মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ সংস্কার কাজে উদাসীনতা
প্রকল্পের নথি গায়েব

নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্পের। গায়েব হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় রেকর্ড ও কাগজপত্র। ফলে মিলছে না অনেক প্রশ্নের উত্তর। অডিটসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। কেনাকাটা বা দরপত্রের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আসবাবপত্র, কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জামাদিরও হদিস নেই। এছাড়া ১৬ কর্মকর্তার বিদেশ সফর নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এলজিইডির চরম গাফিলতি এবং উদাসীনতায় কোনো মনিটরিং হয়নি। সব মিলিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পদে পদে ছিল দায়িত্বহীনতার ছাপ। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমাপ্ত এ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়গুলো এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করে দেখা উচিত। তবে নথি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরই। কারণ পিডি থাকবেন না। কিন্তু মন্ত্রণালয় তো থাকবে। এক্ষেত্রে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া গেছে।’ তিনি আরও বলেন, এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়ে থাকলে তা বের করার কোনো উপায় থাকল না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে এটি করা হয়েছে কিনা সেটি বলতে পারছি না। তবে উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার চরম বহিঃপ্রকাশ।
আইএমইডি জানায়, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ ও পুনঃনির্মাণ’ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। তখন মোট ৩৪২টি স্মৃতি স্থাপনার সংরক্ষণ ও পুনঃনির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১ কোটি লাখ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে মোট স্মৃতি স্থাপনার সংখ্যা কমিয়ে ২৮০টি নির্ধারণ এবং ব্যয় ধরা হয় ২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের পেছনে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কোনো রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়নি। উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হিসাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকল্প শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য ও দলিলপত্র সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কোনো নথি বা সম্পূর্ণ তথ্যাদি সংরক্ষণে নেই। অথচ প্রকল্পের পিপিআর-২০০৮ এর ক্রয়সংক্রান্ত রেকর্ড সংরক্ষণ বিষয়ে ধারা ৪৩(১) অনুযায়ী কমপক্ষে ০৫ বছর সংরক্ষণ করার বিষয়ে নির্দেশনা আছে। এ বিষয়ে পিআরএল এ থাকা প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইএমইডি। এসময় তিনি জানান, যে কক্ষে নথিপত্র রাখা হয়েছিল সেগুলো এলজিইডি কর্র্তৃপক্ষ অন্য রুমে স্থানান্তর করেছে। সে কারণে নথির কোনো সন্ধান মিলছে না। এছাড়া প্রকল্প শেষে নথিপত্রগুলো এলজিইডির প্রশাসনিক শাখায় লিখিতভাব হস্তান্তর করেছেন কিনা সেই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের পিসিআর-এ বৈদেশিক শিক্ষা সফর হিসেবে ২০১৮ সালে ৭ জনের একটি টিম এবং ২০১৯ সালে ৯ জনের একটি টিম শিক্ষা সফরের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেছে। কিন্তু মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) এ বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ ছিল না। তবে সংশোধিত ডিপিপিতে মূল ডিপিপি এবং সংশোধিত ডিপিপির মধ্যে প্রাক্কলিত ব্যয়ের বিপরীতে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের কথা বলা আছে। এছাড়া বছরভিত্তিক আর্থিক ও বাস্তব পরিকল্পনায় একই কোডে প্রশিক্ষণ হিসাবে উল্লেখ করা ছিল। তবে বিদেশ প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও পিসিআরে বৈদেশিক শিক্ষা সফর হিসাবে দেখানো হয়েছে। ডিপিপিতে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা সফর বিষয়ে কোনো ব্যয় বিবরণীসহ এ সফরের যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কোনো কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি। আইএমইডি বলছে, এ শিক্ষা সফরের ফলে কী আউটপুট অর্জিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা সংরক্ষণ ও নির্মাণের সঙ্গে এই বিদেশ সফরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
প্রকল্প মূল্যায়ন করে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় দেশের ২৭২টি স্মৃতিস্তম্ভের কাজ করা হয়েছে। এলজিইডির মাধ্যমে এই কাজ শেষ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় কোনো সংস্থা নেই। তাই এটির কাজ ও কার্যক্রম পরিচালনা বা মূল্যায়নের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পরিদর্শন বা মূল্যায়ন করা হয়নি। স্মৃতি স্তম্ভগুলো প্রকল্প সমাপ্তের শেষে কোনো কর্তৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করা হবে সে বিষয়ে প্রকল্পে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোর বর্তমান অবস্থা কী- সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত অন্যান্য স্মৃতি স্তম্ভগুলোর বর্তমান অবস্থার বিবরণ সংগ্রহ করে আইএমইডিতে পাঠাতে হবে।
আইএমইডি বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ ও পুনঃনির্মাণ প্রকল্পটি উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হিসাবে কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসাবে। পিসিআরের বর্ণিত তথ্য মতে, উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো মনিটরিংয়ের অংশ হিসাবে পরিদর্শন করেনি। অপরদিকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসাবে এলজিইডির পক্ষ থেকেও কোনো মনিটরিং করা হয়নি। এছাড়া প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে অডিটসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটি আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ। তাই অডিটের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পটি যখন হাতে নেওয়া হয় তখন কোনো প্রাক-সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় কেনা কম্পিউটার, অফিস সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র এলজিইডির অন্য একটি চলমান প্রকল্পে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। যে কাজটি সঠিকভাবে হয়নি। কেননা সমাপ্ত প্রকল্পের সব মালামালের গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে একটি সম্পদ বিবরণীসহ মালামাল প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।