রংপুরে উপপুলিশ কমিশনারের কাণ্ড
মামলার বাদীকে থানায় মারধর, গুলির চেষ্টা
চাঁদাবাজির মামলায় ব্যবসায়ী নেতা অমিত বণিক কারাগারে

রংপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় চাঁদাবাজির মামলা করতে আসা বাদীকে মারধর ও গুলি করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা (সাবেক ডিসি ক্রাইম) শিবলি কায়সারকে বৃহস্পতিবার রাতেই ওই পদ থেকে সরিয়ে ক্রাইম অ্যান্ড অপস পদে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি চাঁদাবাজির মামলায় রংপুরের ব্যবসায়ী নেতা অমিত বণিককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। এসব ঘটনায় অভ্যন্তরীণভাবে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে জানানো হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
থানায় পলাশ হাসানের দায়ের করা মামলার অভিযোগ সূত্রে পুলিশ জানায়, রংপুর মহানগরীর নিউ সেনপাড়ার বাসিন্দা লিপি খান ভরসা। তিনি হারাগাছ এলাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জাতীয় পার্টির একাধিকবারের সাবেক সংসদ-সদস্য প্রয়াত করিম উদ্দিন ভরসার পুত্রবধূ। বর্তমানে পারিবারিক সূত্রে বিড়ি ব্যবসায়ী। তিনি আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বর্তমানে কারারুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা টিপু মুনশির সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় লিপি খান ভরসাকে আসামি করা হয়। তবে এ মামলা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, পারিবারিক জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে এই মামলায় আসামি করা হয়। মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে তিনি নানাভাবে তদবির করেন বিভিন্ন জনের কাছে। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ও ব্যবসায়ী নেতা অমিত বণিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অমিত বণিক পুলিশ কর্মকর্তা শিবলি কায়সারের সঙ্গে তার সখ্য আছে উল্লেখ করে লিপি খানকে সেই মামলা থেকে নাম বাদ দিয়ে সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি লিপি খান ভরসার সঙ্গে ঢাকায় গোপনে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন।
কিন্তু লিপি খান দুই লাখ টাকা দিতে রাজি হন। ওই টাকায় মামলা থেকে তার নাম কেটে দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসা ভালো হলে তখন আরও দেখবেন বলেও জানান তিনি। এ সংক্রান্ত একটি অডিও কল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অমিত বণিকের নামে লিপি খানের ম্যানেজার পলাশ হাসান বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে একটি চাঁদাবাজির মামলা করেন। মামলার বাদী পলাশ হাসান তার অভিযোগে লেখেন, আমি লিপি খান ভরসার ম্যানেজার। তার স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসা দেখাশোনা করি। লিপি খান ভারসার সঙ্গে ব্যবসা ও সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বিরোধ ও মামলা আছে। ২০২৪ সালের ২৩ নভেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা হলে সেখানে লিপি খানকে ১৭৯ নম্বর আসামি করা হয়। আমার মালিকের পূর্বপরিচিত অমিত বণিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথন হয়। সেসময় তিনি জানান পুলিশের সঙ্গে তার সখ্য আছে। ১০ লাখ টাকা দিলে মামলা থাকবে না।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে লিপি খান ভরসার পক্ষে কোতোয়ালি থানায় মামলা করতে আসেন তার ম্যানেজার পলাশ হাসান। এ সময় অভিযুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তা শিবলি কায়সার জানতে পারেন, অমিত বণিকের সঙ্গে তার নামেও চাঁদাবাজির মামলা হতে পারে। এমন খবরের সূত্র ধরে বিকাল ৫টার দিকে কোতোয়ালি থানায় আসেন উপপুলিশ কমিশনার শিবলি কায়সার। তখন থানায় আরেক উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) হাবিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। শিবলি কায়সার থানায় এসে পলাশ হাসানের ওপর চড়াও হন এবং বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে কর্তব্যরত কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তাকে গুলি করতে উদ্যত হন। শুধু তাই নয়, এ সময় একজন পরিদর্শক পদবির কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলার ঘটনা ঘটে। পরে অন্য কর্মকর্তারা তাকে নিবৃত্ত করেন।
চাঁদাবাজির মামলায় অমিত বণিককে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়। পলাশ হাসানের দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। শুক্রবার তাকে আদালতের মাধ্যমে রংপুরে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
শিবলির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : পুলিশ কর্মকর্তা শিবলি কায়সারের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে রংপুরে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের মিছিল থেকে জাহাজ কোম্পানি মোড়ে হামলায় গুরুতর আহত হন রংপুরের জিয়া মঞ্চের নেতা লুসার আহমেদ। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ব্যবসায়ী অমিত বণিককে আসামি করা হয়। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা শিবলি কায়সার নিজে থানায় উপস্থিত হয়ে আসামির তালিকা থেকে অমিত বণিকের নাম কেটে দেন। এ সময় একজন বিএনপি নেতা নাম কাটার বিরোধিতা করলে উলটো ওই নেতাকেই মামলা দিয়ে জেলে ঢুকানোর জন্য ওসিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাঙামাটির সার্কেল এসপি থাকাকালীন সেই সময়কার পুলিশ সুপারের গায়ে হাত তোলার অভিযোগে বিভাগীয় প্রসেডিং হয়েছিল। এছাড়াও একজন ডিআইজির সঙ্গেও অপেশাদার আচরণের কারণে প্রসেডিং হয়েছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সুসম্পর্কের জেরে ওই দুটি প্রসেডিং থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করেন।
জানতে চাইলে রংপুর মহানগরের কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান মামলার বাদীকে মারধর ও অস্ত্র কড়ে নিয়ে গুলি করার উদ্যত হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মামলার বাদী পলাশ হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিপি খান ভরসা অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমের কাছে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।
পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) হাবিবুর রহমান বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা শিবলি কায়সার ৫টা বা পৌনে ৫টার দিকে কোতোয়ালি থানায় গিয়েছিলেন। কে বা কারা তাকে তথ্য দিয়েছিল যে, তার বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজি মামলা হতে যাচ্ছে। এতে তিনি উত্তেজিত হন এবং মামলার বাদীর সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে কর্তব্যরত সেন্ট্রির (থানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল) রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন উপস্থিত সবাই তাকে নিবৃত্ত করে। উপপুলিশ কমিশনার শিবলি কায়সারের থানার ভেতরের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে শিবলি কায়সার বলেন, বৃহস্পতিবার তাকে উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো কথা বলতে তিনি রাজি হননি।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী বলেন, ডিসি ক্রাইম শিবলি কায়সারকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অমিত বণিকের নামে চাঁদাবাজির মামলা হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।