আড়াই বছর ধরে বন্ধ শাল্লা সোলার মিনিগ্রিড
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের টাকায় প্রকল্পে নয়ছয়
অন্ধকারে পাঁচ গ্রামের ৫০০ পরিবার * শর্ত ভঙ্গ করায় গ্রহণ করেনি পিডিবি * চুক্তির দৈনিক ৬ ঘণ্টার বিদ্যুৎ ৩ ঘণ্টাও পায়নি গ্রাহক

মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের টাকায় নেওয়া দুর্গম হাওড় এলাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাইলট প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুনামগঞ্জের শাল্লায় এ সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে উৎপাদন শুরু হলেও আশানুরূপ হয়নি। শর্তভঙ্গের দায়ে প্রকল্পটি গ্রহণও করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকাই হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহিম আফরোজ সানটেক কনসোর্টিয়াম। অথচ ২০২২ সালের বন্যার পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রয়েছে। এতে অন্তত ৫০০ পরিবার অন্ধকারে রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দুর্নীতি, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও নির্মাণ ত্রুটির কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে রহিম আফরোজ কর্তৃপক্ষ বলছে, চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্প হয়েছিল। চাহিদামতো বিদ্যুৎও পেয়েছিল গ্রাহক। বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রথম বছর ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেলেও পরের বছর থেকে চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাননি তারা।
জানা যায়, ২০১৩ সালে সুনামগঞ্জের হাওড়বেস্টিত শাল্লা উপজেলার ৫টি গ্রামের ৪ শতাধিক পরিবারকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে ৩১ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণ ব্যয় ছাড়া সোলার মিনিগ্রিডের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, সঞ্চালন লাইন বাস্তবায়নে ২৪ কোটি ২৮ লাখ টাকায় রহিম আফরোজ সানটেক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৩ আগস্টের মধ্যে উৎপাদনে যেতে হবে। উৎপাদন শুরুর পর ৫ বছর রক্ষণাবেক্ষণ শেষে চূড়ান্ত গ্রহণ সার্টিফিকেট (এফএসি) দেওয়া হবে। শুধু পিক আওয়ারে ৪০০ পরিবারকে বিদ্যুৎ দেওয়ার চুক্তি হয়। প্রকল্পের ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট। বাকি ১১ কোটি ১২ লাখ ৭৯ হাজার টাকা দেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
সম্প্রতি শাল্লার সাসকাই গ্রামের ৪০০ কিলোওয়াট সোলার ফটোভোল্টাইক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে থেকে তালা দেওয়া। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন পাহারাদার পাওয়া যায়। তিনি রহিম আফরোজের নিয়োগ করা। প্রধান ফটক খুলে ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, সারি সারি সোলার প্যানেল বসানো। প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী ২ হাজার ৩২২টি ২৮০ ওয়াট ক্ষমতার প্যানেল। দুইদিকে ৩ কিলোমিটর দৈর্ঘ্যরে ৬ কিলোমিটার থ্রি ফেজ সঞ্চালন লাইন টানা। ভবনের ভেতরে দেখা যায়, রহিম আফরোজের ৫৪০টি ব্যাটারি নিচতলায়। প্রতিটির গায়ে লেখা ২ হাজার ৫০০ অ্যাম্পিয়ার আওয়ার। এ কক্ষটিতেই নাকি বন্যার পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও বন্যাপ্রবণ হাওড় অঞ্চলে এসব যন্ত্রপাতি আরও উঁচুতে স্থাপন করার কথা। ভবনের পাশেই একটি বড় জেনারেটর রাখা। সেখান থেকে বের হতেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ এসে জানতে চান তারা কবে বিদ্যুৎ পাবেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রকল্পের পাশের বাড়ির বাসিন্দা হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুবল চন্দ্র দাস। তার জমিও এ প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
সুবল চন্দ্র দাস যুগান্তরকে জানান, উৎপাদন শুরু হলে প্রথম বছর ৪ শত গ্রাহক সন্ধ্যা থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়েছে। এ বিদ্যুৎ দিয়ে বেশির ভাগ ঘরে বাতি ও ফ্যান চলেছে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ফ্রিজ, টিভিও চালিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বছর থেকেই ২ ঘণ্টা কমে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়েছেন। তৃতীয় বছর থেকেই যন্ত্রণা শুরু হয়-২ থেকে ৩ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পায়নি গ্রাহক এবং সেসময় নাকি প্রকল্পের সঙ্গে বড় জেনারেটর যুক্ত করে বিদ্যুৎ দেওয়া শুরু করে। তিনি প্রশ্ন করেন, এত টাকা ব্যয়ে প্রকল্প করা হলো ৩ বছরের মাথায় কেন জেনারেটর যুক্ত করতে হবে। এই জনপ্রতিনিধির মতে, প্রকল্পের যন্ত্রপাতিতে কোনো ঘাপলা আছে। সেটা সুষ্ঠু তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। তিনি জানান, ২০২২ সালের বন্যায় এখানে পানি ওঠে যায়। তারপর তারা জানায় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। সেই বছরের জুন থেকেই তার ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের প্রায় ৫০০ পরিবার অন্ধকারে। বিদ্যুৎ দেওয়ার নামে এমন হয়রানির বিচারও চান তিনি।
এ সময় কথা হয় ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ওসমান গনির সঙ্গে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে পুকুরচুরি হয়েছে। এ এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তার দাবি, যে মানের যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। এখানে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। যারা এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
একই অভিযোগ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সুধীর রঞ্জন দাসের, এ প্রকল্প যেভাবে মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছে, তা ছিল হয়রানি। সন্ধ্যার পর কিছু সময় বিদ্যুৎ দিত, মানুষের ভাত খাওয়া শেষ না হতেই বিদ্যুৎ নেই।
এ প্রকল্পের কার্যক্ষমতা প্রমাণে যুগান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিমালিকানায় করা নোয়াখালীর মনপুরায় দুটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, সেখানে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির স্থাপিত ২৮১.৫ কিলোয়াট প্রকল্পের খরচ প্রায় ৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল থেকে তারা এর চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন (১৫০০ এমএইচ ব্যাটারি) দিয়ে ১১শ গ্রাহককে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছেন। একই কোম্পানির পাশের আরও একটি প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১৮.৪ কিলোওয়াট প্রকল্পে ৯ শত গ্রাহক পাচ্ছেন ১৬-১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ। যাদের মধ্যে অধিকাংশ গ্রাহকই টিভি, ফ্রিজ, পানির মোটর ব্যবহার করে থাকেন। অথচ শাল্লার এ প্রকল্পে ব্যয় ৩১ কোটি টাকার বেশি। ক্ষমতা ৬৫০ কিলোওয়াট পিক।
বিদ্যুৎ বিভাগের সুনামগঞ্জের সদ্য সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু নুয়মান, যিনি পদাধিকারবলে এ প্রকল্পের পরিচালক তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ প্রকল্পের কোনো তথ্যই তার কাছে নেই, সব তথ্য ঢাকায়। অথচ তিনিই প্রকল্প পরিচালক।
ঢাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রথমে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন জানিয়ে কথা বলতে বলেন সাবেক পরিচালক আহমেদ জহির খানের সঙ্গে। তবে তিনি বেশকিছু তথ্যও দেন। বলেন, আগে কী হয়েছে, এসব তথ্য নেই। বর্তমানে প্রকল্পটি কীভাবে চালু করা যায়, সেই চিন্তা করছেন। তিনি জানান, ঠিকাদারের ১০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়নি, বাকি ৯০ শতাংশ টাকা তুলে নিয়েছে।
সাবেক পরিচালক আহমেদ জহির খান বলেন, শর্ত ভঙ্গ করার কারণে তা গ্রহণ করেননি। কী শর্ত ভঙ্গ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চূড়ান্ত গ্রহণ সনদ নেওয়ার আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়। সেই কারণে তাদের টাকাও আটকে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে রহিম আফরোজের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জহুরুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে চুক্তি অনুযায়ীই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। সঠিকভাবে বিদ্যুৎ না দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।