার্থকতা ছাড়া আর কোনো পরিণতি থাকতে পারত না, তা জীবনানন্দ বুঝতেন নিশ্চয়ই, তবু তিনি ঘটনাটাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি, বরং খুব বেশি ভাবে পাকে-পাকে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এবং নিজেকে জড়িয়ে থাকতে দিয়েছিলেন হতাশায় ক্ষোভে ক্রোধে বিষণ্নতায় ও অবাস্তব ব্যর্থতাবোধে ভুগতে-ভুগতে...।’ (দিনলিপি ৩য় খণ্ড/ ভূমেন্দ্র গুহ/পৃ. ১১৬৫)।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের বেশিরভাগ ছিল আত্মজৈবনিক। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘মাল্যবান’ প্রকাশে লাবণ্য দাশ বাধা দিয়েছিলেন। কী ছিল ‘মাল্যবান’-এ, যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতে দিতে লাবণ্যের আপত্তি ছিল!
সমালোচকরা বলেন, এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাল্যবানের মাধ্যমে জীবনানন্দ তার নিজের অসুখী দাম্পত্য সম্পর্কের কথাই লিখে গেছেন।
উপন্যাসে মাল্যবানের স্ত্রীর নাম উৎপলা। মাল্যবান যাকে পলা নামে ডাকে। উৎপলা সুন্দরী, রাগী এবং খরুচে। অন্যদিকে মাল্যবান গরিব, সাধাসিধে, শান্ত। দেখতে সে অনাকর্ষণীয়ও বটে।
স্ত্রীর অবহেলায় বাড়ির নিচতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরে একা একা রাত্রিবাস করে মাল্যবান। উৎপলার কাছে ভিড়তে চাইলে শুনতে হয় নানা গঞ্জনা। বাড়িতে উৎপলার ভাই এসেছে, থাকার অসুবিধা মেটাতে মাল্যবানকেই বাড়ি ছাড়তে হয়। সাত মাস মেসবাড়িতে কাটিয়ে আসে মাল্যবান। উৎপলার বন্ধু আসে-যায়, মাল্যবান বুঝতে পারে কী হচ্ছে। স্ত্রীর কাছে তার কোনো মর্যাদা নেই। বন্ধুবেষ্টিত উৎপলার অবহেলা সহ্য করতে করতে যেন নির্জীব হয়ে যায় মাল্যবান।
মাল্যবান একা-একা স্মৃতির মধ্যে ঘুরপাক খায়। পৌষের শীতের রাত, গ্রামের ছোট নদী, কাক আর কোকিলের আসা-যাওয়া কল্পনা করে। মাল্যবানের জন্মদিনে কেউ তাকে মনে রাখে না। মাল্যবানের বয়স বাড়ে, আরেকটি জন্মদিন অবহেলায় অপসৃত হয়ে যায়।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে ‘বনলতা সেন’, এরপর ‘মহাপৃথিবী’ এবং ‘সাতটি তারার তিমির’। একটির পর একটি কাব্যগ্রন্থে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যান। ততদিনে তার অনেক সুহৃদ, আপনজনরা তাকে ছেড়ে গেছেন। তার কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে-এটাই ছিল তাদের অভিযোগ। কিন্তু তবু তিনি নিজের প্রতিভার ওপর আস্থা রেখেছেন। আস্থা যে রাখতে হয় সেটি তিনি তার প্রবন্ধেও স্পষ্ট করেছেন।
বলেছেন, শেষ পর্যন্ত কবিকে প্রতিভার কাছে বিশ্বস্ত থাকতে হবে। হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতা মূল্যায়িত হবে। চরাচরের সব জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্য দরকার পড়বে সেই বিশেষ কবিতার।
আজ এত বছর পর কি এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে না?
সবকিছু ছাপিয়ে জীবনানন্দ দাশ এবং বাংলা কবিতা একে অন্যকে জড়াজড়ি করেই আজ ইতিহাস। তিনি চলে গিয়েও তাই আছেন। ধানসিঁড়ি নদী, হোগলা, নিম, সজনে, ধুন্দলকে কবিতার অনুষঙ্গ করে ‘রূপসী বাংলা’র কবি এ বাংলায় রয়ে গেছেন, তার সব নির্জনতা নিয়ে।