
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৫ পিএম
চানখাঁরপুলে ৫ হত্যা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন
গণহত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা
ট্রাইব্যুনালের তথ্যফাঁসের প্রমাণ সংগ্রহ করছি, প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা-চিফ প্রসিকিউটর

আরও পড়ুন
গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৫ জনকে গুলি করে হত্যায় মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের খসড়া প্রসিকিউশনের হাতে এসেছে। ঈদের পর ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হবে। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানান। খসড়া তদন্ত প্রতিবেদনে চানখাঁরপুলে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগও রয়েছে। এদিকে ট্রাইব্যুনালের তথ্যফাঁসের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চিফ প্রসিকিউটর। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এপ্রিলের মধ্যে আরও দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন শেষ হতে পারে বলে প্রসিকিউশন জানিয়েছে। সূত্র জানায়, তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে, গুম-খুনের সব ঘটনা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই হয়েছে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে তার হুকুমে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের সব মানবতাবিরোধী অপরাধের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন হাসিনা। গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হিসাবে আছেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনের খসড়া কপি বৃহস্পতিবার প্রসিকিউশনের হাতে এসেছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ঈদের পর ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
তথ্যফাঁসের প্রমাণ সংগ্রহ করছি : ট্রাইব্যুনালের তথ্যফাঁসের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তথ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করছি। যদি আমরা প্রমাণ পাই, প্রসিকিউশনের অফিস, টিমের কেউ অথবা ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাদেরই এ ধরনের তথ্যফাঁসের সঙ্গে জড়িত পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর মামলায় এসআই মালেক এবং কনস্টেবল মুকুলকে সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
‘আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে গর্বিত হইয়ো : চানখাঁরপুলে গুলিতে আনাস মারা যান। এ ঘটনায় বাবা পলাশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনের নামে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেন। এই মামলায় শাহবাগ থানার তৎকালীন ওসি (অপারেশন) আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন প্রামাণিক ও সুজন হোসেন গ্রেফতার আছেন। তদন্তে সেদিনের নির্বিচারে গুলির নৃশংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে বলা হয়, ঘটনার দিন গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে গোপনে বেরিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় আনাস। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, কীভাবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সেখানে অলিগলিতে ঢুকে গুলি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আনাস বাসা থেকে গোপনে বের হওয়ার সময় তার স্কুলের খাতায় বাবা-মায়ের উদ্দেশে চিঠি লিখে আসে। চিঠিতে সে বলে, ‘আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে গর্বিত হইয়ো। জীবনে প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’
ঈদের পর আরও প্রতিবেদন জমা পড়বে : চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা আশা করছি, আসন্ন ঈদুল ফিতরের পর আরও চার-পাঁচটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটা তদন্ত প্রতিবেদন থাকবে। সেটারও চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘষামাজা চলছে। আর ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) চার্জ দাখিলের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হবে। তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত সংস্থা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টি তাদের জন্য নতুন, তারপরও তারা সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং সাধারণ মামলা এক নয়। কার গুলিতে কোন ব্যক্তি শহিদ হয়েছেন, এর প্রয়োজন নেই। এখানে দেখতে হবে রাষ্ট্রের প্রধান জায়গা থেকে নির্দেশ এসেছিল কি না। একই পদ্ধতিতে সারা দেশে এ অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে কি না। সংঘটিত অপরাধগুলো তার (শেখ হাসিনার) নির্দেশেই হয়েছে, এর প্রমাণ পেয়েছি। জাতিসংঘ পেয়েছে, সুতরাং কে বাদী, কে বিবাদী, তাকে চিনল কি চিনল না-এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কারা নির্দেশ দিয়েছিল, কারা এটা বাস্তবায়ন করেছে। সে ক্ষেত্রে আইনে প্রমাণ করতে খুব বেশি কঠিন কাজ হবে না।
প্রতিটি গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : প্রসিকিউশনের একটি সূত্র জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা, আশুলিয়া ও চানখাঁরপুলে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে শতাধিক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। এরই মধ্যে আশুলিয়ায় ৬ আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। যাত্রাবাড়ী ও রামপুরার ঘটনায় দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যায়ে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা ও গুমের দুটি আলাদা মামলা তদন্তাধীন। এপ্রিলের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি (মিস কেস-২) মামলাসহ আরও দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রসিকিউটর গত বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি ঘটনায় কারা গুলি করেছে, কারা নির্দেশদাতা, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিটি ঘটনায় নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা।
তদন্ত সংস্থার বক্তব্য : শেখ হাসিনার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় অনেক বড় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তকাজে আমি একা নই, কয়েকজন কাজ করছি। তদন্তের জন্য সারা দেশে যেতে হচ্ছে। ঘটনাগুলো এক জায়গায় আনতে সময় লাগছে। আশা করছি, এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারব।
বিচারে বিলম্ব হওয়ার অভিযোগ শহিদপরিবারের : জুলাই আন্দোলনে শহিদ আহনাফ আহমেদের মা জারতাজ পারভীন যুগান্তরকে বলেন, আট মাস অতিবাহিত হলেও এখনো হত্যার বিচার হচ্ছে না। শেখ হাসিনাকে দেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাতে হবে। শহিদ আমিনের মা বলেন, ‘আমাদের সন্তান হত্যার বিচার চাই। সরকার গদিতে বসে সব ভুলে গেছে। তারা ক্ষমতা পেয়ে সব ভুলে গেছে।’
১৫৬ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা, গ্রেফতার আছেন ৫২ জন : সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরদ্ধে তিন শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ে ট্রাইব্যুনালে। এতে শেখ হাসিনা ও তার দলের রাজনীতিক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী, পুলিশ এবং গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের নাম রয়েছে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রসিকিউশন বাদী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ২৩টি মামলা (মিস কেস) করেছে। এর মধ্যে ৩টি গুমের মামলা। বাকি ২০টি মামলা হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এসব মামলায় ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। এর মধ্যে গ্রেফতার আছেন ৫২ জন (২৭ মার্চ পর্যন্ত)।
২৩টি মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামি : ট্রাইব্যুনালের মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামি হলেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা হচ্ছেন-ফারুক খান, শাজাহান খান, হাছান মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামরুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ, কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদ ও র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানসহ পুলিশের অন্তত ৫০ জন সদস্য।