Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সাগরকন্যা কুয়াকাটা হঠাৎ অশান্ত

নিত্য চলছে মারধর-ছিনতাই * আতঙ্কে পর্যটক, নীরব পুলিশ

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাগরকন্যা কুয়াকাটা হঠাৎ অশান্ত

একের পর এক হামলা-ছিনতাই-মারধরের ঘটনায় অশান্ত হয়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা। স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙে পর্যটকদের ওপরও ঘটছে হামলার ঘটনা। সেই সঙ্গে চলছে যত্রতত্র ছিনতাই, চাঁদাবাজি আর ভয় দেখিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা। পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে যাত্রা শুরুর পর কুয়াকাটায় পরিস্থিতি এতটা খারাপ কখনোই হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোরেও স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। ৫ আগস্টের পর থেকে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ স্থানীয় পুলিশ বিভাগের ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা অবনতি বলে মনে করেন সেখানকার ট্যুরিস্ট সংগঠনগুলোর নেতারা। একই বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদেরও।

নিরাপদ পর্যটন প্রশ্নে সব সময়ই খ্যাতি ছিল পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার। ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতসহ সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোতে কখনোই ঘটেনি পর্যটক হয়রানির ঘটনা। রাতভর সাগরপারে নিরাপদে অবস্থান করতে পারতেন পর্যটকরা। কিন্তু সম্প্রতি সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সৈকতখ্যাত সাগরকন্যা কুয়াকাটা। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলচালকদের অত্যাচার, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপের ছিনতাই-চাঁদাবাজি, পর্যটকদের আটকে টাকা আদায় যেন পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের ঘটনায়। মঙ্গলবারও সেখানে পর্যটক অপহরণের খবর পাওয়া গেছে।

স্থানীয় নানা সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সূর্যোদয় পয়েন্ট গঙ্গামতী এলাকায় এক পর্যটক দম্পতি তাদের একটি মোবাইল হারিয়ে ফেলেন। হারানো মোবাইল পেয়ে ওই দম্পতিকে ফোন দেওয়া হয় তা নিতে। মোবাইল পেতে বিকাশে ৫ হাজার টাকা দাবি করা হয় তাদের কাছে। টাকা দেওয়ার পর পুরুষ ব্যক্তিটি মোবাইল আনতে ঝাউবন এলাকায় গেলে তাকে আটকে সঙ্গে থাকা আরও একটি মোবাইল এবং টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এরপর স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে টাকা নিয়ে ঝাউবনে যেতে ফোন দেওয়া হয় হোটেলে অবস্থানকারী স্ত্রীকে। তাকে আনতে ছিনতাইকারীদের ৩ জন যায় খোকন ভিলায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের সন্দেহ হলে আটকানোর চেষ্টাকালে ১ জন পালিয়ে গেলেও বাকি দুজন ধরা পড়ে। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পরে উদ্ধার করা হয় অপহরণের শিকার পর্যটককে।

স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এটাই কেবল নয়, এর আগেও কুয়াকাটায় দফায় দফায় ঘটেছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি-মারধরের ঘটনা। সোমবার ভোরে গঙ্গামতী এলাকায় সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া এক নারী পর্যটকের হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। শত শত পর্যটকের চোখের সামনে ঘটে এই ঘটনা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঝিনাইদহ থেকে বেড়াতে আসা ওই পর্যটক স্থানীয় পুলিশসহ সংবাদকর্মীদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এর আগে ফিশ ফ্রাই মার্কেট এলাকায় মোংলার কয়রা থেকে আসা এক পরিবারের কাছ থেকে নগদ অর্থসহ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মালামাল ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। ওই ঘটনায়ও লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার ভোরে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ বক্সের পাশ থেকে ওয়াটার রাইড মালিক লিটনের মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। কয়েকদিন আগে একইভাবে নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা বারী আজাদের মোটরসাইকেল সৈকত থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের তুলাতলী থেকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে কথা কাটাকাটির জেরে সৈকতে এক পর্যটককে মেরে পা ভেঙে দিয়েছিল ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলের চালকরা।

কুয়াকাটা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পর্যটক হয়রানিসহ ছিনতাই-চাঁদাবাজির এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটছে কুয়াকাটায়। এর মধ্যে হাতেগোনা কিছু ঘটনা জানাজানি হলেও বাকি সবগুলোই থাকে সবার অজানা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের অনেকেই ঘটনার পর থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায় না। কোনো অভিযোগও জানায় না কারও কাছে। ফলে দুর্বৃত্তদের অপকর্ম করার সাহস আরও বেড়ে যায়।’

কুয়াকাটার প্রতিষ্ঠিত ট্যুর অপারেটর হৈমন্তী ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিকদার মোহাম্মদ আলমাস বলেন, ‘এমন অরাজক পরিস্থিতি কুয়াকাটায় এর আগে আর আমরা কখনোই দেখিনি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় আসা যাচ্ছে কুয়াকাটায়। যোগাযোগব্যবস্থাও আগের তুলনায় অনেক সহজ। এ কারণে কুয়াকাটায় দিন দিন বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা। এ রকম একটি সময়ে ছিনতাইকারী চাঁদাবাজদের এই কালো থাবা পর্যটনকেন্দ্রের সম্মান নষ্ট করছে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, স্থানীয়দের তুলনায় বাইরে থেকে আসা ভাড়ার মোটরসাইকেল আর কিশোরদের কিছু গ্যাং এসব অপকর্ম ঘটাচ্ছে। আগে চেকপোস্ট, টহলের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা নিত পুলিশ। ইদানীং তাদের তৎপরতা নেই বললেই চলে।’

ট্যুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘ট্যুরিস্ট পুলিশের ধারাবাহিক নিষ্ক্রিয়তার কারণেই নিরাপদ কুয়াকাটার খ্যাতি আমরা হারাতে বসেছি। গত কয়েকদিনের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা হস্তক্ষেপ করে ছিনতাই হওয়া টাকা, মোবাইল ফোন উদ্ধার করে পর্যটকদের ফেরত দিয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তারা সক্রিয় হলে এসব অপকর্ম প্রতিরোধ কোনো বিষয়ই নয়।’ অভিযোগ সম্পর্কে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপার অনির্বাণ চাকমা বলেন, ‘মাত্র কয়েকদিন আগে আমি এখানে যোগদান করেছি। সবকিছু এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এলাকাও অনেক বড়। আমাদের যা জনবল আছে তাতে বড়জোর ৭-৮ কিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তারপরও আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। টহলের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। আশাকরি ভবিষ্যতে আর এ রকম কোনো ঘটনা ঘটবে না।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম