Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অগ্নিঝরা মার্চ

রণাঙ্গনের ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’র যুদ্ধটা এখনো চলছে

Icon

নূরুল ইসলাম ফরিদ

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রণাঙ্গনের ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’র যুদ্ধটা এখনো চলছে

ছাপাখানার নাম ছিল ক্রান্তি। কলকাতার একটি প্রেস। সেখান থেকেই প্রথম ছাপা হয় মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’। প্রথম সংখ্যায় ৫ হাজার কপি ছেপেছিলাম আমরা। ৭১-এর ৪ আগস্ট। পরে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। সেই যে যুদ্ধটার শুরু তা আজও চলছে। মাঝে দেশ স্বাধীন হলো, ৫৪টি বছর পার করলাম। কিন্তু সত্যিকারের যে স্বাধীনতা, যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের এত এত আত্মত্যাগ, সেটা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। ৫ আগস্টের পর অবশ্য খানিকটা আশার আলো চোখে পড়ছে। হয়তো এবার ভাগ্য ফিরবে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের। তবে সেজন্যও লড়তে হবে। আর তাইতো এখনো মুক্তিযুদ্ধের ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি।

স্বাধীনতার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বরিশালে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। বয়সে তরুণ আমি ছিলাম কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে। বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে আমাদের বাসাতেই ছিল সংগ্রাম পরিষদের অফিস। এখান থেকে দক্ষিণাঞ্চলের সব থানা-মহকুমায় পৌঁছানো হয় আন্দোলনের বার্তা। কর্মসূচির নানা খবর পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে খবর আসে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইটের নামে নারকীয় গণহত্যার। অফিসের সামনের মাঠে তখন চলছিল বিপ্লবী গণসংগীতের অনুষ্ঠান। সেখানকার মাইকে দেওয়া হয় যুদ্ধের ঘোষণা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান জানানো হয় মাইকে। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ কয়েক হাজার মানুষ এসে জড়ো হন সেখানে। ভোরে বরিশাল পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র আর গোলা-বারুদ নিয়ে আসেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। ২৬ মার্চ সকালে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের সচিবালয়। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল বরিশাল। এরপর চলে যায় হানাদার বাহিনীর দখলে। আমরা ৩টি নৌকা আর ৩টি লঞ্চ বোঝাই করে সুন্দরবন হয়ে চলে যাই ভারতে।

১ মে ভারতে পৌঁছানোর পর নিই সামরিক প্রশিক্ষণ। যুদ্ধ করতে দেশে আসব, এ সময় সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সমন্বয় আর সাংগঠনিক কাজে থেকে যেতে বলা হয় আমাকে। পরে দায়িত্ব দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, বারাসাত, টাকি আর হিঙ্গলগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কো-অর্ডিনেশনের। বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রিসিভ করে থাকা-খাওয়া আর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতাম। কখনো কখনো এত বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবক যেত যে নিজেরই থাকা-খাওয়ায় টান পড়ত। কী অদম্য সাহস আর দেশ মার জন্য জীবন দেওয়ার আকুতি দেখতাম তাদের মধ্যে। সেখানে থাকতে একদিন মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ হোসেন কালু ভাই বলেন, ‘এটুকুতে মন ভরছে না রে, আরও কিছু করা দরকার।’ সেই আরও কিছু করার তাগিদ থেকে মাথায় এলো মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানো আর দেশের মানুষকে যুদ্ধের খবর পৌঁছে দিতে পত্রিকা বের করার বুদ্ধি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পত্রিকা বের করার জন্য নেমে পড়লাম মাঠে।

বরিশালের ডিজাইনার অশোক দা তখন কলকাতায়। তাছাড়া ‘ক্যানভাস সার্কেল’ নামে সেখানকার সংস্কৃতি কর্মীদের একটি সংগঠনের কর্মীদের কাছ থেকেও পাই সহযোগিতা। প্রথম সংখ্যার ডিজাইন করে দেন অশোক দা। ৪ আগস্ট বের হয় বিপ্লবী বাংলাদেশর প্রথম সংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা কলকাতায় যেত, তাদের কাছে দিয়ে দিতাম পত্রিকা। অন্যান্য মাধ্যমেও পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল বাংলাদেশে। কলকাতায় ছাপা হলেও প্রিন্টার্স লাইনে থাকত বরিশালের ঠিকানা। সদর রোডের একটি প্রেসের ঠিকানা দিতাম তখন। খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’। রণাঙ্গনের সব খবরই ছাপার চেষ্টা করতাম আমরা। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আর হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ। সপ্তাহে এক দিনের সেই পত্রিকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত মানুষ। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো শরীরে শিহরণ জাগে। এক সময় মুজিবনগর সরকারের স্বীকৃতিও পায় পত্রিকাটি। আমাদের নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৯। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ভারত থেকে ফিরে আসি স্বাধীন বাংলাদেশে। এখনো বের করছি পত্রিকাটি। সাপ্তাহিক থেকে সেটি এখন দৈনিক হয়েছে। নামের ডিজাইনটি এখনো সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ডিজাইনই রয়েছে। সেই সঙ্গে এখনো চলছে প্রাপ্তির লড়াই, যে প্রাপ্তির আশায় ১৯৭১-এ জন্ম হয়েছিল ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’র।

সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বরিশাল জেলা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম