Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অগ্নিঝরা মার্চ

সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখে মরতে চাই

Icon

মঞ্জুরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখে মরতে চাই

আমি রংপুর কলেজের ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি করে যে ভয়াবহ গণহত্যাযজ্ঞ চালায় সেই ঘটনার প্রতিবাদে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

তার আগে ৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ জয়লাভ করে। কিন্তু সে সময় পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। তারা বাঙালিদের দমন পীড়ন করে দমিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দেশ নতুন ভূখণ্ড, লাল-সবুজের পতাকা এবং একটি সংবিধান পায়। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন না হলে বাঙালিরা ভালো সরকারি চাকরি পেত না। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকার পরও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি চাকরির সুযোগ পেত মাত্র ৭ ভাগ। এখন সে পরিস্থিতি বদল হয়েছে। আজকে বাঙালি কর্মকর্তারা সচিব, সেনাবাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তা, ডিসি, এসপি হতে পারছেন। এটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল।

মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ৩০ ভাগ বলা হলেও তা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ৮ ভাগ কোটা সুবিধা ভোগ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীনের পর পরবর্তী সরকারগুলো তেমন কোনো মূল্যায়ন করেনি। বরং অবহেলা করেছে। সব সরকার আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারাই সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি সরকার ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজ বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে অভাবের মাঝে টিকে আছে। আজ দেশে কোনো মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় দেশ গড়ে ওঠেনি। ভুল পথে দেশ চলেছে, মুক্তিযুদ্ধের ফসল একটি রাজনৈতিক দলের সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশের মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছে। এই সুযোগে দেশের সম্পদ লুটপাট করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করেছে। আজ জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। তার জন্য বিগত শাসকরাই দায়ী। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ না হলে এই দেশ কোথা থেকে এলো। মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেই দেশ গঠনের জন্য কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এই দেশের শান্তিশৃঙ্খলা দ্রুত ফিরে আসবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা ফিরে পাব।

আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি রংপুর শহরের পাড়া মহল্লা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার প্রগতিশীল লোকজনকে ধরে নিয়ে গণহত্যা শুরু করল। রংপুর দখিগঞ্জ শ্মশানে একদিনেই ১১ জনকে ধরে নিয়ে গুলি করে। এদের মধ্যে মন্টু ডাক্তার নামে একজন বেঁচে যান। আইনজীবী শহীদ জররেজ আহমেদ ওই গণহত্যায় শহিদ হন। তার সাথে আরও ৯জনকে সেদিন গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা আমাকে তীব্র আহত করে। আমি সিদ্ধান্ত নেই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করব। প্রথমে আমি বাবা সেকেন্দার আলী ভূয়া, দুই ভাইসহ গংগাচড়ার বড়বিল নামক একটি গোপন আস্তানায় অবস্থান নেই। আমার বাবা তখন কাস্টমস কর্মকর্তা ছিলেন।

সেখান থেকে পরের দিন বাবা ও ভাইদের রেখে আমরা ৬ জন মিলে সারা দিন হেঁটে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে সিঁতাই পৌঁছি রাতের বেলা। পরে ভারতের দিনহাটা থেকে কোচবিহার জেলা। এর মধ্যে মুজিবনগর সরকার গঠন হওয়ার পর আমরা টাবুরহাট বিএসএফ ক্যাম্পে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেওয়া হয় সেখানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত করে নেওয়া হয়। সেখানে কিছু দিন থাকার পর শিলিগুড়ির মূর্তি পাহাড়ের বিএসএফ ক্যাম্পে ট্রেনিং করানো হয়। ভারতের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ট্রেনিং দেন। আমি সেখানে জুনিয়র কমান্ডার হিসেব পদবি পাই। আমার কমান্ডার ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা আনজারুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় চিলাহাটিতে মৃত্যুবরণ করেন।

আমি পরে দায়িত্ব পাই প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে চিলাহাটিতে রেলব্রিজ ধ্বংসের জন্য। আমি আমার সাথে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছি। সেদিন সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে বিস্ফোরক লাগিয়ে রাতে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেই। অপারেশন শেষে ভোরবেলা আমরা আমাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছি। এমন একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমার সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সম্মুখযুদ্ধ শহিদ হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো এখন শুধু স্মৃতিই নয়। এখন যে বাংলাদেশ দেখি সেই বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। তাই আমাদের স্বপ্নের সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সেই অপেক্ষায় আছি। স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখে শেষ বয়সে মরে যেতে চাই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুরুল ইসলাম, সাবেক জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রংপুর।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম