বিদ্যুৎ থাকলেও নেই সরবরাহ লাইন
ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন
সামান্য কারণে সঞ্চালন লাইনে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে চাহিদার চেয়ে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ। তবুও বহু মানুষ অন্ধকারে। দুর্বল সঞ্চালন লাইনের কারণে গুণগত মান বজায় রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না বহু শিল্পকারখানা। ছোটখাটো কারণে সঞ্চালন লাইনে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সারা দেশের অর্ধেকের বেশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ৩২ বছরের পুরোনো। এছাড়া বিদ্যুতের ভোল্টেজ ও ফ্রিকোয়েন্সির ওঠানামা, ঘন ঘন এবং অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের সমস্যাও অনেক আগের। গত সরকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নিয়ে খুব সামান্যই কাজ করেছে। ফলে মানসম্মত সেবা পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশনের ক্যাপাসিটির অভাব রয়েছে। অপ্রতুল ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন। সঞ্চালন লাইনের অবস্থা খুবই খারাপ। সাধারণ কালবৈশাখী ঝড়েও লাইন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। গাছের ডালপালার আঘাত, এমনকি ছোটখাটো পাখির ঝাপটায়ও ট্রিপ করছে গ্রিডলাইন। এ অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করাই সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা মোকাবিলায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন উন্নয়নে নজর দিতেই হবে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, আসছে রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট হবে। তখন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ লাইনে দিলেই সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে লাইন ট্রিপ করার শঙ্কাও থাকবে। এতে গ্রাহকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে।
পিজিসিবির মুখপাত্র বদরুদ্দোজা সুমন যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে তাদের সঞ্চালন লাইন আছে ১৫ হাজার ৮৭০ সার্কিট কিলোমিটার। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৯৩ কিলোমিটার। গত ৫ বছরে বেড়েছে ৩২৭৭ কিলোমিটার। সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার বসাতে জমি দিতে কেউ রাজি হতে চায় না। তাই অনেক সময় লেগে যায়। এখন জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে সমস্যা রয়ে গেছে। ২০০৯ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২-৩ বছর ধরে সঞ্চালন ও বিতরণে কিছুটা জোর দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা বলছে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে মহানগর এলাকার সব বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশন মাটির নিচে নেওয়া হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন হবে ২৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ অনেক এলাকার শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না শুধু বিতরণ লাইনের সক্ষমতা না থাকায়। লাইনে ত্রুটির কারণে বহু স্থানেও বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক জায়গায় লাইন ওভার লোডেড হয়ে ট্রান্সফরমার জ্বলে যাচ্ছে। লাইন পুড়ে ও ছিঁড়ে যাওয়াসহ উপকেন্দ্র বিকল হয়ে পড়ছে। বৃষ্টি কিংবা ঝড়ো বাতাস শুরু হলে কিংবা বৃষ্টির আগে বিদ্যুৎ বিতরণ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।
সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নতুন তৈরি করা সঞ্চালন লাইনের মান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আছে ৬ লাখ ১৪ হাজার কিলোমিটার। এরপরও মানসম্মত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের আগের লাইনগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো ও মান্ধাতা আমলের। নতুন সাবস্টেশনগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে, সে হিসাবে বিতরণ লাইন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন।
পাওয়ার সেলের এক কর্মকর্তার অভিযোগ সঞ্চালনে পিছিয়ে আছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিনগুণ সক্ষমতা দরকার সঞ্চালন লাইনে। এখন আছে দেড় থেকে দুইগুণ। তাই সব সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
খোদ বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) ওয়েবসাইটে বলা আছে, সরকার শতভাগ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিলেও এই সময়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুত উন্নয়নের কারণ অনেকগুলো কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করেছে। কিন্তু একমাত্র সরকারি বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সে অনুপাতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি। বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত উপকেন্দ্র বা সাবস্টেশনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও নেই। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও সবার কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে ইনস্টল্ড ক্যাপাসিটির প্রায় ৩৬ শতাংশ উৎপাদনসক্ষম বিদ্যুতের জন্য কোনো সঞ্চালন ক্যাপাসিটি নেই। অথচ উৎপাদনের চেয়ে সঞ্চালনের ক্যাপাসিটি অন্তত ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি থাকা বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে হাজার হাজার ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড অবস্থায় রয়েছে। ফলে চরম নাজুক হয়ে পড়েছে বিতরণ ব্যবস্থা, প্রায়ই পুড়ে যাচ্ছে ট্রান্সফরমার। এতে লোডশেডিং নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ঝুঁকির মুখে শিল্প উৎপাদন : সারা দেশে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের কারণে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনেও হরহামেশা বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। নগরীর বিপনিবিতান ও মার্কেটগুলো লোড বাড়ালেই বিতরণ কোম্পানিগুলো লোড কমানোর নির্দেশ দেয় । এতে কাজ না হলে তারা নিজেরাই লোড কমিয়ে দেয়। কারণ হিসাবে তারা বলছে, বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশনের ক্যাপাসিটি নেই। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী সঞ্চালন লাইনের অবস্থা খুবই খারাপ। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর কোনোটিতে যদি ছোটখাটো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলেও গ্রিড ট্রিপ করছে। পুরোনো লাইন ওভারলোডেড হয়ে ঘন ঘন ট্রান্সফরমার জ্বলে যাচ্ছে। লাইন পুড়ে ও ছিঁড়ে বিকল হচ্ছে উপকেন্দ্র।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, তাদের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকলেও দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের কারণে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছেন না। এ কারণে দেশের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে না। শিল্পকারখানা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, যতবার বিদ্যুৎ চলে যায় ততবারই কেমিক্যাল নষ্ট হয়। এতে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও নানামুখী ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তারা জানান, বিদ্যুৎ চলে গেলে উৎপাদন বিঘ্ন ঘটে। এতে করে মান বজায় রেখে পণ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়ছে। স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্যের মান শতভাগ নিশ্চিত রাখতে বারবার কেমিক্যাল পরিবর্তন করতে হয়। এর ফলে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিল্পমালিকদের।
আরইবি (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, শিল্পকারখানায় ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হবে। এসব লাইনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় না। গত ১-২ বছরে অল্প কিছু নতুন সাবস্টেশন হয়েছে। সারা দেশে জরুরি ভিত্তিতে আরও শতাধিক নতুন ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ করা দরকার। তার মতে, আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পোড়ার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন বেহাল। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা সাফল্য দেখিয়েছে গ্রিডলাইন ও বিতরণ লাইন নির্মাণে সে সাফল্য দেখাতে পারেনি। অনেক আগে সারা দেশে বেশকিছু ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) এ নিয়ে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি। মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে সারা দেশে সে পরিমাণ ১৩২/৩৩ কেভির সাবস্টেশন নেই। এ কারণে বেশির ভাগ শিল্পকারখানায় ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে ব্রেকার বসিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ আনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। কিন্তু শক্তিশালী সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের কারণে এসব শিল্পকারখানা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সারা দেশের অর্ধেকের বেশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ৩২ বছরের পুরোনো। এ মুহূর্তে দেশে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আগামী এক বছর জাতীয় গ্রিডে আরও দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে। কিন্তু সে তুলনায় বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি।
পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৪০০ কেভি ২৪৯৭ সার্কিট কিলোমিটার, ২৩০ কেভি ৪ হাজার ২৬৫ সার্কিট কিলোমিটার ও ১৩২ কেভি ৮ হাজার ৬৮৫ সার্কিট কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন আছে। গত ৫ বছরে ৪০০/২৩০ কেভি ক্ষমতা বেড়েছে ৯৩৮৫ এমভিএ (মেগা ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার), ৪০০/১৩২ কেভি দৈর্ঘ্যরে ক্ষমতা বেড়েছে ২৬৬২ এমভিএ। ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৪৯০০ এমভিএ, ২৩০/৩৩ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৫৬০ এমভিএ ও ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৪৩৩৫ এমভিএ। ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ১৪৭২ সার্কিট কিলোমিটার। ২৩০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ৭৭৯ সার্কিট কিলোমিটার আর ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ১১১০ সার্কিট কিলোমিটার।