
প্রিন্ট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩১ পিএম

এই ভবনে অবস্থিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ড।
আরও পড়ুন
কুড়িগ্রাম টেপারকুটি দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক গাজীউর রহমান অবসরে গেছেন ২০২০ সালের এপ্রিলে। এরই মধ্যে অবসর জীবন ৫ বছর পার হতে চলেছে তার। কিন্তু অবসর ভাতা ও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা কবে পাবেন জানেন না তিনি। অবসরে যাওয়ার পর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কষ্টের জীবন পার করছেন তিনি।
একই বছরের অক্টোবরে অবসরে গেছেন শরীয়তপুর ডামুড্যা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মচারী রাশিদা বেগম। তিনিও তার প্রাপ্য বুঝে পাননি। অসুস্থ রাশেদার আয় না থাকায় সংসারও ঠিকমতো চলছে না। এই দুজনের মতো আরও ৮৪ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী তাদের অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
এদের মধ্যে সাড়ে ৩৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ঘুরছেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থের জন্য। সবমিলিয়ে প্রায় ৮৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আর্থিক দাবি ঝুলে আছে ৫ বছর ধরে। এই আবেদন একসঙ্গে নিষ্পত্তি করতে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এসব শিক্ষক-কর্মচারী কবে নাগাদ তাদের অবসর ভাতা পাবেন তা অনেকটাই অনিশ্চিত।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে এই আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, যার জন্য পড়তে হচ্ছে ভোগান্তির মধ্যে। অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অবসর ভাতা পেয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন পার করে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যান শিক্ষক-কর্মচারীরা। চাকরি ছাড়ার পর তাদের আয়-উপার্জন পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের পাওনা টাকা না পাওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে অনেকের শেষ জীবন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সে তাদের চিকিৎসা দরকার। কারও বা সন্তানের লেখাপড়া কিংবা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া দরকার। কেউ ইচ্ছে পোষণ করেন হজ বা ওমরাহ পালন করার। কিন্তু টাকার অভাবে সবই আটকে আছে। উলটো ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে তাদের। অবসরে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে মারা গেছেন অনেকে। এছাড়া অনেকে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিদিনই দেশের ৬৪টি জেলা থেকে অবসর ভাতার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন তারা। অনলাইনে আবেদন করে শিক্ষকদের অবসরের এই টাকা দেওয়ার বিধান চালু থাকলেও অনেক শিক্ষকের আবেদনে নানা সমস্যা থাকে। ফলে তাদের অনেককেই ঢাকায় আসতে হয়। আর এখানে এসে তারা বিড়ম্বনার শিকার হন। অনেক দূরদূরান্তের জেলা থেকে ঢাকায় এসে আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়। যাদের কাগজপত্রে একটু খুঁত পাওয়া যায়, তাদের সমস্যার অন্ত নেই। এছাড়া অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে কিছু কর্মচারী ও মধ্যস্বত্বভোগী দালাল রয়েছে, যাদের মাধ্যমে ঘুস দিয়ে টাকা পাওয়ার জন্যও তদবির করতে হয়। শিক্ষকদের জন্য হেল্প নম্বর চালু থাকলেও কাউকে সেখানে পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে তারা বাড়তি অর্থ খরচ করে অবসর ভাতার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঘুরছেন।
এ প্রসঙ্গে অবসর সুবিধা বোর্ড প্রোগ্রামার মো. জামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে সাড়ে ৪৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার আবেদন অপেক্ষমাণ রয়েছে। এটি মানবিক বিষয়। অর্থ সংকটের কারণে আবেদনের জট দিন দিন বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা এই খাতে বাজেট দিলে সব আবেদন একসঙ্গে নিষ্পত্তি করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এতে শিক্ষকদের অবর্ণনীয় কষ্ট লাঘব হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা দরকার।
কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব ড. শরীফা নাছরীন (রুটিন দায়িত্ব) যুগান্তরকে বলেন, অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতন থেকে প্রতি মাসে ৪ শতাংশ অর্থ কর্তন করা হয়। এতে নিয়মিত কিছু আয় আসে। কিন্তু প্রতি মাসে যে পরিমাণ আবেদন আসে, সে তুলনায় বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি মাসে অনেককে বিদায় করার পরও বেশিরভাগ দাবি অনিষ্পন্ন থেকে যাচ্ছে। এভাবে প্রায় ৩৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর জট রয়েছে। এখন বিশেষ ও এককালীন বড় বরাদ্দ না করা হলে শিক্ষকদের ঘুরতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে এমপিওর (বেতন-ভাতা) মতোই অবসর-কল্যাণ খাতে পৃথক বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকেই এই অবসর সুবিধা বোর্ড চরম অবহেলিত। এছাড়া বিভিন্ন সময় সদস্য সচিব হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে আয়ের উৎস হচ্ছে এমপিও খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়া চাঁদা এবং স্থায়ী আমানত থেকে পাওয়া লভ্যাংশ। কিন্তু এই আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। এতদিন এসব টাকা দুটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হলেও এখন শুধু সরকারি ব্যাংকে দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকে টাকা জমা হলেও সঙ্গে সঙ্গে এই টাকা অবসরপ্রাপ্তদের দেওয়া হয় না। এই টাকা পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে-২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জমাকৃত আবেদন নিষ্পত্তি করে ব্যাংকে পাঠানো হয়। একই বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৭৪টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। এজন্য ৬০০ কোটি টাকার মতো দরকার। যদিও শিক্ষকদের বেতন থেকে ৬ শতাংশ হিসাবে জমানো টাকা থেকে প্রতি মাসে আয় আসে ৭৫ কোটি টাকা, আর এফডিআর থেকে মুনাফা আসে ৫ কোটি-মোট ৮০ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী মাসিক চাহিদা ১২০ কোটি টাকার। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৪০ কোটি। এতে দেখা যায়, বছরে ৫০০ কোটি টাকার মতো ঘাটতি থেকে যায়। বর্তমানে ৪৪ হাজার ৫০০ আবেদন অপেক্ষমাণ রয়েছে। যা নিষ্পত্তি করতে ৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কল্যাণ ট্রাস্টের প্রায় ৪০ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করতে ৩৭০০ কোটি টাকা দরকার। সরকার একটু আন্তরিক হলে অবসরে যাওয়া শিক্ষকরা শেষ বয়সে তাদের প্রাপ্য পাবেন বলে জানান একজন ভুক্তভোগী শিক্ষক।